সুমিত রায়
যারা আন্তর্জাতিক খবর দেখেন তাদের সবারই মোটামুটি রাশিয়ান-ইউক্রেনিয়ান ক্রাইসিস সম্পর্কে জানবার কথা। গতকালই খবরে দেখালো, ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ একজন অভিযুক্ত রুশ গোয়েন্দা এজেন্টকে গ্রেপ্তার করেছে। ইউক্রেনীয় সরকারের দাবি এই রুশ এজেন্ট দেশটির বৃহত্তম কৃষ্ণ-সাগরীয় বন্দর নগর ওডেসায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছিল। (রয়টার্স)।
রাশিয়া আর ইউক্রেইনের এই সংকট নতুন নয়। ২০১৪ সালের প্রথম দিকে যে ইউক্রেনীয় বিপ্লবের পর রুশ-ইউক্রেনীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এবং পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউক্রেইনে অস্থিরতা শুরু হয়েছিল। আর তার পেছনে ছিল বিভিন্ন রকমের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক ফ্যাক্টরগুলো। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ইউক্রেইনের স্বাধীনতা লাভের পর দেশটিতে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বিভেদ মাথাচাড়া দেয়, সেই সাথে দেশটির গঠন ছিল দুর্বল। এসব কারণে দেশটিতে একটি সার্বিক সংঘটিত জাতীয় পরিচয় সৃষ্টি বাধাপ্রাপ্ত হয়। পূর্বাঞ্চলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউক্রেইনে শত শত বছর ব্যাপী রুশিকরণ হয়েছে, সেখানে গড়ে উঠেছে অনেক রুশ বসতি, এর ফলে সেখানে রুশ ভাষা প্রাধান্য অর্জন করে, এমনকি সেখানে যে সব এথনিক ইউক্রেনীয় বাস করে ঐতিহাসিক রুশিফিকেশনের কারণে তাদেরও একটা বিশাল অংশ আজ রুশ ভাষাতেই কথা বলে। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা জোসেফ স্তালিন ক্রিমিয়া থেকে সেখানে বসবাসরত আদিবাসী ক্রিমিয়ান তাতারদেরকে ডিপোর্ট করেন, তার ফলে সেই ক্রিমিয়াতেও সংখ্যাগুরু হয়ে যায় এথনিক রুশরাই। এসবের ফলে পশ্চিমাঞ্চলীয় ও মধ্য ইউক্রেইনের সাথে পূর্বাঞ্চলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউক্রেইনের মধ্যে পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। পশ্চিমাঞ্চলীয় ও মধ্য ইউক্রেইন ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন রকম ক্ষমতার দ্বারা শাসিত হয়েছে – যেমন পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথ ও অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্য। এই সব অঞ্চলে ইউক্রেনীয় নৃতাত্ত্বিক, জাতীয় ও ভাষাতাত্ত্বিক পরিচয়টা অক্ষত অবস্থায় টিকে রয়েছে, যা পূর্বাঞ্চলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউক্রেইনে নেই।
এই দুটো প্রতিযোগিতাপূর্ণ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইউক্রেনীয় সংকটের সময় রাজনৈতিক ও সামাজিক সংঘাতের সৃষ্টি করে, আর এটির সূচনা ঘটে যখন তদকালীন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ ২০১৩ সালের ২১শে নভেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে একটি এসোসিয়েশন এগ্রিমেন্টে সাক্ষর করতে অসম্মত হন। পশ্চিমাঞ্চলীয় ও মধ্য ইউক্রেইনে, যেখানে ইউক্রেনীয় ভাষাতাত্ত্বিক জাতিসত্তা অক্ষত ছিল সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধনের সমর্থন শক্তিশালী, এদিকে পূর্বাঞ্চলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউক্রেইনে যেখানে রুশ ভাষাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে মানুষ রাশিয়ার সাথে শক্তিশালী সম্পর্ককে সমর্থন করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ পূর্বাঞ্চল থেকে বেশিরভাগ সমর্থন অর্জন করেছিলেন। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে জোরপূর্বক অপসারণ করা হয়েছিল। তার বিতাড়নের পর পূর্বাঞ্চলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউক্রেইনে বিদ্রোহ শুরু হয়, যে অঞ্চলগুলো রাশিয়ার সাথে ঐতিহাসিক বন্ধন ও রুশ ভাষার পক্ষে এবং ইউরোময়দান আন্দোলনের বিরুদ্ধে।
