বিশ্ববাসীর চোখ এখন ইউরোপের পূর্ব সীমান্তে। সেখানে ইউক্রেনকে ঘিরে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। যেকোনো সময় পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক এ দুই পরাশক্তি যুদ্ধে জড়াতে পারে। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও হুঁশিয়ারিতে কাটছে একেকটি দিন। উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। তবে কি ২০২২ সালে আরেকটি বড় যুদ্ধ দেখবে বিশ্ববাসী? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্ব অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব। পশ্চিমাদের দাবি, রাশিয়া যেকোনো সময় ইউক্রেন আক্রমণ করতে পারে। এ সংঘাত ঠেকাতে এরই মধ্যে পূর্ব ইউরোপে সেনা মোতায়েন বাড়িয়েছে ন্যাটো সদস্যরা। ইউক্রেন সীমান্তে আনাগোনা বেড়েছে রুশ সেনাদের। অস্ত্র হাতে প্রস্তুত হচ্ছে ইউক্রেনের সাধারণত মানুষও। ফলে গোটা বিশ্বের নজর এখন সাবেক সোভিয়েত দেশটিতে।
তবে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এর আগে জানায়, মহড়া শেষে ইউক্রেন সীমান্ত থেকে কিছু সেনা ঘাঁটিতে ফিরিয়েছে তারা। তাছাড়া ইউক্রেনের কয়েকটি এলাকায় এরই মধ্যে গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটছে। তাই পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। সব কিছু ছাপিয়ে এর প্রভাব পড়েছে সারাবিশ্বে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে, ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা চালালে পূর্ব ইউরোপে অনিশ্চয়তার নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। সরবরাহ শৃঙ্খল ও বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবের পরিবর্তনে বাধ্য করতে পারে যাতে পশ্চিমাদের প্রতি বাকি বিশ্বের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই ভয় এখনো এড়ানো যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে তারা এটাও বলছেন যে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমান সংকট যদি সংঘাতের দিকে মোড় নেয়, তাহলে গম থেকে শুরু করে জ্বালানির দামে এর প্রভাব পড়বে। অস্থিরতা দেখা দেবে অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও।
ইউক্রেন ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার লড়াই শুরু হলে বিশ্ববাজারে যে প্রভাব পড়তে পারে, তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—
সেফ হ্যাভেন
কয়েক দশকের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ও সম্ভাব্য সুদের হার বৃদ্ধির শঙ্কার মধ্যে বন্ড বাজারের অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। তবে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে সরাসরি লড়াই শুরু হলে এ পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দুই বছর মেয়াদী ট্রেজারি আয় ২০১৬ সালের পর থেকে এক মাসে সর্বোচ্চ পরিমাণে বেড়েছে, এছাড়া ১০ বছর মেয়াদী হার দুই শতাংশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জার্মানিতে ২০১৯ সালের পর প্রথমবারের মতো ১০ বছর মেয়াদী আয় ০ শতাংশের ওপর উঠেছে।
বড় কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনার সময় সাধারণত বিনিয়োগকারীদের বন্ডের দিকে ঝুঁকতে দেখা যায়। কারণ একে পৃথিবীর ‘সবচেয়ে নিরাপদ’ সম্পদগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে ধরা হয়। ফলে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে এবং এরপর মূল্যস্ফীতি দেখা দিলেও বন্ডে তেমন কোনো সমস্যা হবে না ধরে নেওয়া যায়।
অন্য সেফ হ্যাভেনগুলোর মধ্যে স্বর্ণের দাম এরই মধ্যে দুই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। একই অবস্থা ইয়েনেরও।
খাদ্যশস্য ও গম
ইউক্রেনে হামলা হলে বাধার মুখে পড়তে পারে কৃষ্ণ সাগর দিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচল। এর প্রভাব হবে মারাত্মক। এতে এ পথ দিয়ে আমদানি-রপ্তানি করা খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। করোনা মহামারির কারণে এর মধ্যেই বিশ্বের অনেক অঞ্চলের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ফলে নতুন করে খাদ্যের দাম বাড়লে তা সংকট বাড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
খাদ্যশস্যের অন্যতম চার রপ্তানিকারক দেশ ইউক্রেন, রাশিয়া, কাজাখস্তান ও রোমানিয়া। এই দেশগুলোর পণ্য রপ্তানি হয় কৃষ্ণ সাগরের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে। গম রপ্তানির দিকে দিয়ে বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে রাশিয়া। ইন্টারন্যাশনাল গ্রেইনস কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ভুট্টা রপ্তানিকারক দেশ হতে যাচ্ছে ইউক্রেন। আর গম রপ্তানিতে দেশটির অবস্থান চতুর্থ।
ইউবিএসের কৌশলবিদ ডমিনিক স্নাইডার বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি অনেক বেড়েছে। এটি আগামীতে গমের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে।
তেল ও গ্যাস
রাশিয়া-ইউক্রেন উত্তেজনা সংঘর্ষে রূপ নিলে জ্বালানি বাজারে এর প্রভাব পড়া স্বাভাবিক। ইউরোপ প্রায় ৩৫ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল, যার বেশিরভাগই পাইপলাইনের মাধ্যমে বেলারুশ ও পোল্যান্ড হয়ে জার্মানিতে পৌঁছায়। নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইন রাশিয়া থেকে সরাসরি জার্মানিতে গেছে, বাকিগুলো গেছে ইউক্রেন হয়ে।
লকডাউনের মধ্যে চাহিদা কমে যাওয়ায় ২০২০ সালে রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির পরিমাণ কমে গিয়েছিল, গত বছর চাহিদা বাড়লেও সরবরাহ আগের অবস্থায় ফেরেনি। এর ফলে গ্যাসের দাম রেকর্ড পরিমাণে বাড়তে দেখা গেছে।
ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা হিসেবে জার্মানি বলেছে, তারা নতুন নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইনের কাজ স্থগিত করতে পারে। মস্কোর ওপর জ্বালানিনির্ভরতাও কমিয়ে আনতে পারে ইউরোপ।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা এলে গ্যাসের দাম আরও বাড়তে পারে। কারণ, এমনটি হলে ইউক্রেন ও বেলারুশের মধ্য দিয়ে পশ্চিম ইউরোপে গ্যাসের সরবরাহ কমে আসবে।
বর্তমান সংকট যদি সংঘাতের দিকে মোড় নেয়, তাহলে গম থেকে শুরু করে জ্বালানির দামে এর প্রভাব পড়বে। অস্থিরতা দেখা দেবে অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও।
ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত হলে সংকটে পড়তে পারে জ্বালানি তেলের বাজারও। রাশিয়া থেকে উত্তোলন করা জ্বালানি তেল ইউক্রেন হয়ে স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি ও চেক প্রজাতন্ত্রে যায়। ২০২১ সালে ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে দেশগুলোতে ১ কোটি ১৯ লাখ টন অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে মস্কো। যেখানে আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২৩ লাখ টন।
আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান জে পি মরগান বলছে, সংঘাত শুরু হলে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ১৫০ মার্কিন ডলারে দাঁড়াতে পারে। ফলে বছরের প্রথমার্ধে বৈশ্বিক জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াতে পারে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশে। একই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ৭ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে।
ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব
যুদ্ধের ফলে সংকটে পড়তে পারে পশ্চিমা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ, রাশিয়ার সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে রয়েছে তারা। দেশটির সবচেয়ে বড় জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান রসনেফটে ১৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ মালিকানা রয়েছে যুক্তরাজ্যের বহুজাতিক জ্বালানি প্রতিষ্ঠান বিপির। প্রতিষ্ঠানটির মোট উত্পাদনের তিন ভাগের এক ভাগ আসে রসনেফট থেকে। এ ছাড়া যৌথভাবে দুই প্রতিষ্ঠানের একাধিক ব্যবসা রয়েছে।
রাশিয়ার প্রথম তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) প্ল্যান্ট ‘সাখালিন-২’-এর ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ মালিকানা রয়েছে যুক্তরাজ্যের আরেক বহুজাতিক জ্বালানি প্রতিষ্ঠান শেলের হাতে। রাশিয়ার যে এলএনজি রপ্তানি করে, তার তিন ভাগের এক ভাগ আসে সাখালিন-২ থেকে। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমের সঙ্গেও ব্যবসা রয়েছে শেলের।
যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি প্রতিষ্ঠান এক্সনেরও ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে রাশিয়ায়। সাখালিন-১ তেল ও গ্যাস প্রকল্পের মাধ্যমে সেখানে ব্যবসা করছে মার্কিন এই কোম্পানি। রাশিয়ার এই প্রকল্পে ভারতের রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করপোরেশনেরও অংশীদারত্ব রয়েছে। নরওয়ের প্রতিষ্ঠান ইকুইনর এই মুহূর্তে দেশটিতে সক্রিয়ভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইউক্রেনে হামলা হলে এর প্রভাব পড়বে আর্থিক খাতেও। বেশি সমস্যায় পড়তে পারে ইউরোপের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। জে পি মরগানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অস্ট্রিয়ার রাইফেইসেন ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল, হাঙ্গেরির ওটিপি ও ইউনিক্রেডিট ব্যাংক, ফ্রান্সের সোসায়েটে জেনারেল ব্যাংক, নেদারল্যান্ডসের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইএনজির ব্যবসা রয়েছে রাশিয়ায়। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফার একটি অংশ আসে রাশিয়া থেকে।
পশ্চিমা দেশগুলো থেকে রাশিয়ার ঋণ নেওয়ার পরিমাণও কম নয়। ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার ব্যাংকগুলো থেকে দেশটিতে যথাক্রমে ২৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ও ১৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়া হয়েছে। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৬ বিলিয়ন, জাপান থেকে ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ও জার্মানির ব্যাংগুলো থেকে ৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে রাশিয়া।
আর্থিক ও জ্বালানি খাতের বাইরেও নানা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে। এর মধ্যে রয়েছে ফ্রান্সের রেনল্ট, জার্মানির মেট্রো এজি ও ডেনমার্কের কার্লসবার্গের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। যুদ্ধ শুরু হলে এসব ব্যবসা ক্ষতির মুখে পড়বে।
আঞ্চলিক ডলার বন্ড ও মুদ্রাবাজার
সামরিক পদক্ষেপের কারণে কোনো বাজারে অধঃপতন হলে তার সম্মুখসারিতে থাকবে রাশিয়া ও ইউক্রেন। উভয় দেশেই ডলার বন্ডের পারফরম্যান্স কয়েক মাস ধরে ভালো যাচ্ছে না। মস্কো ও তার মিত্রদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের উত্তেজনা বাড়ায় মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।
ক্ষতির মুখে পড়েছে রাশিয়ার রুবল এবং ইউক্রেনের রিভনিয়াও। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত উদীয়মান বাজারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স করা মুদ্রা এ দুটি।
আইএনজি’র গ্লোবাল হেড অব মার্কেটস ক্রিস টার্নারের মতে, ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তের ভূ-রাজনীতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে ‘উল্লেখযোগ্য অনিশ্চয়তা’ তৈরি হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১১৫৩
আপনার মতামত জানানঃ