আরবের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ ইয়েমেন। এর ওপর মধ্যপ্রাচ্যের মোড়ল সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট গত সাত বছর ধরে দেশটির ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আধিপত্য বিস্তারের এই লড়াইয়ে ইয়েমেনের কয়েক লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে আরও লাখ লাখ মানুষ। দেশটির অবকাঠামো খাত প্রায় ধ্বংসের মুখে। এদিকে ইয়েমেনে সৌদি জোটের বিভিন্ন রকম হামলা অব্যাহত রয়েছে।
ইয়েমেন সংকটের কোনো সামরিক সমাধান নেই; জাতিসংঘের এই কথাকে পাত্তা না দিয়েই প্রায় সাত বছর ধরে যুদ্ধ চলছে ইয়েমেনে। শান্তিপূর্ণ আলোচনার পথ বেছে নেওয়ার জন্য যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে বারবারই আহ্বান জানিয়েও সাড়া মেলেনি। ইয়েমেনে যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতিই হতে দেখা গেছে শুধু। বেড়েছে মানুষের দুর্দশা।
চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ইয়েমেনে সৌদি আরবের হামলায় ৪৭ জন শিশু নিহত হয়েছে। শনিবার(১২ মার্চ) জাতিসঙ্ঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা এ তথ্য জানায়।
সংস্থাটি বলছে, ইয়েমেনে চলা যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার শিশুরা। ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত আরবের দেশটিতে ১০ হাজার শিশু নিহত হয়েছে। এক সময় অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ থাকা দেশটিতে বেশ কয়েক বছর ধরে সৌদি আরবের লাগাতার হামলায় চরম দারিদ্র্যতা দেখা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রেসিডেন্ট আবদ-রাব্বু মনসুর হাদিকে পালাতে বাধ্য করার পর হুথি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানা এবং উত্তর ইয়েমেনের বড় অংশ দখল করার পর দেশটিতে সৌদি আরব সামরিক অভিযান শুরু করে।
ইউনিসেফের ইয়েমেন প্রতিনিধি ফিলিপ ডুয়ামেল এক বিবৃবিতে জানায়, গত দুই মাসে ইয়েমেনের বিভিন্ন স্থানে হামলায় ৪৭ জন শিশু নিহত হয়েছে। ইয়েমেনে সৌদি আরব সাত বছর ধরে ক্রমাগত হামলা চালানোর কারণে দেশটির শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ ভেঙে পড়েছে। যুদ্ধের কারণে প্রায় দুই হাজার ৫০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবহৃত হচ্ছে না।
ইয়েমেনে চলা যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার শিশুরা। ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত আরবের দেশটিতে ১০ হাজার শিশু নিহত হয়েছে।
বলা হয়ে থাকে, ইয়েমেনের যুদ্ধের আড়ালে আদতে লড়াই চলছে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে। ওদিকে আবার সৌদি আরব ও ইরানের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মতো পরাশক্তিরা। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনীতির কলকাঠি নাড়ছে ইসরায়েল। ইয়েমেনের হাউছি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আবদুল মালিক আল-হাউছির দাবি, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের দেশগুলো গোপনে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা করছে। তারা মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাতে লিপ্ত। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে সৌদি আরবের শাসকরা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোট করেছে।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা- ইউনিসেফ জানিয়েছে, ইয়েমেনে ২০১৫ সাল থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধে এ পর্যন্ত ১০ হাজার শিশু হতাহত হয়েছে। একে ‘লজ্জাজনক মাইলফলক’ অ্যাখা দিয়েছে সংস্থাটি।
জানুয়ারিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত ইয়েমেনে যুদ্ধক্ষেত্রে বিদ্রোহীদের দ্বারা নিযুক্ত প্রায় ২ হাজার শিশু মারা গেছে।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, জাতিসংঘের হিসাবে সংঘর্ষে গত বছরের শেষ পর্যন্ত ৩ লাখ ৭৭ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। গত বছরের শেষ দিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম বলেছে, ৬০ শতাংশ প্রাণহানি হয়েছে যুদ্ধ ও সংঘর্ষের কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ এবং বিভিন্ন রোগে। আর বাকি প্রাণহানি হয়েছে বিমান হামলা এবং সম্মুখসারির যুদ্ধে। জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক এ সংস্থা আরও বলেছে, অপুষ্টি, দুর্বলতা ও সংঘাতের কারণে সৃষ্টি সামাজিক সংকটের কারণে অনেক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলছে, ইয়েমেনের ১ কোটি ৬২ লাখ মানুষ অথবা জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ খাদ্যসংকটে রয়েছে। ৫০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে রয়েছে আর ৫০ হাজার মানুষ এর মধ্যেই দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির শিকার।
ইয়েমেনের সহিংসতা শুরুর পর থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আর এতেই খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, এমন নারীদের অপুষ্টিও বড় উদ্বেগের কারণ। ডব্লিউএফপি সতর্কতা জারি করে বলেছে, এই দুই দল অপুষ্টির শিকার।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) হিসাব বলছে, সহিংসতার কারণে ৪৬ লাখ ইয়েমেনি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। এ বছরের প্রথম দুই সপ্তাহে ৩ হাজার ৪৬৮ জন বা ৫৭৮ পরিবার গৃহহীন হয়েছে।
ইয়েমেনের ঘরহারা এসব মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। ইউএনএইচসিআরের হিসাব বলছে, ইয়েমেনের ৬৭ শতাংশ জনগণ ঘরহীন হয়ে পড়েছে। আর ২৬ লাখ মানুষ খাদ্যঝুঁকিতে রয়েছে। ঘরহারা এসব মানুষের ৭৯ শতাংশ নারী ও শিশু।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইয়েমেনের সহিংসতা অবসানের কোনো সম্ভাবনা নেই। দেশটিতে ভবিষ্যৎ খুবই অনিশ্চিত। এ মাসের শুরুতে জাতিসংঘ সতর্কতা জারি করে বলেছে, ইয়েমেনে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া সব দেশই জেতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের ইয়েমেনে নিযুক্ত বিশেষ দূত হ্যানস গ্রান্ডবার্গ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বলেছেন, সাত বছরের যুদ্ধে সব পক্ষ একে অন্যের ক্ষতি করেছে। যুদ্ধের এই ময়দানে কোনা সমাধানের পথ দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সংঘাতজর্জর দেশটিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। যতদিন যাচ্ছে ততই ইয়েমেন সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আর বিশ্ব অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের ফলে দেশটি বর্তমানে ইতিহাসের চরম মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছে। অচিরেই এই যুদ্ধ থামানো না গেলে বিশ্ব একটি মানব সভ্যতাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৭
আপনার মতামত জানানঃ