বর্তমান ইউক্রেইনের চারটি অঞ্চলে ঐতিহাসিক রুশিফিকেশন হয়, আর তার ফলে সেই অঞ্চলগুলোর জনসংখ্যার বিশাল রুশ পারসেন্টেজ দেখা যায়। এই চারটি অঞ্চল হচ্ছে ক্রিমিয়া, ডনবাস (লুহান্স্ক ওব্লাস্ট ও ডনেৎস্ক ওব্লাস্ট একত্রে), খারকিভ ওব্লাস্ট ও ওডেসা ওব্লাস্ট। এই অঞ্চলগুলোকে কেন্দ্র করেই রাশিয়া আর ইউক্রেইনের যত দ্বন্দ্ব। এর মধ্যে রাশিয়া ইতিমধ্যেই ক্রিমিয়ার ডিফ্যাক্টো শাসক, নামে ইউক্রেইনের অধীনে হলেও। আর ডনবাস নিয়ে যুদ্ধ অব্যাহতই আছে। তাই তাদের দ্বন্দ্বের সম্পর্কে জানতে হলে সবার আগে আমাদেরকে এই দ্বন্দ্বের পটভূমি হিসেবে এই চার অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। আজ তা নিয়েই লিখছি।
ক্রিমিয়া
১৭৬৮-৭৪ সালের রুশো-তুর্কি যুদ্ধের পর ১৭৭৪ সালের Küçük Kaynarca চুক্তির মাধ্যমে ১৪৪১ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের ভাসাল রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ক্রিমিয়ান খানাত স্বাধীন হয়ে যায়, এবং ১৭৮৩ সালে একে “Taurida Governorate” নাম দিয়ে রুশ সাম্রাজ্যের সাথে যুক্ত করা হয়। সংযুক্তকরণের পরবর্তী শতকগুলোতে ক্রিমিয়ার জনসংখ্যাবিন্যাসে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। রাশিয়ায় সংযুক্তকরণের পূর্বে ক্রিমিয়া মুসলিম প্রধান ছিল, সেই সাথে এখানে গ্রিক (উরুম) ও আর্মেনীয়রাও বাস করত, যাদের বেশিরভাগ খ্রিস্টান ছিল। কিন্তু রুশ সাম্রাজ্যের সাথে সংযুক্তকরণের পর রাশিয়া ক্রিমিয়া থেকে খ্রিস্টানদের চলে যেতে উৎসাহিত করে এবং চলে যাবার নির্দেশ প্রদান করে, এবং তাদেরকে Mariupol ও Nakhichevan-on-Don এর মধ্যবর্তী স্থানে আজভ সাগরের উত্তর তীরে বসতি স্থাপন করতে বলে। সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন দ্য গ্রেট তার বন্ধু ও উপদেষ্টাদেরকে ক্রিমিয়ার অনেক জায়গা দান করে, এদিকে ক্রিমিয়ার অনেক স্থানীয় অধিবাসীদেরকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয় ও ক্রিমিয়া থেকে বিতাড়িত করা হয়। এর ফলে অনেক তাতারই অটোমান নিয়ন্ত্রিত আনাতোলিয়াতে (আধুনিক তুরস্ক) পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়। একসময়কার এই তাতার উদ্বাস্তুদের আবাসস্থলে রুশ সাম্রাজ্য রুশ স্যাটলারদেরকে নিয়ে আসে। ১৯০৩ সালের জনগণনায় দেখা যায়, সেভাস্তোপোল ও ইয়েনি-কালে শহর বাদ দিলে ক্রিমিয়ার ৩৯.৭%-ই ইস্টার্ন অর্থোডক্স ধর্মের, মানে এরা ক্রিমিয়ার বাইরে থেকে আসা রুশদের বংশধর। আর দেখা যায় ক্রিমিয়ার ৪৪.৬% লোক মুশলই, মানে এরা হলো ক্রিমিয়ার আদি অধিবাসী এথনিক তাতার। আর সেভাস্তোপোল ও ইয়েনি-কেল – এই দুই এক্সক্লুডেড ও আলাদাভাবে পরিচালিত নগরদুটিতে রুশরাই সংখ্যাগুরু ছিল। এই সময়ে ক্রিমিয়াকে “রাশিয়ান রোমান্টিসিজমের হৃদয়” বলে বিবেচনা করা হত। ছুটির দিনে রুশদের জন্য ক্রিমিয়ায় বেড়াতে যাওয়া বেশ জনপ্রিয় ছিল, কারণ এখানকার জলবায়ু ছিল উষ্ণ, সেই সাথে এটি সাগরেরও তীরঘেষা ছিল।
