বন উজাড়, প্রাকৃতিক কারণে গাছের মৃত্যু ও জোয়ারের উচ্চতায় প্লাবনভূমি বেড়ে যাওয়ায় বিপদে আছে দক্ষিণ উপকূলের বন্যপ্রাণী। আবাসস্থল ও খাদ্যসংকটে প্রায়ই এসব বনের প্রাণী লোকালয়ে এসে মারা পড়ছে। এ অবস্থায় আজ ৩ মার্চ পালিত হচ্ছে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস।
আন্তর্জাতিকভাবে এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো, রিকভারিং কি স্পেসিস ফর ইকোসিস্টেম রিস্টোরেশন। বাংলায় যার ভাবানুবাদ করা হয়েছে, ‘বিপন্ন বন্যপ্রাণী রক্ষা করি, প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসি।’
জাতিসংঘভূক্ত দেশগুলো দিবসটি পালন করে থাকে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হবে।
দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আগারগাঁও এর বন ভবনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখবেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল।
এর আগে ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ৬৮তম সাধারণ অধিবেশনে ৩ মার্চকে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০১৪ সালে প্রথম এ দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্বের বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদকূলের প্রতি গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা এই দিবসের মূল লক্ষ্য।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত বিবরণীতে বন্যপ্রাণীদের অপরিহার্য মূল্য এবং বিভিন্ন অবদানের কথা পুনর্ব্যক্ত করা হয়। এতে পরিবেশগত, জিনতাত্ত্বিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাবিষয়ক, সাংস্কৃতিক, বিনোদনমূলক এবং নান্দনিক বিষয়ের সঙ্গে যুগসই উন্নয়ন এবং মানবকল্যাণের দিকে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বিশ্বের বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদকূলের প্রতি গণসচেতনতা গড়ে তোলা এবং সিআইটিইএস-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্বীকার করা বলা হয় আর্ন্তজাতিক বাণিজ্য যাতে বন্য প্রজাতিদের টিকে থাকতে হুমকি হয়ে না দাঁড়ায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড এক প্রতিবেদনে জানায়, ১৯৭০ সাল থেকে বিশ্বে এ পর্যন্ত বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমেছে দুই-তৃতীয়াংশ। এভাবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে হারিয়ে গেছে ৩১ প্রজাতির প্রাণী। এছাড়াও বাংলাদেশে অন্তত ২১৯টি প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিপন্ন। এই তালিকার মধ্যে আছে উভচরসরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী।
বনবিভাগের এক হিসাবে ৪২ প্রজাতির উভচরের মধ্যে ৮টি, ১৫৮টি প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে ৬৩টি, ৭৩৬টি প্রজাতির পাখির মধ্যে ৪৭টি, ১২৪টি স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে ৪৩টির অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন।
গত বছরের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট উচ্চ জোয়ারের পানিতে সুন্দরবন ও দক্ষিণ উপকূলের বিভিন্ন বনাঞ্চলে প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সুন্দরবনে তিনটি মৃত হরিণ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে লোকালয়সংলগ্ন বলেশ্বর নদ থেকে উদ্ধার হওয়া একটি হরিণের পেটে বাচ্চাও ছিল। শুধু সুন্দরবন নয়, পাথরঘাটার হরিণঘাটা, রাঙ্গাবালীর চরমোন্তাজ, নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপসহ উপকূলের সংরক্ষিত বন থেকে অনেক হরিণ জোয়ারের তোড়ে লোকালয়ে চলে এসেছিল।
শুধু হরিণ নয়, প্রকৃতির বৈরী আচরণ ও বন উজাড়ের ফলে অন্য বন্যপ্রাণীও সংকটে পড়েছে। খাদ্যসংকট ও নিরাপত্তার অভাবে অভয়ারণ্য ছেড়ে প্রাণীগুলো প্রায়ই চলে আসছে লোকালয়ে। অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে বন্যপ্রাণীর। অতি উচ্চতার জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলায় বনের ভেতরে প্রাণীদের আশ্রয়ের জন্য উঁচু ঢিবি তৈরি করার পাশাপাশি মিঠাপানি ও খাবারের সংস্থান বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল বরগুনার তালতলী উপজেলার টেংরাগিরি। নিশানবাড়িয়া ও সখিনা—দুটি বিট নিয়ে এ বনের আয়তন ১০ হাজার ৬৪৭ একর। টেংরাগিরিতে লবণাক্ত ও মিষ্টি মাটির মিশ্রণের কারণে প্রচুর জাম, ধুন্দুল, কেওড়া, সুন্দরী, করমচা, কেওয়া, তাল, বনকাঁঠাল, রেইনট্রি ও গরানগাছ আছে। বসত গড়েছে কাঠবিড়ালি, বানর, প্রায় ৪০ প্রজাতির সাপ, শজারু, শূকর, উদ, কচ্ছপ, শিয়াল, ডোরাকাটা বাঘ, বনমোরগ, মধু, কাঁকড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। এখানে ইকোপার্কের বাসিন্দাদের মধ্যে আছে কুমির, হরিণসহ অন্য অনেক প্রজাতির বন্যপ্রাণী। এ বনের ২১ কিলোমিটারজুড়ে প্রতিবছর ভাঙছে। অর্থাৎ, ভাঙনের কারণে ওই এলাকায় বছরে গড়ে ২৫০ মিটার বনের ভেতরে ঢুকে পড়ছে সাগর। বরগুনার তালতলী উপজেলা থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকত পর্যন্ত বিস্তৃত এ বন।
