১৯২১ সালে চার্লস হাওয়ার্ড-বারি মাউন্ট এভারেস্টে একটি অভিযান পরিচালনা করেন। সেবার বরফের ওপর তিনি কিছু বিশাল পায়ের ছাপ খুঁজে পান। তিনি জানলেন, সেগুলো ছিল ‘মিথো-কাংমি’র। এই শব্দটির আক্ষরিক অনুবাদ করলে হয় ‘মনুষ্য-ভল্লুক তুষারমানব’।
দেশে ফেরার পর অভিযাত্রী-দলটির কয়েকজন সদস্যের সাক্ষাৎকার নেন হেনরি নিউম্যান নামক একজন সাংবাদিক। নিউম্যানের হাত ধরে এই কিংবদন্তি ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় শেরপাদের ইয়েতি-দর্শনের গল্পগুলো অভিযাত্রীদের মাধ্যমে অনূদিত হতে থাকে। সেই সাথে এই গল্পের নতুন ডালপালা ছড়ায় পশ্চিমা দুনিয়ায়।
১৯৫০-এর দশকে ইয়েতি নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায়। ইয়েতির সন্ধানে অভিযাত্রী ও পর্বতারোহীরা অসংখ্য অভিযান পরিচালনা করেন হিমালয় অঞ্চলে। এমনকি হলিউড অভিনেতা জেমস স্টুয়ার্টও ইয়েতির সাথে জড়িয়ে যান। তিনি সেসময় তার লাগেজে ‘ইয়েতির’ একটি আঙুল বয়ে বেড়াতেন।
একজন মার্কিন অভিযাত্রী আঙুলটি নেপালের কোনো এক গুম্ফা থেকে সংগ্রহ করেন। পরে স্টুয়ার্টের সহযোগিতায় আঙুলটি ভারতের বাইরে পাচার করা হয়। এডিনবার্গ চিড়িয়াখানার বিশেষজ্ঞরা ২০১১ সালে এক ডিএনএ পরীক্ষায় নিশ্চিত করেন আঙুলটি আসলে মানুষের ছিল।
ক্রমশ হিমালয়ে ইয়েতির পায়ের ছাপ, খুলি, পশম, হাড় বা দাঁতের টুকরা ইত্যাদি পাওয়ার দাবি করেন পর্বতারোহীরা। কিন্তু অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়- এগুলো ছিল মূলত অন্যান্য পর্বতচারী জন্তু যেমন ভাল্লুক, অ্যান্টিলোপ, বানর ইত্যাদির অংশ। এই ইয়েতি কি ইতিহাস নাকি শুধুই মিথ, এটা আজও রহস্যাবৃত।
ব্যুৎপত্তিগতভাবে ইয়েতি মূলত তিব্বতি শব্দ। ইংরেজিতে যার নাম অ্যাবোমিনেবল স্নোম্যান। ইয়েতি হচ্ছে হিমালয় পর্বতমালার দুর্গম অঞ্চলে বাস করা এক শ্রেণির দ্বিপদী প্রাণী। ইয়েতি হচ্ছে হিমালয় পর্বতমালার দুর্গম অঞ্চলে বাস করা এক শ্রেণির দ্বিপদী প্রাণী।
স্নোম্যান বা তুষারমানব নাম হওয়ার কারণ ইয়েতি দেখতে অনেকটা মানুষের মতোই। রহস্যময় এই প্রাণীটির দেহ ধূসর-কালো বা লালচে-বাদামী পশমে ঢাকা, দৈহিক গঠন বলিষ্ঠ।
এখন পর্যন্ত অনেক মানুষই ইয়েতিকে দেখেছেন বলে দাবি করলেও বাস্তবে ইয়েতির কোনো সন্ধান আজ অবধি কেউ পায়নি। সেদিক থেকে বলতে গেলে ইয়েতির ধারণাটি একটি মিথ।
তবে হিমালয় অঞ্চলে অনেক সময় বিশালাকৃতির পায়ের ছাপ, শরীরের পশম ইত্যাদি পাওয়া গেলেও সেগুলোর বেশিরভাগ ছিল তুষার ভাল্লুকের। কিন্তু একই রকম কিছু আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি বলে ইয়েতির অস্তিত্ব একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
গবেষক মিরা শ্যাকলি তার স্টিল লিভিং? ইয়েতি, সাসকোয়াচ, অ্যান্ড দ্য নিয়ান্ডারথাল এনিগমা (১৯৮৩) বইতে দুজন হাইকারের ইয়েতি দর্শনের বর্ণনা দিয়েছেন।
১৯৪২ সালের কোনো একদিন ওই দুই হাইকার তাদের থেকে ‘সিকিমাইল দূরে বরফের ওপর দুটো কালো বিন্দু চলাচল করতে’ দেখেছেন। এত দূর থেকে দেখার পরেও তারা খুব স্পষ্ট বিবরণ দিয়েছিলেন: উচ্চতা একেবারে আট ফুটের কম ছিল না। চৌকো মতন মাথা। লালচে বাদামী অধোমুখী পশম।
আরেকজন ব্যক্তির দর্শনলাভের অভিজ্ঞতা মোতাবেক, ইয়েতির আকার গড়পড়তা মানুষের মতোই। মাথাভর্তি লম্বা চুল থাকলেও মুখমণ্ডল আর বুকে রোমের বালাই নেই বললেই চলে। লালচে-বাদামি দু’পেয়ে প্রাণীটি মনোযোগ দিয়ে শেকড় তুলছিল আর সময়ে সময়ে চড়া ও তীক্ষ্ণ গলায় কান্না করছিল।
পর্বতারোহী রাইনহোল্ড মেসনারের ইয়েতি দর্শনের গল্প শোনা যাক। ১৯৮৬ সালের সেদিন মেসনার একটা বিশেষ রুট ধরে চলছিলেন। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। জঙ্গুলে খাড়াই বেয়ে ওঠার সময় হঠাৎ তার সামনে বিশাল ও কালো রংয়ের কিছু একটা উদয় হলো।
বিস্মিত মেসনার দেখলেন প্রাণীটি দৌড়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। তার দৌড়ানোর ভঙ্গি মানুষের মতোই, কিন্তু স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত। গাছের শাখা-প্রশাখা বা বরফের ওপর থাকা গর্ত কিছুকেই পরোয়া করছে না। দশ গজের মতো গিয়ে প্রাণীটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ল এবং তারপরই মেসনারের চোখের সামনে হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেল।
