২০২১ সালের অক্টোবরে এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সভায় ‘বিমান শিল্প’ ২০৫০ সালের মধ্যে নেট ‘জিরো কার্বন’ নির্গমন অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সে আশার উত্তেজনায় পানি ঢেলে দিয়েছে পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিসের সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণ। খবর সিএনএন
সংগঠনটি সম্প্রতি প্রকাশিত তাদের এক রিপোর্টে জানিয়েছে, ইউরোপের আকাশে আসন্ন শীতকালীন মৌসুমে লাখের বেশি ‘ভূতুড়ে ফ্লাইট’ পরিচালিত হবে। আর এসব ভূতুড়ে ফ্লাইটের কার্বন নির্গমনের পরিমাণ ১৪ লাখ গাড়ির কার্বন নির্গমনের সমান।মহামারির শুরুর দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক সীমানাগুলো বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ভ্রমণের চাহিদাও হঠাৎ নিচে নেমে যায়। এই সময় ‘ভূতুড়ে ফ্লাইট’ একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
একটি রুটে কোনো বিমান সংস্থার বিমানগুলো কিভাবে চলবে তার জন্য থাকে চুক্তিভিত্তিক শিডিউল। এই শিডিউল অনুযায়ী বিমান সংস্থাগুলো তাদের বিমান নিয়মিত পরিচালনা করে।
করোনা মহামারির শুরুর দিকে যখন বিমান পরিবহন থমকে দাঁড়ায় এবং আন্তর্জাতিক সীমানা বন্ধ করে দেওয়া হয় তখন ‘গোস্ট ফ্লাইট’ বা ‘ভূতুরে ফ্লাইট’ একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে ওঠে।
ভূতুরে ফ্লাইট’ বলতে বুঝায় একেবারে নামমাত্র যাত্রী অথবা যাত্রী না থাকা সত্ত্বেও চুক্তিভিত্তিক বাধ্যবাধকতার কারণে বিমানগুলো শিডিউল অনুযায়ী আকাশপথ পাড়ি দেওয়া। শুধু চুক্তির কারণে চলা এই প্রায় যাত্রীশূণ্য ফ্লাইটগুলো থেকে অকারণে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়।
করোনার প্রায় দুইবছর হতে চললেও এই ‘ভূতুরে ফ্লাইট’ এখনো বায়ুমন্ডলকে দূষিত করে যাচ্ছে এবং বর্তমানে এটি একটি বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গ্রিনপিসের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই বছর শীতে ইউরোপের আকাশে দশ লাখেরও বেশি ‘ভূতুরে ফ্লাইট’ পাড়ি দেবে। এতে করে যে পরিমাণ পরিবেশ দূষণ ঘটবে, তা বছরে ১.৪ মিলিয়নের বেশি গাড়ির ধোঁয়ায় সৃষ্ট দূষণের সমান।
ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমান সংস্থা হলো লুফথানসা। গত ডিসেম্বরে লুফথানসার সিইও কার্সটেন স্পরের একটি সাক্ষাৎকার নেয় গ্রিনপিস যেখানে তিনি সতর্ক করে বলেন, ইউরোপের নিয়মের অধীনে লুফথানসার স্লটগুলোকে ধরে রাখার জন্য তাদেরকে অতিরিক্ত ১৮ হাজার অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইট পরিচালনা করতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে, লুফথানসা ইউরোপের ১৭ শতাংশ ফ্লাইট পরিচালনা করে। গ্রিনপিসের অনুমান অনুযায়ী, ইউরোপের ‘ভূতুরে ফ্লাইট’ ২.১ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করবে।
সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, চুক্তিভিত্তিক বাধ্যবাধকতা থেকেই বিমান কোম্পানিগুলোর শূন্য অথবা প্রায় যাত্রীশূন্য ভ্রমণ পরিচালনা করে। কিন্তু সমস্যা হলো, দুই বছর পরেও বিমানগুলো একই অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিস ভূতুড়ে ফ্লাইটের যে বিশ্লেষণ দিয়েছে, গত ডিসেম্বরে লুফথানসা বিমানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কারেস্টেন স্ফোরের এক সাক্ষাৎকারেও একই আভাস মেলে।
করোনার প্রায় দুইবছর হতে চললেও এই ‘ভূতুরে ফ্লাইট’ এখনো বায়ুমন্ডলকে দূষিত করে যাচ্ছে এবং বর্তমানে এটি একটি বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি জানান, ইউরোপীয় আইনের বাধ্যবাধকতার জেরে আগামী ৬ মাস বিমান সংস্থাটিকে ১৮ হাজার অতিরিক্তি ফ্লাইট পরিচালনা করতে হবে।লুফথানসা বিমান ইউরোপীয় বাজারে ১৭ শতাংশ ফ্লাইট পরিচালনা করে। এটা থেকে ধারণা নিয়ে গ্রিনপিসের অনুমান, ইউরোপের মোট ভূতুড়ে ফ্লাইট ২১ লাখ টন কার্বন নির্গমন করবে।
