নারী নির্যাতনে চতুর্থ বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে শিশু নির্যাতনের চিত্র উঠে আসছে। এর বাইরেও নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। নিরপরাধ শিশুরা শিকার হচ্ছে খুন, ধর্ষণ কিংবা ভয়াবহ নির্যাতনের। এসব ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দৃষ্টান্ত খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় না। অনেক সময় ভোক্তভোগী আইনের আশ্রয় নিলেও অপরাধী ফাঁকফোকরে ছাড়া পেয়ে যায়। করোনা মহামারিতে মানুষ যখন বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে, তখনও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ নেই বরং বেড়েছে।
শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও শিশুদের জনসমাগমের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ৮১৮টি শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ৯৪টি শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৪ জন মেয়েশিশুকে।
এ সময়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১১০টি শিশু। তার আগের বছর ২০২০ সালে শিশুধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৬২৬টি।
আজ মঙ্গলবার অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি ২০২১’ শিরোনামে শিশু বিষয়ক সংবাদের আধেয়-বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপস্থাপন করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)।
ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের শিশুদের সার্বিক পরিস্থিতি সার্বিকভাবে উদ্বেগজনক বলে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক পর্যালোচনায় উঠে এসেছে।
দেশের ৫টি বাংলা দৈনিক ও ৩টি জাতীয় ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত শিশু অধিকার বিষয়ক সংবাদ পর্যালোচনা করে এই তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত এক বছরে দেশে আত্মহত্যা করেছে ৭৮টি শিশু। তাদের মধ্যে ছেলে শিশু ৫৭ ও কন্যা শিশু ২১টি। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৪ জন এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করতে গিয়ে আহত হয়েছে ২৩ জন।
আত্মহত্যার কারণ হিসেবে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন চিহ্নিত করেছে পরীক্ষায় খারাপ ফল, পরিবারের ওপর রাগ, প্রেম, উত্যক্ত ও ধর্ষণ বা ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হওয়া, শ্লীলতাহানির বিচার না পাওয়া এবং সাইবার ক্রাইম ও ব্ল্যাকমেইলের শিকার হওয়াকে।
২০২১ সালে বিভিন্ন কারণে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ১৮৩টি শিশু এবং হত্যা চেষ্টা করা হয়েছে ১৩৫ শিশুকে। ২০২০ সালে হত্যার শিকার হয়েছিল ১৪৫টি শিশু।
অবশ্য সড়কে শিশু মৃত্যু কমেছে। গেল বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৬৯টি শিশু। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৫৮।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বলছে, ‘বাংলাদেশের শিশুরা তাদের ঘরেই নিরাপদ নয়। অধিকাংশ শিশু ধর্ষণ পারিবারিক পরিবেশে পরিচিতদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে।’
প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানটি আরও জানিয়েছে, প্রতিবেশীদের হাতেও শিশুদের একটি বড় অংশ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার হওয়া শিশুদের বয়স কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ২ বছর।
‘বাংলাদেশের শিশুরা তাদের ঘরেই নিরাপদ নয়। অধিকাংশ শিশু ধর্ষণ পারিবারিক পরিবেশে পরিচিতদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে।’
বলা হয়, খেলারত শিশুরা প্রলোভনে পড়ে পরিচিতদের মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কিশোরীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে প্রেমের ফাঁদে পড়ে। স্কুল ও মাদ্রাসা ছাত্রীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিক্ষকদের দ্বারা।
এসব পরিসংখ্যানের বাইরে নানামুখী নির্যাতনে আহত হয়েছে ২৫৪টি শিশু। হারিয়ে গেছে ৩৮টি শিশু। পানিতে ডুবে মারা যাওয়া শিশুর সংখ্যা ৫৭০।
২০২০ সালে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৬৫। আর নিখোঁজ ও অপহরণের শিকার হয় ২২ শিশু।