সেদিন রাতে চাঁদের আলোয় সেটিকে আবারও দৌঁড়াতে দেখেন মেসনার। সাত ফুটের চেয়েও বেশি লম্বা, বলিষ্ঠ ও চটপটে শরীর। ছোট ছোট পা, পশমে ঢাকা দেহ আর লম্বা, শক্তিশালী হাতওয়ালা প্রাণীটি রাগত স্বরে শব্দ করছিল। সেই রাতে আবারও গাছপালার আড়ালে হারিয়ে যায় প্রাণীটি।
এদিকে, ইয়েতির অস্তিত্ব আছে বলে দাবি করেছে রাশিয়ার সাইবেরিয়া। সম্প্রতি সাইবেরিয়ান কর্তৃপক্ষ বেশ জোরের সংগেই বলছে, সাইবেরিয়ার পাহাড়গুলোতে ইয়েতির বাসা আছে। রোমশ এই পশুর অস্তিত্বের তর্কাতীত প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও তারা জানান।
দক্ষিণ সাইবেরিয়ার কেমেরোভা অঞ্চলের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানায়, একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কাছের পাহাড়ে ইয়েতির পায়ের ছাপ এবং চুলের অংশ পাওয়া গেছে।
আজাসকায়া গুহা অভিযান শেষে অভিযানকারীরা বেশ কিছু তর্কাতীত প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন। কেমেরোভো আঞ্চলিক প্রশাসন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সোরিয়া পাহাড়ই ‘বরফ মানব’দের বাসস্থল বলে সংবাদ প্রকাশ করেছে।
অভিযানকারী দলকে ইতোমধ্যেই কেমোরোভোর গভর্নর তাদের গবেষণা সম্পর্কে জানাতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং বেশ কয়েকটি দেশ ওই অভিযানকারী দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদের গবেষণা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য।
ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, অভিযানকারী দল ইয়েতিদের পায়ের চিহ্ন, তাদের সম্ভাব্য শোবার জায়গা এবং ইয়েতিদের নিজের জায়গা চিহ্নিত করার পদ্ধতিসহ অনেক চিহ্নই পেয়েছে। আর সংগৃহীত দ্রব্যাদি বিশেষ এক গবেষণাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গবেষণার জন্য। তবে তারা নিজেরা এই প্রাণীটিকে চাক্ষুষ করেছেন কিনা, সে ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি।
তবে এবার এবার বিজ্ঞানীরা ইয়েতিকে নিয়ে যাবতীয় ধোঁয়াশায় পানি ঢাললেন। জানালেন, সে আর কিছুই নয়, সামান্য ভল্লুক মাত্র। নিউ ইয়র্কের ইউনিভার্সিটি অফ বাফেলোর কলেজ অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের গবেষকদের দাবি, প্রাণীটি আসলে ভল্লুক। তাদের হাড়, দাঁত, চামড়া, চুল ও মুখের বিভিন্ন অংশ পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন তারা।
ভল্লুকগুলি তিনটি ভিন্ন প্রজাতির। এশিয়ান ব্ল্যাক, টিবেটান ব্রাউন ও হিমালয়ান ব্রাউন বিয়ার। প্রায় ৬ লক্ষ ৫০ হাজার বছর আগে হিমালয়ে এক ভয়াবহ তুষার ধস নামে। পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ব্রাউন বিয়ারের দল। আজ তারা বিক্ষিপ্তভাবে তিব্বতি হিমালয় ও ভারতীয় হিমালয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়। এদের মধ্যে হিমালয়ান ব্রাউন বিয়ার বা আরসাস আর্কটস ইসাবেলিনাস আবার বিলুপ্তপ্রায়। জানালেন গবেষক শার্লট লিন্ডকভিস্ট।
ভারত, নেপাল, ভুটান ও তিব্বতের হিমালয়ান রেঞ্জে সাধারণত এইসব ভল্লুকদের দেখা যায়। তাও খুব বেশি না। এদের অন্য প্রজাতিগুলিকে আবার বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বরফাবৃত পাহাড়ে দেখা যায়। এবং তাদেরই দৈত্যাকার হিমমানব হিসাবে গুলিয়ে ফেলেন স্থানীয় ও পর্যটকরা।
বিজ্ঞানীদের মতে, ইয়েতিদের নিয়ে প্রচুর লোককথা ও রোমহর্ষক-রোমাঞ্চকর কাহিনি প্রচলিত বিশ্বজুড়ে। তাই পাহাড়ে বেড়াতে বা সামিটে এসে যখন কেউ এরকম ভল্লুকের দেখা পান, তার সঙ্গে ওই লোককথা গুলিয়ে ফেলেন। ‘হ্যালুসিনেট’ করে বসেন। মিথকে করে তোলেন বাস্তব। আতঙ্ক ছড়ায় পারিপার্শ্বে। কিন্তু আসলে সেরকম কিছুই নয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৫৫
আপনার মতামত জানানঃ