কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতসহ নানা প্রয়োজনে গণপরিবহন মানুষের নিত্য অনুষঙ্গ। কিন্তু সেই গণপরিবহনই এখন হয়ে উঠেছে ঘাতকের আরেক নাম। প্রতিদিনই কাড়ছে প্রাণ, মেরে ফেলছে স্বপ্ন। নিঃস্ব করছে বহু পরিবারকে।
দেশের কর্মক্ষম ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন। এর প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক যে ক্ষতি হচ্ছে, তার হিসাব তৈরি করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব বলছে, গত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় এমন ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা।
কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা যদি নির্ভরশীল মানুষের তুলনায় বেশি হয়, তাহলে সেটিকে জনসংখ্যা বোনাস বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। বাংলাদেশ এ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের জন্য গর্ব করে। সড়ক দুর্ঘটনা এ গর্বের জায়গাতেই বেশি আঘাত হানছে।
পুলিশের তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণ করে এআরআই বলছে, গত এক দশকে দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। আর দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের সাড়ে ১৮ শতাংশ শিশু। এদের বয়স ১৫ বছরের নিচে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের সড়ক দুর্ঘটনাসংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, সড়ক দুর্ঘটনায় সারা বিশ্বে বছরে সাড়ে ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে ৩০ শতাংশের বয়স ২৫ বছরের কম। বিশ্বে তরুণেরা যেসব কারণে বেশি হতাহত হন, এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা সবার শীর্ষে। এ প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর প্রাণহানি হয় ২৫ হাজার মানুষের।
সরকারিভাবে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্যের প্রাথমিক উৎস হচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশের তথ্য ধরে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করে বুয়েটের এআরআই।
এআরআই বলছে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ২০৪টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে ৩ হাজার ৭৭৬ জনের। আহত ৪ হাজার ১০৮ জন। দুর্ঘটনায় হতাহত এবং তাদের পরিবারের আর্থসামাজিক ক্ষতি, চিকিৎসা খরচ ধরে গত বছর দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৮ হাজার ৪৪ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৪৪ শতাংশের সমান।
২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৪টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয় ৩ হাজার ৫৫৮ জন এবং আহত ৪ হাজার ৪৫০ জন। ওই বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩২ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ২০ শতাংশের সমান।
এআরআইয়ের গবেষক ও পুলিশ সূত্র বলছে, গত দুই বছর করোনা মহামারির কারণে দেশে প্রায় দেড় শ দিন গণপরিবহন চলাচল বন্ধ ছিল। এ ছাড়া ছিল বিধিনিষেধ। ফলে এ দুই বছরের সড়ক দুর্ঘটনার যে হিসাব এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ, তা স্বাভাবিক সময় হলে আরও বাড়ত।
সড়কে একের পর এক প্রাণ হারালেও দু-একটি ঘটনা ছাড়া কোনোটিরই কখনও কোনো বিচার হয়নি। একইভাবে কেউ ক্ষতিপূরণও পাননি। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর্মক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পথে বসেছে পরিবারগুলো। যারা আহত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থেকে মারা গেছেন বা পঙ্গু হয়ে গেছেন, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে তাদের পরিবারও হয়ে গেছে নিঃস্ব। কিন্তু সড়ক নিরাপদ করতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি, বরং নানা প্রশ্রয়ে দিন দিন বেপরোয়া থেকে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন পরিবহন মালিক, চালক ও শ্রমিকরা।
সড়কে একের পর এক প্রাণ হারালেও দু-একটি ঘটনা ছাড়া কোনোটিরই কখনও কোনো বিচার হয়নি। একইভাবে কেউ ক্ষতিপূরণও পাননি। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর্মক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পথে বসেছে পরিবারগুলো।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ২০১৭ সালে প্রকাশ করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় একজন কর্মক্ষম ব্যক্তির প্রাণ হারানোর কারণে ২৪ লাখ ৬২ হাজার ১০৬ টাকার ক্ষতি হয়। তবে এর সঙ্গে দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির পরিবারের অন্যদের অর্থনৈতিক চাপ, কর্মক্ষেত্রের ক্ষতিসহ অন্যান্য বিষয় আমলে নেওয়া হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) যৌথভাবে ২০১৬ সালে একটি জরিপ করেছিল। এ জরিপে দেখানো হয়, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ আহত হয়। দিনে আহত হয় ৯ হাজারের বেশি। প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮০ হাজার মানুষ প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। এর মধ্যে ১২ হাজারের বেশি ১৭ বছরের কম বয়সী শিশু। এ হিসাবে দেখা যায়, প্রতিদিন ২২০ জন মানুষ প্রতিবন্ধী হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়।