খাদ্যসংকট ও নিরাপত্তার অভাবে অভয়ারণ্য ছেড়ে প্রাণীগুলো প্রায়ই চলে আসছে লোকালয়ে। অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে বন্যপ্রাণীর।
বন বিভাগের খাতায় ‘টেংরাগিরি বনাঞ্চল’ হলেও স্থানীয়ভাবে এটি ‘ফাতরার বন’ নামে পরিচিত। ১৯৬৭ সালে এ নামকরণ করা হয়। তখনকার হিসাব অনুযায়ী, বরগুনার বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে চোখজুড়ানো এ বনের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। ১৯২৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, ১৯৬০ সালের ১২ জুলাই তৎকালীন সরকার এটিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে।
অপর দিকে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় দুই হাজার একর আয়তনের সৃজিত হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনে দেশের সবচেয়ে বড় প্রজাতির চিত্রল হরিণের বসতি। আছে শূকর, অজগরসহ অনেক প্রজাতির পাখি ও বন্য প্রাণী। কিন্তু এ দুটি বনাঞ্চলই একদিকে চোরাই কাঠ পাচারকারীদের হাতে উজাড় হচ্ছে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক কারণে গাছের মৃত্যু ও ভাঙনে আয়তন কমছে। এতে খাদ্যসংকট ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ায় অহরহ লোকালয়ে চলে আসছে বন্যপ্রাণী এবং মারাও পড়ছে। সেই সঙ্গে অস্বাভাবিক লবণাক্ততা ও অধিক উচ্চতার জোয়ারে এসব বনভূমি প্লাবিত হওয়ায় আপদে আছে বনের প্রাণীগুলো।
পাথরঘাটা বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুল হক বলেন, অধিক উচ্চতার জোয়ার হরিণঘাটা বনে প্রবেশ করে। বনের যেসব স্থানে হরিণ, শূকরসহ অন্যান্য বন্য প্রাণী অবস্থান করে, ওই সব এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। এতে বন্য প্রাণীগুলোর স্বাভাবিক জীবন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
জাতিসংঘ ২০২১-এর বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ২০২১-৩০ সময়কে প্রতিবেশ সংরক্ষণ দশক ঘোষণা করেছে। যার পুরো সময়টাই বিশ্বের দেশগুলোকে টেকসই উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হবে। তবে বাংলাদেশ প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে কতখানি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা আদৌ অর্জিত হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কার কারণ রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকার বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে নানাভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছে। এমনকি সংবিধান এর-১৮(ক) অনুচ্ছেদে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’তথাপি সংশ্লিষ্ট সেক্টরগুলোর আন্তযোগাযোগ ও সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে নানাভাবে বনের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে এবং হচ্ছে। বন্যপ্রাণীর স্বার্থ তো অনেক ক্ষেত্রেই আলোচনায় উপেক্ষিত থাকে। কখনো কোথাও বন্যপ্রাণী মারা পড়লে বা এ-সংক্রান্ত দুর্ঘটনা ঘটলে মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো সরব থাকে।
তারা বলেন, ব্রিটিশ উত্তরাধিকার হিসেবে বাংলাদেশের বন ব্যবস্থাপনার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও পরিচালন কৌশলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যে পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন ছিল, ততখানি হয়নি। সেটি না হয়ে বন ব্যবস্থাপনার সাবেকি কাঠামো ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বনের সহব্যবস্থাপনাসহ বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার নতুন কাঠামো, বিশেষত বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটগুলোর কার্যক্রম নড়বড়ে হয়ে ঝুলে আছে।
বন্যপ্রাণী বা প্রতিবেশ রক্ষায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন, এসব কাজে মানুষকে বিরত রাখার সুযোগ নেই, বন আইনকে জনবান্ধব করতে হবে, জনগণের অংশগ্রহণের উপযোগী করতে হবে, বন ও প্রতিবেশের দায়িত্ব শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের নয়, এই বোধ সবার মধ্যে জাগ্রত করা দরকার। নইলে লোকে প্রতিবেশ ধ্বংস করে এলাকার বনবিড়াল ও বাগডাশ ধরে-মেরে বন অধিদপ্তরকে খবর দেবে।
আরও বলেন, বাংলাদেশের বন, বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈচিত্র্য, বৈশ্বিক উন্নয়ন অভীষ্টের ১৫তম সূচক বন আচ্ছাদন তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাহাড়ি বনের গুরুত্ব অপরিসীম। একইভাবে হাওর, নদী ও সমুদ্রসহ সব জলজ প্রতিবেশকে দূষণমুক্ত রাখাও প্রতিবেশ সংরক্ষণের জন্য সমানভাবে জরুরি। এই মুহূর্তে তাই প্রয়োজন বন, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের প্রতি রাষ্ট্রের ঘোষিত প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়নে আইন, পরিকল্পনা ও নীতির প্রয়োগে সব সরকারি প্রতিষ্ঠান ও জনগণের ঐকমত্য।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৩
আপনার মতামত জানানঃ