সোভিয়েত পিরিয়ডেও ক্রিমিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সংযুক্ত ছিল। রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক (SFSR) এর অধীনে ক্রিমিয়ান অটোনমাস সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক (ASSR) হিসেবে ১৯২১ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত ক্রিমিয়ার স্বায়ত্তশাসন ছিল। সোভিয়েত জনগণনা অনুসারে ১৯২৬ সালে ক্রিমিয়ার ৪২.২% ছিল রুশ, ২৫% ছিল ক্রিমিয়ান তাতার, ১০.৮% ছিল এথনিক ইউক্রেনিয়ান, ৭% ছিল ইহুদি, এবং ১৫% ছিল অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর। সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিন ক্রিমিয়ান তাতারদের সম্পূর্ণ জনসংখ্যাকে ক্রিমিয়া থেকে ডিপোর্ট করেন এবং ১৯৪৪ সালে ক্রিমিয়ার স্বায়ত্তশাসনকে বিলুপ্ত করেন। সেই সময়ে ক্রিমিয়ান তাতার ক্রিমিয়ার জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ ছিল, এবং এদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮৩,১৫৫ জন। এদের বেশিরভাগকেই সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত মধ্য এশিয়ার মরুভূমিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই ডিপোর্টিদের প্রায় ৪৫% ডিপোর্টেশন প্রোসেসের সময় মারা যায়। ক্রিমিয়াকে রাশিয়ান SFSR এর অধীনে ক্রিমিয়ান ওব্লাস্ট বানানো হয়। এই ঘটনাগুলোর পর, ইতিহাসের প্রথমবারের মত ক্রিমিয়ার জনসংখ্যায় এথনিক রুশরা সংখ্যাগুরু হয়ে ওঠে।
সোভিয়েত প্রিমিয়ার নিকিতা ক্রুশ্চেভ ১৯৫৪ সালে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ান SFSR থেকে ইউক্রেনিয়ান SSR-এ স্থানান্তরিত করেন। এই ঘটনায় ক্রিমিয়ার জনগণের তেমন সায় ছিল না, এবং একে একটি মূল্যহীন “প্রতীকী ব্যঞ্জনা” হিসেবে দেখা হয়েছিল, কারণ উভয় রিপাবলিকই সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, এবং এদেরকে মস্কোর সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের কিছু পূর্বে ১৯৯১ সালের গণভোটে ক্রিমিয়ার স্বায়ত্তশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৯১ সালের ১ ডিসেম্বরে একটি গণভোটের মাধ্যমে ইউক্রেইনের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়। এই গণভোটে ৫৪% ক্রিমিয়ান ভোটার সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতাকে সমর্থন করেছিল। এরপর ১৯৯২ সালে ক্রিমিয়া ইউক্রেইন থেকে স্বাধীন হবে কিনা সেই বিষয়ে ক্রিমিয়ান সংসদে একটি ভোট হয়। এরপর ক্রিমিয়ার স্ট্যাটাস নিয়ে একটি দুই বছরের সংকট শুরু হয়। একই সময়ে, সুপ্রিম সোভিয়েত অফ রাশিয়া ক্রিমিয়াকে ইউক্রেইনের কাছে সমর্পনকে বাতিল করায় ভোট দেয়। একই বছরের জুনে কিয়েভে ইউক্রেনীয় সরকার ক্রিমিয়াকে বিশাল আকারে স্বায়ত্তশাসন প্রদানে ভোট দান করে, এবং একে ইউক্রেইনের অধীনে অটোনোমাস রিপাবলিক অফ ক্রিমিয়া হিসেবে স্বীকার করে। এরপরও ক্রিমিয়ান সরকার, রাশিয়ান সরকার ও ইউক্রেনীয় সরকারের মধ্যে লড়াই চলতে থাকে। ১৯৯৪ সালে রাশিয়ান জাতীয়তাবাদী ইউরি মেশকভ ১৯৯৪ সালের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে জয়লাভ করেন, এবং ক্রিমিয়ার স্যাটাসের ওপর পূর্বে অনুমোদিত গণভোটটি কার্যকর করেন। গণভোটে ১.৩ মিলিয়ন লোক ভোট দিয়েছিল, এবং এদের মধ্যে ৭৮.৪% ইউক্রেইন থেকে ক্রিমিয়ার গ্রেটার অটোনমি সমর্থন করে, এবং ৮২.