খাল-বিল-নদীর দেশে অচিন্তনীয়হারে দাম চড়ছে পানির। দফায় দফায় বাড়ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানির দামও। ধীরে ধীরে এসব যেন চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অতি প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর দাম গত ১২ বছরে বেড়েছে দুই থেকে আড়াই গুণ।
দুর্বিষহ জীবনে পড়েছেন শ্রমিক, কৃষক, চাকরিজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ। বিনোদন, চিকিৎসা, লেখাপড়া এমনকি খাওয়ার খরচ কমিয়ে তারা চাপ সামলাচ্ছেন। সব দিকে কাটছাঁট করে শুধু প্রাণটুকু বাঁচিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন দিন। নতুন করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা যেন তাদের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি
চলতি মাসে এলপিজি সিলিন্ডারপ্রতি ৬২ টাকা দাম বাড়িয়েছে সরকার। দোকানে দাম আরও বেশি রাখছে। শুধু এলপিজি নয়, গত ১১ বছরে প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছে সরকারি গ্যাসের দাম। ২০০৯ সালে দুই চুলার গ্যাসের মাসিক বিল ছিল ৪০০ টাকা। পাঁচ দফায় বেড়ে তা হয়েছে ৯৭৫ টাকা। বৃদ্ধির হার ১৪৩.৭৫ শতাংশ।
চলতি মাসে নতুন করে দুই চুলার গ্যাসের বিল ২১০০ টাকা করার প্রস্তাব করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। ২০০৯ সালে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের খুচরা দাম ছিল চার টাকা ৩৪ পয়সা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৯ টাকা ৯৬ পয়সা, বেড়েছে ১২৯ শতাংশ। চলতি মাসে এই দাম ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর আবেদন করেছে পেট্রোবাংলা।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল দুই মাস আগে। এর ফলে সমাজ ও অর্থনীতিতে এর যে প্রভাব পড়েছে তা কাটাতে না কাটাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর নাটক শুরু হয়েছে। গত জানুয়ারি মাসের শুরুতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জ্বালানি বিভাগ।
বিইআরসি সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে এখন দিনে গড়ে ৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে ২৩০ কোটি ঘনফুটের (৭৮ শতাংশ) বেশি আসে দেশের নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র থেকে। আর কাতার ও ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি হয় মোট সরবরাহের ১৭ শতাংশ।
আর ৫ শতাংশ আন্তর্জাতিক খোলাবাজার থেকে কেনা হয়। এখন এই ৫ শতাংশ গ্যাসের বাড়তি দামের নামে গ্যাসের দাম দ্বিগুণেরও বেশি করার প্রস্তাব করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো।
বিইআরসির একজন সদস্য বলেন, ‘গত দুই বছরে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে। সিস্টেমে ৩০৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মধ্যে ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নিজস্ব গ্যাস, যেটার দাম ওঠানামা করছে না। দ্বিতীয়ত ৬০০ মিলিয়ন গ্যাস আছে এলএনজি থেকে, এটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির কারণে দাম ওঠানামা করছে না।’
‘আগামী ১০ বছরেও দাম ওঠানামা করবে না। বাকি ১৫০ মিলিয়ন গ্যাসের ক্ষেত্রে দাম কিছুটা ওঠানামা করতে পারে। সেক্ষেত্রে ১৫০ মিলিয়নের দাম যদি ৫ টাকা করেও উঠানামা করে তাতে কী এমন আসে যায়? এর প্রভাব বাজারে কতটা পড়বে? আপনারাই অংকটা করে দেখেন।’
করোনাকালীন অর্থনৈতিক মন্দার সময় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো হবে। এ সময়ে ৯৭৫ টাকার গ্যাস বার্নারের খরচ ২১০০ টাকা করার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে যদি গ্যাসের দাম বা দেশের গ্যাস সরবরাহ কোম্পানিগুলোর পরিচালন খরচ বাড়েও তাতেও তা ১৫ থেকে ২০ ভাগের বেশি হতে পারে না।
বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেও মাত্র ৫ ভাগ গ্যাস খোলা বাজার থেকে কেনার অজুহাতে গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধির প্রস্তাব অনভিপ্রেত, বাস্তবতাবিবর্জিত ও কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ।
বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি
বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সরকার আরও এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। গত ১১ বছরে সরকার ১০ বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে দাম বেড়েছে ৯০ শতাংশ।
২০১০ সালে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় খুচরা মূল্য ছিল তিন টাকা ৭৬ পয়সা। সর্বশেষ ২০২০ সালের মার্চে তা বাড়িয়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা করা হয়। এখন আরেক দফা দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এক দশক ধরে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে যাচ্ছে সরকার। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা গেলেও কাজে লাগানো যায়নি বিদ্যুৎ। ফলে বিদ্যুৎ খাতের সক্ষমতা ও উৎপাদনের মধ্যে ব্যবধান থেকেই যাচ্ছে। এর উপর মহামারীকালে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ও উৎপাদনের অসামঞ্জস্যতা বাড়ছে প্রতিদিনই। সক্ষমতার বড় একটি অংশ অব্যবহৃত থেকে যাওয়ায় আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে দেশের বিদ্যুৎ খাত।
তথ্যমতে, বিদ্যুতের লোকসান মেটাতে ২০১৪ সালের জুন থেকে গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে ৬ বছরে সরকার মোট ভর্তুকি দিয়েছে ৪২ হাজার ৮৫১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
