পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম পারমাণবিক বিপর্যয়ের কেন্দ্রস্থল চেরনোবিল। ১৯৮৬ সালের এপ্রিলে সেখানকার চুল্লিতে বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তের মধ্যে সেখান থেকে পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে, যা গ্রাস করে ফেলে দেড় লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের বেশি অঞ্চলে। হিরোশিমা-নাগাসাকির তুলনায় চেরনোবিল থেকে ৫০০ গুণ বেশি তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায় বলে জানা যায়। রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ এমনকি চিন এবং আমেরিকাতেও তার প্রভাব টের পাওয়া গেছিল।
ওই দুর্ঘটনার প্রভাবে উত্তর ইউরোপের বায়ুমণ্ডলে তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। সুইডেনের পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, নিজেদের দেশেই কিছু ঘটেছে বলে প্রথমে ধারণা জন্মায় তাদের। তাই তড়িঘড়ি সুইডেনের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে জানা যায় চেরনোবিলে বিপর্যয় ঘটেছে।
তবে আজও চেরনোবিলের ধ্বংসস্তূপ পুরোপুরি পরিষ্কার করা যায়নি। এখনও সেখানে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ রয়েছে বলে দাবি বিজ্ঞানীদের। সব কিছু পরিষ্কার করে ২০৬৫ সালের আগে সম্পূর্ণ ভাবে সেটিকে নিরাপদ ঘোষণা করা সম্ভব নয় বলে দাবি তাদের।
এবার ইউক্রেনের সেনাদের থেকে দেশটির চেরনোবিলে অবস্থিত এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন রুশ সেনারা। ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ বলেছে, চেরনোবিল অঞ্চলে পারমাণবিক বিকিরণের মাত্রা বেড়েছে। রুশ সেনাদের আক্রমণের ফলে সেখানে ‘ভয়াবহ পরিণতি’ হতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছে দেশটি।
১৯৮৬ সালে চেরনোবিল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিস্ফোরণকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্যোগ, ক্ষতি ও মৃত্যু, দুই হিসেবেই মনে করা হয়। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট সতর্ক করেছেন যে রুশ বাহিনী তাদের অভিযান অব্যাহত রাখলে চেরনোবিলের মত আরেকটি বিপর্যয় আবারো ঘটতে পারে।
সূত্র মতে, ইউক্রেনের রাজধানী কিভ থেকে অদূরে অবস্থিত চেরনোবিলের পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র ও তার আশপাশের এলাকাগুলোতে অত্যন্ত ক্ষতিকর গামা রশ্মির বিকিরণের মাত্রা বেড়ে স্বাভাবিকের ২০ গুণ হয়ে গিয়েছে। ইউক্রেনের সরকারি সূত্রে গতকাল শুক্রবার এই খবর দেওয়া হয়েছে।
জানানো হয়েছে, পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রের বাইরে বিশাল যে এলাকা জুড়ে রয়েছে বর্জিত এলাকা বা এক্সক্লুসন জোন, তার সম্পূর্ণ অংশেই বিকিরণের মাত্রা এতখানি বেড়ে গেছে।
ইউক্রেনের পরিবেশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, সামরিক আগ্রাসনের কারণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্লুটোনিয়াম-২৩৯ পারমাণবিক বোমায় পরিণত হতে পারে যা হাজার হাজার হেক্টর অঞ্চলকে ধ্বংস করতে পারে। প্রাণহীন মরুভূমিতে পরিণত করতে পারে ওই অঞ্চলকে।
মন্ত্রণালয়ের শঙ্কা, এই ধরনের বিপর্যয়ের মানবিক এবং পরিবেশগত পরিণতির কোনো সীমা নেই। বিষয়টি মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর হবে।
কেন বেড়েছে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সরকারি সূত্রটি জানিয়েছে, এক্সক্লুসন জোনের ঠিক বাইরেই এখন রাশিয়া ও ইউক্রেনের সেনাদের লড়াই চলছে। রুশ সেনাবাহিনীর দিক থেকে ক্রমাগত ছুটে আসছে বন্দুকের গুলি, মর্টার, কামানের গোলা।
footage of fighting near chernobyl nuclear power plant pic.twitter.com/MYY5r1Hnvh
— Joshua (@jpegjoshua) February 24, 2022
অদূরে বেলারুশ-ঘেঁষা ইউক্রেনের উত্তর সীমান্ত থেকে ছুটে আসছে প্রচুর রুশ ক্ষেপণাস্ত্র। এই গোলাবারুদেই এক্সক্লুসন জোনে গামা রশ্মির বিকিরণের মাত্রা গত তিন দিনে এতখানি বেড়ে গিয়েছে।
প্রসঙ্গত, চেরনোবিলের পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রের একাংশ বৃহস্পতিবারই দখল করে নেয় রুশ সেনারা।
চেরনোবিলের এক্সক্লুসন জোনে রয়েছে একটি অটোমেটেড রেডিয়েশন-মনিটরিং সিস্টেম। এর মাধ্যমেই এক্সক্লুসন জোনে গামা রশ্মি-সহ বিভিন্ন ধরনের তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাত্রা ঘণ্টায় ঘণ্টায় মাপা হয়।