বিশ্বব্যাংকের মতে, উচ্চ আয়ের দেশগুলোর তুলনায় নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার তিনগুণ বেশি। এসব কারণে দেশে সেবছর ১১ হাজার ৬৩০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে বলে জানায় তারা। সে বছর সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে বাংলাদেশের জিডিপির ৫.৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও উল্লেখ করে তারা।
বাংলাদেশের আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে শাস্তি হওয়ার নজির খুব কম। নেই বিমাব্যবস্থা। ফলে একটি দুর্ঘটনা যেকোনো পরিবারকে বিপর্যস্ত করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আগের মোটরযান আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে ২০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা ছিল। ২০১৯ সালে নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করেছে সরকার। এতে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের সহায়তায় আর্থিক তহবিল গঠনের কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সেই তহবিল গঠন করেনি সরকার।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনকে সঠিকভাবে কার্যকরের বিকল্প কিছু নেই। আমাদের নিজেদের স্বার্থে সড়কে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর যেন একটি মূল্যবান প্রাণও সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে না যায়। একজন মায়ের বুকও যেন খালি না হয়। একজন নারীও যেন বিধবা না হয়। কোনো সন্তান যেন এতিম না হয়। আমাদের যেমন নিরাপদ সড়ক পাওয়ার অধিকার আছে, তেমন কিছু কর্তব্যও আছে। পথচারী, মালিক, চালক, হেলপার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজ নিজ জায়গায় থেকে সৎভাবে কর্তব্যগুলো পালন করে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াল অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারি। নিজ দায়িত্বে সচেতন হয়ে সুস্থ থাকি, অন্যকে এবং পরিবারকে নিরাপদ রাখি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবতা হচ্ছে সড়কে প্রাণ যাওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না। সরকারের নানা বিভাগ, একেকজন একেক দিকে। কেউ সঠিক ভাবনা ভাবছে না। তাই যা হবার তাই হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুই যেন আমাদের নিয়তি হয়ে উঠছে। সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে হলে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া চালক ও বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে আনা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা পরাবে কে?
তারা বলেন, দিনের পর দিন এ অবস্থা তো চলতে পারে না। এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র মুখ বন্ধ করে থাকতে পারে না। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। সড়ক দুর্ঘটনার মূল অনুষঙ্গ বেপরোয়া গতি। চালকেরা বেপরোয়া গতিতে এবং একের পর এক পাল্লা দিয়ে যান চালানোর কারণেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে।
তারা বলেন, মহাসড়কে গড়ে প্রতি মিনিট পরপর একটি গাড়ি আরেকটি গাড়িকে ওভারটেকিংএর চেষ্টা করে। একটি গাড়ি আরেকটি গাড়িকে পাশ কাটাতে গেলেই দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়। এটি প্রতিরোধে মহাসড়কে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। সড়কে শৃঙ্খলা নেই বলেই দুর্ঘটনা। আর সরকারের পক্ষ থেকে শৃঙ্খলা আনার উদ্যোগও খুব একটা চোখে পড়ে না। সড়ক নিরাপত্তা শুধু মুখেমুখেই। বাস্তবে কর্মসূচি নেই বললেই চলে।
তারা বলেন, আইন না মানাই হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ। এ ক্ষেত্রে সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশসহ চলমান প্রশাসন এ আইন প্রয়োগে ব্যর্থ হলে প্রয়োজনে তাদের ঢেলে সাজাতে হবে, অন্যথায় নতুন করে দুর্ঘটনা রোধে বিশেষ বাহিনী গঠন করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৩
আপনার মতামত জানানঃ