পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে পবিত্র কোরআনের পৃষ্ঠা পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়েছে। পরে ওই ব্যক্তির লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
এই ঘটনায় প্রায় ৩০০ জন জড়িত ছিল। বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে দেশটির পুলিশ। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে আল জাজিরা। সূত্র মতে, ওই ব্যক্তি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল।
পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনকে কেন্দ্র করে মামলা, হত্যা ও সাজার ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে৷ দেশটির বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা থেকে শুরু করে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাও এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে৷
যা ঘটেছিল
পাঞ্জাব প্রদেশের খানেওয়াল জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে রোববার এই ঘটনা ঘটেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। ইমরান খান জনতা এবং হত্যাকাণ্ডে দর্শকের ভূমিকায় থাকা পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, গ্রামের মসজিদটি যিনি দেখভাল করেন, তিনি মসজিদের ভিতর থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভিতরে যান।
তিনি দেখেন, পবিত্র কোরানের একটি কপি পোড়ানো হয়েছে। আরেকটিতে আগুন ধরানোর চেষ্টা করছে এক ব্যক্তি।
সেই সময় সন্ধ্যার নামাজ পড়ার জন্য অনেকে মসজিদে আসছিলেন। তিনি তখন চিৎকার করে ওই ব্যক্তিকে থামতে বলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পুলিশ কর্মীরা গ্রামে পৌঁছান এবং ওই ব্যক্তিকে ধরেন। কিন্তু উত্তেজিত জনতা তাকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়।
জনতা তারপর ওই ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়তে থাকে। পুলিশকে লক্ষ্য করেও পাথর ছোঁড়া হয়।
প্রায় তিনশ মানুষ তখন সমবেত হয়ে গেছেন। তারা এরপর ওই ব্যক্তির দেহ গাছ থেকে ঝুলিয়ে দেয়। সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, তখন প্রচুর মানুষ সেখানে ছিলেন।
পাঞ্জাব পুলিশের কর্মকর্তা মুনাওয়ার হুসাইন জানান, শনিবার রাতে তুলামবা গ্রামের মসজিদের ইমামের ছেলে ওই ব্যক্তিকে পবিত্র কোরআনের পৃষ্টা পুড়িয়ে ফেলতে দেখেছেন বলে ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার পর গ্রামের বাসিন্দারা মসজিদে এসে জড়ো হন। এ সময় উত্তেজিত জনতা ওই ব্যক্তিকে গণপিটুনি দেওয়া শুরু করে।
পুলিশ জানিয়েছে, তাদের তিনজন অফিসার আহত হয়েছেন। পরে আরো কনস্টেবল এবং অফিসার ঘটনাস্থলে পৌঁছান এবং পরিস্থতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। তারা ওই ব্যক্তির ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠান।
পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে উত্তেজিত গ্রামবাসীরা পুলিশের ওপরও হামলা চালায় বলে দাবি করেন পুলিশ কর্মকর্তা হুসাইন। তিনি বলেন, গ্রামবাসীরা তাকে লাঠিসোটা, কুঠার ও লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে একটি গাছে ঝুলিয়ে দেয়।
মুনাওয়ার হুসাইন আরও বলেন, পুলিশ এখন পর্যন্ত সংগ্রহ করা তথ্যের উপর ভিত্তি করে নিহত ব্যক্তির নাম মুহাম্মদ মুশতাক বলে জানতে পেরেছে। এই ব্যক্তি মানসিক প্রতিবন্ধী ছিলেন।
এক বিবৃতিতে ইমরান বলেছেন, পিটিয়ে হত্যার এই ঘটনা কঠোর আইনে মোকাবিলা করা হবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে।
We have zero tolerance for anyone taking the law into their own hands & mob lynchings will be dealt with full severity of the law. Have asked Punjab IG for report on action taken against perpetrators of the lynching in MIan Channu & against the police who failed in their duty.