৮% ডুয়েল রাশিয়ান-ইউক্রেনিয়ান নাগরিকত্ব চায়। সেই বছরের পরের দিকে, রাশিয়া ক্রিমিয়াকে ইউক্রেইনের অংশ হিসেবে স্বীকার করে নেয়, এবং বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডামে দেশটি ইউক্রেইনের টেরিটোরিয়াল ইন্টিগ্রিটি রক্ষায় অঙ্গীকার করে। এই ট্রিটিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স দ্বারাও স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯৫ সালে ইউক্রেইন ক্রিমিয়ার সংবিধান বাতিল করে এবং ক্রিমিয়ার প্রেসিডেন্টের অফিস বিলুপ্ত করে। ক্রিমিয়াকে ১৯৯৮ সালে একটি নতুন সংবিধান দেয়া হয়, যেখানে একে পূর্বের থেকে কম স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়। ক্রিমিয়ান অফিশিয়ালরা পরে তাদের পূর্বের সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতার প্রতিস্থাপন দাবি করে। ১৯৯০ এর দশকের পুরোটা জুড়ে অনেক ক্রিমিয়ান তাতার ডিপোর্টি ও তাদের উত্তরসুরিরা ক্রিমিয়ায় ফিরে আসে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পর রাশিয়া-ইউক্রেইন সম্পর্কের একটি অন্যতম টানাপোড়েন হচ্ছে ব্ল্যাক সি ফ্লিটের স্ট্যাটাস, যা সেভাস্তোপোল-ভিত্তিক। ১৯৯৭ সালের রুশো-ইউক্রেনিয়ান পার্টিশন ট্রিটি দ্বারা ক্রিমিয়ার মিলিটারি বেস ও ভেসেলগুলোর অধিকার নির্ধারিত হয়, এবং রাশিয়াকে ক্রিমিয়ায় ২৫ হাজার সেনা, ২৪টি আর্টিলারি সিস্টেম (১০০ মিমি এর ছোট ক্যালিবারের), ১৩২ আরমারড ভেহিকল, ২২ মিলিটারি এরোপ্লেইনের অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১০ স্লাএ ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ এই ট্রিটি সম্প্রসারিত করেন। এই নতুন চুক্তি অনুসারে, রাশিয়াকে ২০৪২ সাল পর্যন্ত ক্রিমিয়ায় ব্ল্যাক সি ফ্লিটে সেনাঘাটি তৈরি করার অনুমোদন দেয়া হয়। ২০০৬ সালের জুন থেকে ক্রিমিয়ান নগর ফিওডোসিয়ার অধিবাসীরা মার্কিন নৌজাহাজ “এডভান্টেজ” এর ডকিং এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহীরা এন্টি-ন্যাটো স্লোগান সহ সাইন বহন করে, এবং ন্যাটো-এফিলিয়েটেড সেনাকে অনধিকার প্রবেশ হিসেবে বিবেচনা করে। ইউক্রেইনের কোন কোন কমেন্টেটর এই বিদ্রোহকে রুশ পরিচালিত হিসেবে দেখেন।
২০১০ সালের ক্রিমিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচনে পার্টি অফ রেজিয়ন্স সবচেয়ে বেশি ভোট পায়, দ্বিতীয় স্থানে থাকা কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইউক্রেইন তুলনামূলক কম ভোট পায়। পরে উভয় পার্টিই ইউরোময়দান আন্দোলনের টার্গেটে পরিণত হয়। ক্রিমিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইউরি ওলেক্সান্দ্রোভিচ মেশকভ ২০১১ সালের জুলাইতে ১৯৯২ সালের সংবিধান পুনঃস্থাপন করার একটি গণভোট ডাকেন। এর ফলে, ক্রিমিয়ার একটি স্থানীয় কোর্ট মেশকভকে ৫ বছরের জন্য ইউক্রেইন থেকে ডিপোর্ট করে।
২০০১ সালের ইউক্রেনীয় জনগণনা অনুসারে, ক্রিমিয়ার ৫৮.৫% হলো এথনিক রাশিয়ান। এরপর দুটো বৃহত্তম এথনিক গ্রুপ হলো ২৪% ইউক্রেনীয় ও ১০.২% ক্রিমিয়ান তাতার। অন্যান্য মাইনোরিটি এথনিক গ্রুপগুলোর মধ্যে রয়েছে বেলারুশীয় ও আর্মেনীয়। এই জনসংখ্যার ৭৭% রিপোর্ট করে যে তাদের নেটিভ ভাষা হচ্ছে রুশ, ১১.৪% বলে তাতার, ও ১০.১% বলে ইউক্রেনিয়ান।
ডনবাস (লুহান্স্ক ও ডনেৎস্ক একত্রে)
