পৃথিবীর কক্ষপথ ক্রমেই হাজার হাজার স্যাটেলাইট দ্বারা পূর্ণ হয়ে উঠছে এবং প্রতিনিয়তই আরও নতুন নতুন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের পরিকল্পনা চলছে। কিন্তু মহাকাশে থাকা পুরোনো রকেটের বিভিন্ন অংশ কিংবা কৃত্রিম উপগ্রহের বিভিন্ন ভগ্নাংশ প্রবল বেগে অনিয়ন্ত্রিতভাবে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। রকেট বা স্যাটেলাইটের সঙ্গে এসব মহাকাশ বর্জ্যের সংঘর্ষের সম্ভাবনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কৃত্রিম উপগ্রহ বা রকেটের বড় বড় ধ্বংসাবশেষ ছাড়াও ছোট ছোট নাট-বল্টুর মতো বিপুল পরিমাণ বর্জ্য ঘিরে আছে আমাদের পৃথিবীকে।
এদিকে চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়তে চলেছে কোনও এক অজ্ঞাতপরিচয় রকেট। সপ্তাহখানেক আগেই বিজ্ঞানীমহলে পৌঁছেছিল এ খবর। আর তার পর থেকে শুরু হয়েছে বিতর্ক। প্রশ্ন উঠছে, এই মহাকাশ-বর্জ্য কাদের। আমেরিকা বলছে তাদের নয়। চীনও বলেছে, এ জিনিস তাদেরও নয়।
এমন ঘটনা যে ঘটতে চলেছে, তা প্রথম সকলের নজরে আনেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিল গ্রে। আনুমানিক দিন নির্ধারণ করে জানান, ৪ মার্চ নাগাদ রকেটটি আছড়ে পড়বে চাঁদে।
তিনি প্রথমে জানান, ওই রকেটটি স্পেসএক্স ফ্যালকন ৯ রকেট। ২০১৫ সালে এই রকেটটি ‘ডিপ স্পেস ক্লাইমেট অবজ়ারভেটরি স্যাটেলাইট’ উৎক্ষেপণে সাহায্য করেছিল। কিন্তু পরে বিল জানান, তার হিসাবে ভুল হয়েছিল। তার দাবি, এটি চীনের লং মার্চ ৩সি রকেট হতে পারে। ২০১৪-সালের অক্টোবরে চ্যাংই ৫-টি১ অভিযানে ব্যবহার করা হয় এই রকেট। ২০২০-র চ্যাংই ৫ অভিযানের পূর্বসূরী ছিল সেটি। বিশেষজ্ঞদের আরও অনেকেই এই দাবিকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, বেজিংয়ের চন্দ্র-অভিযানেরই অংশীদার রকেটটি।
প্রশ্ন উঠছে, এই মহাকাশ-বর্জ্য কাদের। আমেরিকা বলছে তাদের নয়। চীনও বলেছে, এ জিনিস তাদেরও নয়।
কিন্তু চীন তা মানতে নারাজ। আজ বিদেশ বিশেষজ্ঞদের দাবি উড়িয়েছে তারা। জানিয়েছে, ওটি তাদের রকেট নয়। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছে, তাদের দেশের যে রকেটটি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, সেটি পৃথিবীতে ফিরে এসেছিল এবং এই গ্রহে প্রবেশ করার সময় সেটি সম্পূর্ণ ভাবে ভস্মীভূত হয়ে যায়।
রকেটটির উৎস নিয়ে রহস্য থাকলেও তার ধ্বংস নিয়ে প্রশ্ন নেই। বিশেষজ্ঞেরা জানান, ৪ মার্চ ১২টা ২৫ গ্রিনিচ মিনটাইমে এটি চাঁদের বুকে আছড়ে পড়বে। পৃথিবী থেকে অবশ্য কিছুই দেখা যাবে না।
নানা চড়াই উৎড়াই পেড়িয়ে উনবিংশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে মানুষের কাঙ্খিত মহাকাশ যাত্রা সফলতার মুখ দেখে। পৃথিবীর বাইরের জগৎ অন্বেষণের জন্য মহাকাশযুগের সূচনার পর থেকে আমরা প্রতিনিয়ত পৃথিবীর কক্ষপথে মহাকাশ অভিযান পরিচালনা করছি। বিভিন্ন কক্ষপথের উদ্দেশ্য হাজার হাজার রকেট, কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করছি। কিন্তু নির্দিষ্ট কাজ করার জন্য এসব মহাকাশযান ও উপগ্রহগুলো তাদের কাজ সম্পাদন করে সেখানেই থেকে যাচ্ছে। মৃত বা বিকল হলে পড়ে আছে পৃথিবীর কক্ষপথে। এসব মৃত উপগ্রহ, রকেট বা তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ কক্ষপথে আবর্জনার সৃষ্টি করছে। যা বর্তমানে উপকারের থেকে ক্ষতিই বেশি করছে। হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে সমস্ত মহাকাশ ব্যবস্থাপনাকে। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন স্পেস জাঙ্ক বা মহাকাশ আবর্জনা।