— Imran Khan (@ImranKhanPTI) February 13, 2022
জানা যায়, এই ঘটনায় সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৬০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখে অন্যান্য সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করা হচ্ছে।
ধর্মীয় ব্লাসফেমি ও পাকিস্তান
স্থানীয় পুলিশের মুখপাত্র সংবাদসংস্থা ডিপিএ-কে জানিয়েছেন, যারা হত্যা করেছে, তাদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলছে। পুলিশ প্রধান মুনাবর গুজ্জর জানিয়েছেন, তদন্তকারীরা এখন অপরাধীদের চিহ্নিত করতে ভিডিওগুলি খতিয়ে দেখছেন।
তিনি জানিয়েছেন, আর মৃত ব্যক্তির নাম মুস্তাক আহমেদ। তার বয়স ৪১ বছর। তিনি গত ১৫ বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন। তার পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মাঝেমধ্যেই সে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যেত। ভিক্ষা করে খেত।
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এই সহিংসতার নিন্দা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে তিনি রিপোর্ট চেয়েছেন।
ইমরান টুইট করে বলেছেন, ”কেউই আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না। এই বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে চলি। আইনানুযায়ী অভিযুক্তদের বিচার হবে।”
পাকিস্তানে ধর্মনিন্দা আইনত নিষিদ্ধ, এর ফলে ফাঁসি পর্যন্ত হতে পারে। গতমাসেই এক নারীর ফাঁসির আদেশ হয়েছে। ওই নারী আপত্তিকর টেক্সট মেসেজ ও মহানবী(সাঃ)-র ক্যারিকেচার পাঠিয়েছিল। তবে আইনি শাস্তির বাইরেও ব্লাসফেমির অভিযোগে কয়েকজনকে খুন হতে হয়েছে ক্রুদ্ধ গোষ্ঠীর হাতে।
যুক্তরাষ্ট্রের কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম (ইউএসসিআরএফ)-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৮০ জন এই ‘ব্লাসফেমির অপরাধে’ কারাগারে আটক রয়েছেন৷ তাদের অর্ধেকই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি৷
তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, সংখ্যালঘুদের দমনে এই আইনের অপব্যবহার করা হচ্ছে৷ অনেক ক্ষেত্রে এমনকি মুসলিমরাও ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে একজন আরেকজনকে ব্লাসফেমি মামলায় ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন৷
পাকিস্তানে এই আইনের সূচনা হয় সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউল হকের অধীনে ১৯৮০ এর দশকে৷ এই আইন অনুযায়ী ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) কে অবমাননা করলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷ এছাড়া ইসলাম ধর্ম, পবিত্র কোরআনসহ নির্দিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিদের নিন্দা বা অবমাননায় কারাদণ্ডসহ কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে৷
২০২০ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানের পেশোয়ারে তাহির নামিস নামে একজনকে বিচার চলাকালে আদালতকক্ষের ভিতরেই গুলি করে হত্যা করা হয়৷ তার বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছিল৷ বিচার চলাকালীন এমন হত্যার ঘটনা এই প্রথম নয়৷ ১৯৮০-র দশক থেকে এখন পর্যন্ত ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছে এমন ৭৫ জন ব্যক্তি বা কোনো গোষ্ঠীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন৷
জন (ছদ্ম নাম) খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের একজন সুপরিচিত নাম যিনি পাকিস্তানেই ব্যাংকিং পেশায় কর্মরত ছিলেন এবং রাজনীতিও করতেন। এই ব্যক্তির জীবনই পাল্টে যায় যখন তার মাত্র তের বছর বয়সী সন্তানকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করায় ব্লাসফেমির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি স্ত্রী ও দু সন্তানসহ যুক্তরাজ্যে শরণার্থীর জীবন যাপন করছেন কিন্তু ওই অভিযোগ এখনো তার পিছু ছাড়ছেনা।
প্রথমে বার্মিংহামের কাছে একটি মসজিদে অবস্থান নিয়েছিলেন কিন্তু ওই এলাকাতেই পাকিস্তানী বংশোদ্ভূতদের বসবাস ছিলো বেশি।
তিনি জানান, এক রাতে এক ব্যক্তি আমার ঘরের দরজায় নক করলো এবং আমার স্ত্রীকে মসজিদের দেয়ালের পাশে ময়লার ব্যাগ রাখার মাধ্যমে মসজিদকে অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করলো।
পরে সিসিটিভি ফুটেজে প্রমাণ হলো এটি আসলে অন্য এক নারী ছিলেন। তিনি জানান, তার সন্তানরা এখনো আতঙ্কিত এবং তারা আর পাকিস্তানে ফিরে যেতে চায় না।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