ডনবাস বা ডনেট বেসিন হচ্ছে একটি অঞ্চল যা আজ ইউক্রেইনের ডনেতস্ক ও লুহানস্ক ওব্লাস্ট নিয়ে গঠিত। পূর্বে এটি “ওয়াইল্ড ফিল্ডস” হিসেবে পরিচিত ছিল। যে অঞ্চলটিকে এখন ডনবাস বলা হয় তা মূলত ১৮শ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ইউক্রেনীয় কসাক হেটমানাট এবং তুর্কি ক্রিমিয়ান খানাতের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এরপর রুশ সাম্রাজ্য হেটমানেট জয় করে এবং খানাত দখল করে। বিজিত অঞ্চলগুলোর নাম দেয়া হয় “নতুন রাশিয়া” (নভোরোসিয়া)। ইউরোপ জুড়ে শিল্প বিপ্লবের প্রসারের সাথে সাথে ১৯শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ডনবাসের বিশাল কয়লা সম্পদ শোষণ করা শুরু হয়। এর ফলে এই অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়, আর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় মূলত রুশ বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা। ১৮৫৮ সালে এই অঞ্চলের জনসংখ্যা ছিল ৭,০০,৭৬৭ জন। ১৮৯৭ সালের মধ্যে তা ১,৪৫৩,১০৯-এ পৌঁছে যায়। ১৮৯৭ সালের রুশ ইম্পেরিয়াল আদমশুমারি বা জনগণনা অনুযায়ী, এই অঞ্চলে এথনিক ইউক্রেনীয় ছিল ৫২.৪%, আর এথনিক রুশ ছিল ২৮.৭%। এথনিক গ্রিক, জার্মান, ইহুদি ও তাতারদেরও ডনবাসে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল, বিশেষ করে মারিয়াপোল জেলায়, যেখানে তারা জনসংখ্যার ৩৬.৭% নিয়ে গঠিত ছিল। তা সত্ত্বেও রুশরা শিল্প কর্মশক্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ গঠন করে। ইউক্রেনীয়রা গ্রামাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করত, কিন্তু শহরগুলিতে প্রায়শই শুধুমাত্র রুশরা বাস করত যারা এই অঞ্চলের ভারী শিল্পে কাজ চাইতে এসেছিল। যে এথনিক ইউক্রেনীয়রা কাজের জন্য শহরে চলে গিয়েছিল তাদের দ্রুত রুশভাষী শ্রমিক শ্রেণীতে আত্মীকৃত হয়।
১৯১৭-২২ সালের রুশ বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ইউক্রেনীয়দের অধ্যুষিত অন্যান্য অঞ্চলগুলির মতো ডনবাসকেও ইউক্রেনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে (Ukrainian Soviet Socialist Republic) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ডনবাসে ইউক্রেনীয়রা ১৯৩২-৩৩ সালের হোলোডোমোর দুর্ভিক্ষ এবং জোসেফ স্ট্যালিনের রুসিফিকেশন নীতি দ্বারা ব্যাপকভাবে ভুক্তভোগী হয়েছিল। যেহেতু বেশিরভাগ এথনিক ইউক্রেনীয়রা সোভিয়েত শাসকদের দ্বারা শাসিত গ্রামীণ কৃষক (যাকে “কুলাক”বলা হয়) ছিল, তারা দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছিল। গ্রেট ব্রিটেনের ইউক্রেনীয়দের সংগঠন অনুসারে, দুর্ভিক্ষের ফলে এখন লুহানস্ক ওব্লাস্ট এলাকার জনসংখ্যা ২৫% ও ডোনেৎস্ক ওব্লাস্ট এলাকায় এটি ১৫-২০% হ্রাস পেয়েছে। একটি হিসাব অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় এসএসআর-এ দুর্ভিক্ষের সময় যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে ৮১.৩% ছিল এথনিক ইউক্রেনীয়, যেখানে মাত্র ৪.৫% ছিল এথনিক রুশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ডনবাস পুনর্গঠনের সময় অনেক রুশ শ্রমিক এই অঞ্চলকে পুনরায় জনবসতিপূর্ণ করতে আসে, যা জনসংখ্যার ভারসাম্যকে আরও পরিবর্তন করে। ১৯২৬ সালে ৬,৩৯,০০০ জাতিগত রুশ ডনবাসে বসবাস করে। ১৯৫৯ সালের মধ্যে জাতিগত রুশ জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ২.