১৯৮৬ সালে দু’-দু’টি ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রটির পরমাণু চুল্লি। সেই বিস্ফোরণে চুল্লির উপরের প্রায় দু’হাজার টন ওজনের ধাতব ঢাকনাটি উড়ে যায় এক লহমায়। তার পর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে লাগোয়া এক হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকায়।
এরপর বন্ধ করে দেওয়া হয় পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন। বিকিরণের ছোবল থেকে মানুষকে বাঁচাতে পরে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রের বাইরে বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা হয় এক্সক্লুসন জোন।
সেই সময়েই বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ২৪ হাজার বছর ওই এলাকা আর মানুষের বসবাসের পক্ষে উপযোগী করে তোলা সম্ভব হবে না।
তারপরেই শুরু হয় সেই এক্সক্লুসন জোনে নিয়মিত বিকিরণ মাপার কাজ। যাতে আগামী দিনে পারমাণবিক বর্জ্য থেকে লাগোয়া এলাকাগুলিতে কোনও বিপদের সঙ্কেত আগেভাগেই মেলে।
রুশ সেনা চেরনোবিলের দখল নেওয়ার পরপরই হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি একটি বিবৃতিতে তীব্র আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘ওই কেন্দ্রের বহু কর্মীকে ধরে রেখেছে রুশ সেনারা। তার ফলে, পারমাণবিক বর্জ্যগুলিকে কড়া নজরদারিতে রাখার কাজে ব্যাঘাত ঘটছে।’’
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, গত ক’দিন ধরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সেনাদের লড়াইয়ে ছোড়া গুলিগোলার আঘাতেই কোনও ভাবে ফাটল ধরতে পারে পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রের বাইরে দ্বিস্তরের দু’টি নিরাপত্তা প্রাচীরের বাইরেরটিতে।
তার ফলে, দুটি প্রাচীরের মধ্যে থাকা তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বাইরে বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়েছে লাগোয়া এলাকাগুলিতে। ওই সব এলাকায় তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাত্রা সম্ভবত এই ভাবেই স্বাভাবিকের চেয়ে ২০ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে অত্যন্ত ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলি থেকে বেরিয়ে আসা বিকিরণগুলির অন্যতম— গামা রশ্মি।
তবে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র ইগর কোনাশেঙ্কোভ ওই দাবি অস্বীকার করেছেন। জানিয়েছেন, বিকিরণের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে রুশ সেনারাও পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রের কর্মীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।
যদিও ব্রিটেনের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পারমাণবিক শক্তি বিশেষজ্ঞ প্রযুক্তিবিদ ব্রুনো মার্ক চেরনোবিল থেকে ততটা বিপদের গন্ধ পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন। তবে তিনি জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে যদি কেউ ফন্দি এঁটে থাকে তা হলে বড় বিপদ ঘনিয়ে আসতেই পারে।
চেরনোবিলের এক্সক্লুশন জোন মূলত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারদিকে ৩২ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের অঞ্চল। বিস্ফোরণের ৩৬ বছর পরেও জনপ্রাণী বিহীন একটি এলাকা হিসেবে ঐ বিপর্যয়ের সাক্ষী হয়ে আছে।
একটি ত্রুটিপূর্ণ রিঅ্যাক্টরের কারণে ১৯৮৬ সালে ব্যাপক মাত্রার বিস্ফোরণটি হয়েছিল। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অন্য তিনটি রিঅ্যাক্টর ২০০০ সালে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং তখন থেকেই এই কেন্দ্রটি অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। ২০১৯ সালে এইচবিও’র একটি সিরিজের পর ঐ অঞ্চলটি পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্র হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৮৬ সালের বিস্ফোরণের পর থেকেই ঐ অঞ্চলের তেজস্ক্রিয়তা বিপজ্জনকভাবে বেশি মাত্রায় বিরাজ করছে।
উল্লেখ্য, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২৬শে এপ্রিল, ১৯৮৬ তারিখে সংঘটিত ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা। যা চেরনোবিলের বিপর্যয় হিসাবে পরিচিত। চেরনোবিল অঞ্চলটি বর্তমান ইউক্রেনের অন্তর্ভূত। এই পারমাণবিক দুর্ঘটনাকে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও বিপর্যয় হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৮৬ সালের ঐ বিস্ফোরণ পাঁচ বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করেন অনেকে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৪০
আপনার মতামত জানানঃ