পুরো নাম : মোশে বেন মাইমন। তাঁর আরবি নাম : মূসা বিন মাইমুন। তিনি রামবাম নামেও পরিচিত। মোশের জন্ম হয় ১১৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মার্চ বর্তমান স্পেনের কর্ডোভায়। তিনি একাধারে একজন ইহুদি দার্শনিক, আইনবিদ, চিকিৎসক এবং মধ্যযুগীয় ইহুদি ধর্মের অন্যতম পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। তিনি আরবি ভাষায় ইহুদির জন্য দিকনির্দেশনামূলক বিভিন্ন গ্রন্থস্থ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বই রচনা করেছেন। ধর্ম, দর্শন এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাঁর অবদান ইহুদি এবং অ-ইহুদি সবাইকে সমানভাবে প্রভাবিত করেছে।
মাইমোনাইডসের কর্মক্ষেত্রের বিস্তৃতি অনেক বেশি। তিনি ১৬ বছর বয়সে তার প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন, আরবি ভাষায় সেই নাম ছিল ‘মাকলাহ ফি সিনাত আল-মান্তিক’। এটি ছিল বিভিন্ন তাত্ত্বিক ধারণায় যুক্তির প্রয়োগের ওপর একটি গবেষণা গ্রন্থ। এই গ্রন্থের নানা তথ্য পরবর্তীতে যুক্তিবিদ্যা ও অধিবিদ্যায় (দর্শনশাস্ত্রের একটি ভাগ) ব্যবহৃত হয়েছিল। এছাড়া তার প্রথম জীবনের আরো একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো Essay on the Calendar. এটিও আরবি ভাষায় লিখিত।
মাইমোনাইডস তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি রচনা শুরু করেন ২৩ বছর বয়সে। এটি ছিল আরবি ভাষায় মিশনাহ সম্পর্কিত তার ব্যাখ্যা; কিতাব আল-সিরাজ। এখানে উল্লেখ্য, মিশনাহ হলো প্রথম থেকে তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত ইহুদি আইনি সমূহের একটি সমগ্র। মাইমোনাইডস তার ব্যাখ্যায় প্রত্নতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের নানা প্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে মিশনাহর বিভিন্ন শব্দ ও বাক্যাংশের সঠিক অর্থ বুঝিয়ে দেন। তার রচিত ব্যাখ্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, সাধারণ দর্শনশাস্ত্রের যেসব বিষয় মিশনাহে বর্ণিত আছে, সেই বিষয়গুলোর পরিচিতি মূলক প্রবন্ধ তিনি তার ভাষ্যে যুক্ত করেছেন। মাই মোনাইড এ গ্রন্থটি সম্পন্ন করতে ১০ বছর সময় নিয়েছিলেন।
মিশনাহর ব্যাখ্যা রচনার পর তিনি ইহুদি আইনের সংকলন তৈরি করেন। তিনি এই গ্রন্থের নামকরণ করেন মিশনে তোরাহ (Mishna Torah) বা তোরাহর পর্যালোচনা। এই গ্রন্থটি সহজবোধ্য হিব্রুতে লেখা। এছাড়াও ইহুদি আইনসংক্রান্ত তিনি আরো দুইটি গ্রন্থ রচনা করেছেন : কিতাব আর ফারাইদ (Book of Precepts) এবং হিলখোট হা যেরুযালেমি (The Laws of Jerusalem)। এদের প্রথমটি আরবি এবং দ্বিতীয়টি হিব্রু ভাষায় রচিত।
পরবর্তীকালে তিনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ দালালাত আল-ইরান (The Guide of the Perplexed) রচনা করেন। এই গ্রন্থটি তিনি ১১৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রচনা শুরু করেছিলেন এবং ১৫ বছর পর শেষ করেছিলেন। গ্রন্থটির হিব্রু অনুবাদ ‘মোরে নেভুখিম’ নামে পরিচিত। এই গ্রন্থে তিনি ইহুদি ধর্মকে একটি যুক্তিবাদী দর্শন হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা বিজ্ঞান, দর্শন এবং ধর্মতত্ত্বের মাঝে যোগসূত্র স্থাপন করার ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছিল। এই গ্রন্থটি আরবিতে লেখা হয়েছিল এবং মাইমোনাইডসের জীবদ্দশায় তা হিব্রুতে অনুবাদ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ল্যাটিন এবং বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছিল বইটি। এই গ্রন্থ ধর্মীয় চিন্তা ইতিহাসে নতুন এক ধারা নিয়ে এসেছিল।
মাইমোনাইডস বেশ কয়েকটি ছোট ছোট বইও লিখেছিলেন। তাঁর ছোটখাটো কাজের মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয় তা হলো :
১. ইগ্রেট তেইমেন (Epistle to Yemen),
২. ইগেরেট হা-শেমাদ বা মামার কিদুশ হা-শেম (Letter on Apostasy), এবং
৩. ইগেরেট লে-কাহাল মার্সিলিয়া (Letter on Astrology/Letter to the Community of Marseille)।
মাইমোনাইডস চিকিৎসাশাস্ত্রের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক ওয়াল্ডেমার শোয়েশিমার মাইমোনাইডসের চিকিৎসামূলক রচনাগুলো সম্পর্কে বলেছেণ :
‘মাইমোনাইডসের চিকিৎসা শিক্ষা একেবারেই প্রাচীন নয়। তাঁর লেখাগুলোর বিষয়বস্তু আশ্চর্যজনকভাবে আধুনিক।’
মাইমোনাইড ১২০৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন এবং টিবেরিয়াস-এ তাকে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর সমাধি সৌধকে আজো অসংখ্য ইহুদি তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।
তথ্যসূত্র :
britannica.com
জুদাইজম; মাশরুর ইশরাক
আপনার মতামত জানানঃ