৫৫ মিলিয়নে উন্নীত হয়। ১৯৫৮-৫৯ সালের সোভিয়েত শিক্ষাগত সংস্কারের মাধ্যমে রুসিফিকেশন আরও বৃদ্ধি পায়, যার ফলে ডনবাসে সমস্ত ইউক্রেনীয় ভাষাশিক্ষা প্রায় নির্মূল হয়ে যায়। ১৯৮৯ সালের সোভিয়ে জনগণনার সময় পর্যন্ত ডনবাসের জনসংখ্যার ৪৫% তাদের জাতিসত্তাকে রুশ বলে রিপোর্ট করে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর, ডনবাসের অধিবাসীরা সাধারণত ইউক্রেনের বাকি অংশের বিপরীতে রাশিয়ার সাথে শক্তিশালী সম্পর্কের পক্ষে ছিল। ১৯৯৩ সালে এই অঞ্চলের খনি শ্রমিকদের ধর্মঘটের ফলে যুক্তরাষ্ট্রীয় ইউক্রেন এবং ডনবাসের অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের আহ্বান জানানো হয়। এরপর ১৯৯৪ সালে স্বাধীন ইউক্রেনের প্রথম সংসদ নির্বাচনের সাথে সাথে ডোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক ওব্লাস্টের বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রশ্নের উপর পরামর্শমূলক গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে ছিল রুশ ভাষাকে ইউক্রেনের একটি সরকারী ভাষা হিসেবে উল্লেখ করা উচিত কিনা, ডোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক ওব্লাস্টগুলিতে রুশ ভাষাকে প্রশাসনের ভাষার মর্যাদা দেয়া উচিত কিনা, ইউক্রেনের যুক্তরাষ্ট্রীয়করণ করা উচিত কিনা এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের কমনওয়েলথের সাথে ইউক্রেনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা উচিত কিনা। প্রায় ৯০% ভোটার এই প্রস্তাবগুলোর পক্ষে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু তাদের কোন দাবিই গৃহীত হয়নি, ইউক্রেন একটি একক রাষ্ট্রহিসেবে থেকে যায়, ইউক্রেনীয়কে একমাত্র সরকারী ভাষা হিসেবে ধরে রাখা হয় এবং ডনবাস কোন স্বায়ত্তশাসন অর্জন করে না। ২০০৪ সালের কমলা বিপ্লব পর্যন্ত ইউক্রেনীয় রাজনীতিতে ডনবাসের ভোটার এবং রাজনীতিবিদদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ (যিনি সেই বিপ্লবের লক্ষ্য ছিলেন) ডনবাসের লোক ছিলেন এবং সেখানে তিনি বেশিরভাগ সমর্থনও পেয়েছেন। বিপ্লবের শীর্ষ সময়ে ডনবাসে ইয়ানুকোভিচপন্থী আঞ্চলিক রাজনীতিবিদরা “দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র” (“South-East Ukrainian Autonomous Republic”) প্রতিষ্ঠার বিষয়ে অথবা ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য গণভোটের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু এটি ঘটেনি। এদিকে ইয়ানুকোভিচের পার্টি অফ রিজিওনস ২০০৬ সালের ইউক্রেনীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে। পরে তিনি ২০১০ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রী মাইকোলা আজরভের নেতৃত্বে তার সরকার ২০১২ সালে একটি বিতর্কিত আঞ্চলিক ভাষা আইন বাস্তবায়ন করে। এই আইন কোন ভাষাকে “আঞ্চলিক ভাষা” এর মর্যাদা প্রদান করে যদি ভাষাটির এথনিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের শতকরা হার একটি প্রদত্ত প্রশাসনিক জেলার মোট জনসংখ্যার ১০% ছাড়িয়ে যায়। আঞ্চলিক ভাষার মর্যাদা ইউক্রেনের এই অঞ্চলগুলিতে আদালত, স্কুল এবং অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘু ভাষা ব্যবহারের অনুমতি দেয়। এর ফলে রুশ ভাষা ইউক্রেনীয় স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো ডনবাসে স্বীকৃতি লাভ করে।
২০০১ সালের ইউক্রেনীয় জনগণনা অনুসারে, ডনবাসের জনসংখ্যার ৫৭.২% এথনিক ইউক্রেনীয়, ৩৮.৫% এথনিক রুশ এবং ৪.৩% অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, যারা প্রধানত গ্রিক (১.১%) এবং বেলারুশীয় (০.৯%)। জনসংখ্যার ৭২.৮% তাদের মাতৃভাষা রুশ ও ২৬.১% ইউক্রেনীয় বলে রিপোর্ট করেছে। মূলত সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী দ্বারা কথিত অন্যান্য ভাষায় কথা বলে জনসংখ্যার মাত্র ১.১%। এই দলগুলোর মধ্যে, শুধুমাত্র রোমারা দৈনন্দিন জীবনে রুশ ভাষা ব্যবহার না করে রোমানি ভাষা ব্যবহার করে বলা হয়েছিল।