বিজ্ঞানীদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মহাকাশ বর্জ্য। এগুলো পুনর্ব্যবহার করতে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা চলছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এবার মহাকাশে রকেটের জ্বালানি তৈরির সম্ভাবনার কথা বলছে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠান নিউম্যান স্পেস। মহাকাশের এই বর্জ্য সরাতে ইতিমধ্যে মহাকাশে গ্যাসস্টেশনের কথা ভাবতে শুরু করেছেন বিজ্ঞানীরা।
দ্য গার্ডিয়ান-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পৃথিবীর কক্ষপথে পুরোনো মহাকাশযানের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এ ছাড়া অব্যবহৃত কৃত্রিম উপগ্রহ ও রকেটের বিভিন্ন অংশ ঘণ্টায় ২৮ হাজার কিলোমিটার গতিতে ছুটে চলেছে। এগুলো কৃত্রিম উপগ্রহ ও আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের জন্য ঝুঁকি। এ গতিতে ছুটতে থাকা সামান্য একটি স্ক্রুও আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বা নভোচারীদের জন্য হুমকি হতে পারে।
সম্প্রতি, রাশিয়ার উৎক্ষেপিত একটি উপগ্রহের ওপরে সেই ক্ষেপণাস্ত্রেরই পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করে রসকসমস। তবে উপকারের বদলে তার পরিণতি হল ভয়ঙ্কর। বলা যায়, হিতে বিপরীত। মিশাইলের আঘাতে শূন্যে ভেসে থাকা উপগ্রহটি টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা মহাকাশে।
ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি দৃশ্যমান খণ্ডে বিভক্ত হয়ে গেছে সংশ্লিষ্ট উপগ্রহটি। তাছাড়াও তৈরি হয়েছে কয়েক লক্ষ ধূলিকণা। যে কণাগুলি মহাকাশচারীর স্পেসস্যুটকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট। অন্যদিকে দৃশ্যমান বড়ো টুকরোগুলি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণরত অন্যান্য উপগ্রহ তো বটেই, এমনকি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনকেও রীতিমতো ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
কয়েকদিন আগেই বড়োসড় ফাটল লক্ষ করা গিয়েছিল আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে। সেই ফাটল সম্পূর্ণভাবে মেরামত করা সম্ভব নয় বলেই জানিয়েছিলেন গবেষকরা। তার ওপরে এই ধরনের মহাকাশ বর্জ্যের সামান্যতম আঘাতও বড়ো বিপত্তি ডেকে আনতে পারে, এমনটাই অভিমত বিজ্ঞানীদের। তাছাড়াও এই ধরনের বর্জ্যের কারণে বিঘ্ন ঘটতে পারে আবহাওয়ার পূর্বাভাস নির্ণয়, টেলিভিশন সম্প্রচার, মোবাইল নেটওয়ার্ক-সহ একাধিক পরিষেবা। কিন্তু তারপরেও এমন একটি পরীক্ষার জন্য অন্যান্য মহাকাশ সংস্থাগুলির সঙ্গে কেন কোনোরকম পূর্ব-আলোচনার পথে হাঁটল না রসকসমস, তা নিয়েই উঠছে প্রশ্ন। রাশিয়ার মহাকাশ সংস্থার এই কর্মকাণ্ডে ইতিমধ্যেই সমালোচনার ঝড় উঠেছে বিশ্বজুড়ে। এর আগে ২০০৭ সালে একই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছিল চিনও। একের পর এক ভুলের পুনরাবৃত্তির পরেও আদৌ কি কোনো শিক্ষা নেবে মানবসভ্যতা? জানা নেই উত্তর।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৭
আপনার মতামত জানানঃ