এই বিশ্লেষণ পরিবেশবাদীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। সুইডেনের পরিবেশ আন্দোলনককর্মী গ্রেটা থুনবার্গ বলেছেন, ব্রাসেলস এয়ারলাইন বিমান স্লট রক্ষা করতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় ৩ হাজার ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। যদিও যুক্তরাজ্যে অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইট বাতিলে সরকারের কাছে একটি পিটিশন দায়ের করা হয়েছে। গ্রিনপিসের মুখপাত্র হারজেগ চস্টার বলেছেন, আমরা মারাত্মক জলবায়ু সংকটের মধ্যে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতর পরিবহন সেক্টর তড়িৎগতিতে নির্গমন বাড়াচ্ছে। ভূতুড়ে ফ্লাইট বরফের চূড়ায় সূর্যের কণা মাত্র।তবে লুফথানসা বলছে, তারা বিমানগুলো পূর্ণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু করোনার কারণে তাদের বেগ পোহাতে হচ্ছে।
সিএনএনকে বিমানটির একজন মুখপাত্র বলেন, অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইটগুলো খালি অথবা ভূতুড়ে ফ্লাইট বলা যথার্থ নয়। এগুলো তালিকাভুক্ত ফ্লাইট।
মূলত করোনার কারণে আসন পূর্ণ হয়নি। সামান্য চাহিদা সত্ত্বেও লুফথানসা গ্রুপকে ইইউ বিমানবন্দরে উড্ডয়ন নিশ্চিতের স্বার্থে আবশ্যিকভাবে ফ্লাইট চালু রাখতে হবে।
লুফথানসা আরও বলেছে, করোনার ওমিক্রন ধরনের আবির্ভাবের কারণে আসন্ন মৌসুমে তারা যে অনুমান করেছিলেন সেটা পূর্ণ হবে না। কারণ, করোনা বিশেষ করে ওমিক্রন সংকট তাৎপর্যপূর্ণভাবে সাধারণ মানুষ এবং চাকরিজীবীদের ভ্রমণে বিধি-নিষেধ বাড়িয়েছে।
গ্রিনপিসের ‘ইউরোপীয়ান মোবিলিটি ফর অল’ ক্যাম্পেইনের মুখপাত্র হেরউইং সাস্টার বলেন, ‘আমরা জলবায়ু সংকটের মধ্যে রয়েছি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবহন খাত সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গত করে। উদ্দেশ্যহীন, পরিবেশ দূষণকারী ‘ভূতুরে ফ্লাইট’গুলোর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। রেল সংযোগ থাকার পরেও কম যাত্রী ধারণকারী ফ্লাইট এবং স্বল্প দূরত্বে পরিচালিত ফ্লাইটগুলোকে নিষেধাজ্ঞা না দেওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রকাশ’।
ইউরোপের সবচেয়ে বৃহত্তম কম-খরচের বিমান সংস্থা রায়ানায়ারের মতে, ভূতুরে ফ্লাইট সমস্যার সমাধান সোজাসাপ্টা হওয়া উচিত।
রায়ানায়ারের মালিক মিখাইল ও লেরি বলেন, ‘যদি লুফথানসাকে সত্যিই তাদের ভূতুরে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হয়, তাহলে তাদের উচিত বিমানের টিকিটের দাম কমানো।
ও লেরির যুক্তি দিয়ে বলেন, ‘লুফথানসা ও এর সহযোগী বিমানসংস্থাগুলো (ব্রাসেলস, সুইস ও অস্ট্রিয়ান বিমান সংস্থ) বহুবার রাষ্ট্রীয় সাহায্য থেকে উপকৃত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে এখন তাদের উচিত এই খালি বিমানগুলো পরিচালনার বদলে স্বল্পমূল্যে সিটগুলো বিক্রি করে কোভিড সংকটে বিলিয়ন ইউরো ভূর্তকি দেওয়া জার্মান ও ইউরোপীয় করদাতাদের সম্মান করা’।
তবে, লুফথানসার মুখপাত্র এই এর বিপক্ষে বলেন, একটি বিশাল বিমান সংস্থার জন্য এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতি। তিনি বলেন, ‘লুফথানসার মতো নেটওয়ার্ক কোম্পানিগুলো বিমানবন্দরের স্লটের উপর নির্ভশীল এবং এরা মূলত দূরপাল্লার ফ্লাইট পরিচালনা করে। আর স্বল্প খরচের বিমান সংস্থাগুলো মূলত কম-দূরত্বের ফ্লাইট পরিচালনা করেন যেখানে সাধারণত স্লটের কোনো অভাব থাকে না’।
এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য লুফথানসা চাচ্ছে, ইউই সদস্য দেশগুলো যাতে এই শীতকালীন মৌসুমে বিমান উড্ডয়ন ও অবতরনে ব্যতিক্রম নিয়ম ধার্য করে। সেইসাথে যাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানো হয়, সেটিও চান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪২
আপনার মতামত জানানঃ