অপহরণের কারণ হিসেবে অর্থ, প্রেম, বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান, প্রতিশোধপরায়ণতা, পাচার ও মুক্তিপণ দাবির মতো বিষয়গুলো সংবাদে উঠে এসেছে বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
শিশুদের নিয়ে ২৫টি বিষয়ে নেতিবাচক খবর ছাপা হয়েছে ১ হাজার ৯৩০টি আর ১২টি বিষয়ে ছাপা হয়েছে ইতিবাচক সংবাদ। সংখ্যাটি ১০৬।
২০২০ সালে শিশু নির্যাতনের ১৬টি ঘটনা ঘটেছে। নির্যাতনকারী হিসেবে গৃহকর্তা, মা-বাবা, শিক্ষক, উত্ত্যক্তকারী, স্থানীয় চেয়ারম্যান, চাকরিদাতা ও প্রতিবেশীর নাম উঠে এসেছে। এমনকি ২০২১ সালে অপরাধে সংশ্লিষ্ট হওয়া শিশুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১২০, যা ২০২০ সালে ছিল দুটি।
ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিয়ে আলাদাভাবে আধেয় বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালে মোট ১৮টি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মেয়েশিশুর সংখ্যা ৩৮ এবং সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ঢাকায়।
৩৮ জন গৃহকর্মী ধর্ষণসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে ১২ জন নিহত, ২৪ জন আহত ও ২ জন আত্মহত্যা করেছে। নিহত গৃহকর্মীদের মধ্যে ৪ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ৮ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনামের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শিশু ও সমন্বয় উইং) মুহিবুজ্জামান। বিশেষ অতিথি ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মাহবুবা বিলকিস।
সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি ২০২১’-এর সার্বিক চিত্র উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির কো-অর্ডিনেটর রাফেজা শাহীন।
মুহিবুজ্জামান বলেন, ‘পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য হচ্ছে অপরাধপ্রবণতার ধারণামাত্র। ১৫টি পত্রিকা থেকে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় তথ্য গ্রহণ করে। ১০৯ হটলাইন নম্বরে প্রতিদিন অসংখ্য ফোন আসে। সেখান থেকে আমরা অপরাধের একটা ড্যাটা বেইজ তৈরি করি।’
শাহীন আনাম বলেন, ‘আমাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী শিশুরা নিজের বাসায়ও নিরাপদ নয়। শিশু ধর্ষণ ও শিশুর যৌন হয়রানি বন্ধ করতে এখনই জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। নয়তো এই হার বাড়তেই থাকবে।’
শিশু অধিকার রক্ষায় সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
তিনি শিশু সুরক্ষায় নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠানের সবাইকে আরও বেশি সহৃদয়বান হওয়ার পাশাপাশি শিশু অধিকার রক্ষায় সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমরা কোভিড-১৯ মহামারির চেয়েও ভয়ংকর, নিষ্ঠুর ও বর্বর মহামারি নারী ও শিশুদের ওপর যৌনসহিংসতা, ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। বিগত কয়েক বছর ধরে যৌন সহিংসতার মাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নির্যাতনের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর প্রতি নৃসংসতার ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত করা সম্ভব হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয় না। সেক্ষেত্রে পরিবার থেকে প্রতিটি প্রজন্ম শিখছে মেয়েরা মানুষ নয়, তারা শুধু ব্যবহারের জন্য। এভাবে পরিবার থেকেই মূলত নারীর প্রতি অসম্মানের শুরু। এতে বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতনের হার। নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের কথা বলছে রাষ্ট্র। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা নারীদের সম্মানের জায়গায় তুলে ধরতে পারছি না।’
তারা বলেন, ‘পরিবার থেকেই নারীদের সম্মান দেওয়ার শিক্ষাটা জরুরি। পাশাপাশি আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় যা রয়েছে তা একপ্রকার ইঁদুর দৌড়ের মতো। আমরা শুধু দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। মানবিক শিক্ষা না শিখে ডিগ্রির পেছনে দৌড়াচ্ছি। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানবিক শিক্ষা শুরু করা দরকার।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৩
আপনার মতামত জানানঃ