খারকিভ ওব্লাস্ট
আগে এই অঞ্চলটি একটি স্বল্প জনবসতিপূর্ণ অঞ্চল ছিল। পরে ১৬৪৮-৫৭ সালে পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথের বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয় কসাকদের খ্মেলনিৎস্কি বিদ্রোহের সময় নিপার নদীর কাছে এই দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষ থেকে বাঁচতে বিপুল সংখ্যক জাতিগত ইউক্রেনীয় বসতিস্থাপনকারীরা এই অঞ্চলে পালিয়ে আসে। তারা যে অঞ্চলে বসতিস্থাপন করে তার নাম দেয়া হয় স্লোবোদা ইউক্রেইন (Sloboda Ukraine)। পরের শতকগুলোতে এখানে জাতিগত ইউক্রেনীয় ও জাতিগত রুশদের অনেকগুলো ওয়েভের মাইগ্রেশন ঘটে। এই অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসিত কজাক সরকার ছিল, কিন্তু পরে রুশ সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন দ্য গ্রেট ১৭৬৫ সালে সেই সরকারের বিলুপ্তি ঘটান। ১৮৩২ সালের মধ্যে, রুশ ও ইউক্রেনীয়দের মধ্যে শহুরে-গ্রামীণ বিভাজন দৃঢ়ভাবে গেঁথে যায়, ৫০% বণিক ও কারখানার মালিকদের ৪৫% জাতিগত রুশ ছিল। সেখানে রুশিফিকেশন বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৮৩৫ সালে স্লোবোদা ইউক্রেইনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় খারকভ গভার্নরেট। কৃষি-অধ্যুষিত খারকিভে জাতিগত রুশদের সংখ্যা কখনই শিল্প-সমৃদ্ধ ডনবাসের মতো অত বেশি ছিলনা, আর এই অঞ্চলটিতে সর্বদাই একটি স্বতন্ত্র ইউক্রেনীয় সংস্কৃতি বজায় রাখে। এটি ১৮৯৭ সালের ইম্পেরিয়াল সেন্সাস বা জনগণনা দ্বারা এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, যেখানে খারকভ গভর্নরেটের জনসংখ্যার ৮০.৬% লোকের নেটিভ ভাষা ছিল ইউক্রেনীয়, আর ১৭.৭% জনসংখ্যার নেটিভ ভাষা ছিল রুশ। ১৯২২ সালে খারকিভ শহর ইউক্রেনীয় এসএসআরের রাজধানী হয়ে ওঠে। ১৯৩২-৩৩ সালের হোলোডোমোর দুর্ভিক্ষের (Holodomor famine) সময় খারকিভ ওব্লাস্টের জাতিগত ইউক্রেনীয় অধ্যুষিত গ্রামাঞ্চলগুলো বিধ্বস্ত হয়। একই সময়ে, খারকিভ শহর ব্যাপকভাবে শিল্পোৎশিল্পিত হয়ে ওঠে, এবং এর জাতিগত রুশ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৯ সালের সোভিয়েত জনগণনার সময় পর্যন্ত খারকিভ ওব্লাস্টের জনসংখ্যার ৩৩.২% জাতিগত রুশ হিসেবে চিহ্নিত হয় এবং জনসংখ্যার ৪৮.১% রিপোর্ট করে যে তাদের মাতৃভাষা রুশ। ২০০১ সালের ইউক্রেনীয় জনগণোনা অনুসারে, খারকিভ ওব্লাস্টের জনসংখ্যার ৭০.৭% জাতিগত ইউক্রেনীয় ও ২৫.৬% জাতিগত রুশ। খারকিভ ওব্লাস্টে উপস্থিত অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে আর্মেনিয়ান, ইহুদি এবং বেলারুশীয়। জনসংখ্যার ৫৩.৮% এর মাতৃভাষা ইউক্রেনীয়, আর ৪৪.৩% এর মাতৃভাষা রুশ।
ওডেসা ওব্লাস্ট
১৫৯৩ সালে অটোমান সাম্রাজ্য বর্তমান ওডেসা ওব্লাস্ট এলাকা জয় করে এবং এটিকে ওজু ইয়ালেট (Özü Eyalet) এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে, যা অনানুষ্ঠানিকভাবে খান ইউক্রেন (Khan Ukraine) নামে পরিচিত ছিল। ১৭৮৭-৯২ সালের রুশো-তুর্কি যুদ্ধের পর জাসি চুক্তির (Treaty of Jassy) মাধ্যমে ইয়েদিসানকে (যার অঞ্চল মোটামুটিভাবে আধুনিক ওডেসা শহরের মিলে যায়) অটোমান সাম্রাজ্য রুশ সাম্রাজ্যকে ছেড়ে দেয়। নোগাই তাতারদের বহিষ্কারের পর ১৭৯৩ সালে পরিচালিত ইয়েদিসান অঞ্চলের প্রথম রুশ সাম্রাজ্যের সেন্সাস বা জনগণনা সম্পন্ন হয়। সেটি অনুসারে নিস্টার নদী এবং দক্ষিণ বাগ নদীর মধ্যবর্তী ৬৭টি গ্রামের মধ্যে ৩৯টি গ্রাম জাতিগতভাবে রোমানিয়ান ছিল (এই রোমানিয়ানদের মোল্ডাভিয়ানও বলা হয়)। পরবর্তীতে, জাতিগত রুশরা এই অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করে এবং অনেক নতুন শহর ও বন্দর স্থাপন করে। ১৮১৯ সালে ওডেসা শহর একটি মুক্ত বন্দরে পরিণত হয়। এটি একটি খুব বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যার বাসস্থান ছিল, এবং কৃষ্ণ সাগর ব্যবসায়ী বা ব্ল্যাক সি ট্রেডাররা প্রায়শই এখানে আসত। এক শতাব্দীরও কম সময়ের মধ্যে, ওডেসা শহর একটি ছোট দুর্গ থেকে নিউ রাশিয়া অঞ্চলের বৃহত্তম শহরে পরিণত হয়। ১৮৯৭ সালের ইম্পেরিয়াল আদমশুমারির সময় আধুনিক ওডেসা ওব্লাস্টের তদকালিন আনুমানিক এলাকার জনসংখ্যা ছিল ১,১১৫,৯৪৯ জন। সেই জনগণনা অনুযায়ী, জনসংখ্যার ৩৩.৯% ছিল জাতিগত ইউক্রেনীয়, ২৬.৭% ছিল জাতিগত রুশ, ১৬.১% ছিল জাতিগত ইহুদি, ৯.২% ছিল জাতিগত মোল্ডাভিয়ান, ৮.৬% ছিল জাতিগত জার্মান, ২% ছিল জাতিগত পোলিশ, এবং ১.৬% ছিল জাতিগত বুলগেরীয়। এই সংখ্যাগুলি দেখায় যে এই অঞ্চলে উচ্চ মাত্রার জাতিগত বৈচিত্র্য ছিল, এবং কোনও গোষ্ঠীরই প্রত্যক্ষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। ইউক্রেনীয় এসএসআর-এর প্রথম দিকে, ওডেসা গভর্নরেট প্রাক্তন খেরসন গভর্নরেটের কিছু অংশ নিয়ে থেকে গঠিত হয়েছিল। এই নতুন অঞ্চলটিই আধুনিক ওডেসা ওব্লাস্টের ভিত্তি তৈরি করেছিল। আন্তঃযুদ্ধ কাল জুড়ে, বুদজাক (Budjak) রোমানিয়া রাজ্যের অংশ ছিল। ১৯৩২-৩৩ সালের হোলোডোমোর দুর্ভিক্ষ (Holodomor famine) এই অঞ্চলে গভীর জনসংখ্যাগত প্রভাব ফেলেছিল। দুর্ভিক্ষের ফলে জনসংখ্যা ১৫-২০% হ্রাস পায়। প্রায় এক দশক পরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিরা ইউক্রেন দখল করে, এর ফলে এই অঞ্চলে পূর্বে যে বিশাল সংখ্যায় ইহুদিরা বাস করত, তারা এর ফলে বিপন্ন হয়ে যায়। সেই সাথে যুদ্ধের সময়, জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময় বুদজাক অঞ্চলটি ইজমিল ওব্লাস্ট হিসেবে ইউক্রেনিয়ান এসএসআর-এ যুক্ত হয়। ১৯৫৪ সালে এটিকে ওডেসা ওব্লাস্টের সাথে যুক্ত করা হয়। ১৯৮৯ সালের সোভিয়েত জনগণনার সময় পর্যন্ত ওডেসা ওব্লাস্টের জনসংখ্যার ২৭.৪% নিজেদের জাতিগত রুশ হিসেবে পরিচয় দেয়, যখন ৫৫.২% নিজেদের জাতিগত ইউক্রেনীয় হিসেবে পরিচয় দেয়। অবশিষ্টাংশ জনসংখ্যার বেশিরভাগ মোল্ডাভিয়ান, বুলগেরিয়ান এবং গাগাউজদের দিয়ে গঠিত ছিল। ২০০১ সালের ইউক্রেনীয় জনগণনা অনুসারে, জাতিগত ইউক্রেনীয়রা ওডেসা ওব্লাস্টের জনসংখ্যার ৬২.৮% নিয়ে গঠিত, যেখানে জাতিগত রুশরা ২০.৭% নিয়ে গঠিত। বুদজাকের ঐতিহাসিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে উল্লেখযোগ্য বুলগেরিয়ান এবং মোল্ডাভিয়ান সম্প্রদায় উপস্থিত রয়েছে। এরা যথাক্রমে ওডেসা ওব্লাস্টের জনসংখ্যার ৬.১% এবং ৫%। জনসংখ্যার ৪৬.৩% এর মাতৃভাষা ইউক্রেনীয়, ৪১.৯% এর মাতৃভাষা রুশ, ১১.৮% অন্যান্য ভাষায় কথা বলে যাদের বেশিরভাগই বুলগেরিয়ান এবং মোল্ডাভিয়ান ভাষাভাষী।
সূত্র – উইকিপিডিয়া নিবন্ধ Historical background of the Russo-Ukrainian War, History of Crimea, Donbas, Odessa, Kharkiv Oblast,
আপনার মতামত জানানঃ