গত ১০ বছরে সরকার ৫২ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয়। ভাড়ায় চালিত এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে তা ভর্তুকি দিয়ে বিতরণ করা হচ্ছে গ্রাহকের কাছে। প্রতি বছর ভর্তুকির পরিমাণ দফায় দফায় বাড়ছে।
পানির মূল্য বৃদ্ধি
গত ১২ বছরে ১৩ বার পানির দাম বাড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে বাসাবাড়ির জন্য প্রতি ইউনিট পানির দাম ছিল পৌনে ছয় টাকা।
প্রায় পৌনে তিন গুণ বেড়ে ২০২১ সালের জুলাইয়ে তা হয়েছে প্রায় সোয়া ১৫ টাকা। বাণিজ্যিক খাতে দাম বেড়েছে প্রায় সমহারে; ১৯ টাকা ১৫ পয়সা থেকে হয়েছে ৪২ টাকা।
শুধু পানির দাম নয়, প্রতিবারই সমহারে বেড়েছে স্যুয়ারেজ বিলও। ৩০ শতাংশেরও কম এলাকায় সেবা দিলেও পানির দামের সমান দরে প্রায় শতভাগ গ্রাহকের কাছে স্যুয়ারেজ বিল নিয়ে আসছে ওয়াসা।
এরপরও গত বছর থেকেই আবার পানির দাম ও স্যুয়ারেজ বিল বাড়ানোর চেষ্টা করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ গত ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ওয়াসার বোর্ড সভায় সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান এবার ৩৮ শতাংশ পানির দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব তোলেন।
বোর্ডের ১৩ সদস্যের মধ্যে তিনি ও চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা ছাড়া বাকি সবাই এর বিরোধিতা করেন। শেষ পর্যন্ত তার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা বলেন।
নগরবাসী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা ওয়াসা কখনোই বিশুদ্ধ পানযোগ্য পানি নগরবাসীকে সরবরাহ করতে পারেনি। এ জন্য বাধ্য হয়ে নগরবাসীর মধ্যে গভীর নলকূপ স্থাপনের প্রবণতা বাড়ছে। পাশাপাশি ঢাকা ওয়াসায় দুর্নীতি বেড়েছে অসহনীয় মাত্রায়। এ ছাড়া দুই বছর ধরে চলছে করোনাভাইরাসের মহামারি।
এ সময়ে মানুষের আয়-রোজগার অনেক কমেছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে জীবন-জীবিকা টিকিয়ে রাখাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সময়ে পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এতে করে নিম্ন ও সাধারণ আয়ের মানুষ ফুঁসে উঠতে পারে।
জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি
গত ১২ বছরে ছয়বার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। ফলে ২০০৯ সালের শেষেও যে ডিজেলের মূল্য ছিল ৪৪ টাকা লিটার, এখন তা হয়েছে ৮০ টাকা। দাম বেড়েছে প্রায় ৮২ শতাংশ।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি নাগরিকবান্ধব শহরে একজন ব্যক্তির যাতায়াত ব্যয় তার আয়ের ১০ শতাংশের কম হতে হবে। ১০ শতাংশ ব্যয়কে ‘কাট অব পয়েন্ট’ বলা হয়।
বিশ্বব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় যাতায়াত ব্যয় একজন মানুষের আয়ের প্রায় ২০ শতাংশ। এতেই বোঝা যায় মানুষ কতটা চাপে রয়েছে।
শুধু শহরের বাসিন্দা নয়, গ্রামের কৃষকও ভুগছে জ্বালানির দাম বৃদ্ধিতে। সরকারি হিসাবেই বছরে কৃষকের খরচ বেড়েছে ৭৫৪ কোটি টাকা। সেচের খরচ বাড়ায় বেড়েছে উৎপাদন খরচ। তাতে বেড়েছে দ্রব্যমূল্য।
শুধু বাস নয়, বেড়েছে লেগুনার ভাড়াও। মধ্যবিত্তের যান সিএনজিচালিত অটোরিকশাও ভাড়া বাড়িয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ দেখিয়ে। রাজধানীর জিগাতলা ও মোহাম্মদপুর থেকে ফার্মগেটের লেগুনার ভাড়া ছিল ১৫ টাকা। করোনা সংক্রমণ রোধে আসন অর্ধেক খালি রাখার শর্তের কারণে বেড়ে হয় ২৫ টাকা। এখন সব আসনে যাত্রী তোলা হলেও ২৫ টাকাই নেওয়া হচ্ছে।
সরকারের মিথ্যাচার
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) একটি যৌথ জরিপে সম্প্রতি জানানো হয়, দেশে করোনাকালে তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ জনজীবনকে স্থবির করে দেবে। শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধিকে থামিয়ে দেবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি কৃষি, পরিবহন, দ্রব্যমূল্য, শিল্প উৎপাদন থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। থমকে যায় অর্থনীতির অগ্রযাত্রা।
এরই মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এখন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বড় ধরনের দুর্যোগ দেখা দেবে। মূল্যবৃদ্ধির নিচে চাপা পড়া জনগণের জন্য তা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দেবে।
লোকসান কমাতে দাম বৃদ্ধির কথা বলা হলেও, গ্যাস ও বিদ্যুতের কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই লাভজনক। তারা প্রতি বছর সরকারি কোষাগারে কয়েক হাজার কোটি টাকা জমা দিচ্ছে।
উদ্বৃত্ত অর্থ, ট্যাক্স-ভ্যাট ও বিভিন্ন ফি হিসেবে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাত থেকে আয় করেছে সরকার। গ্যাস খাতের কোম্পানিগুলো শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশও দিয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাসও বাড়ছে ফি বছর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং নীতিনির্ধারকদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ব্যয় বাড়ছে দিন দিন। চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হওয়ায় বসিয়ে বসিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা দিতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের।
তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নজর না দিয়ে গ্যাস আমদানির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এতেও বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে সরকারের। খাত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম-অব্যস্থাপনা দূর না করে, বাস্তবাসম্মত পরিকল্পনা না নিয়ে দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ মূলত সরকারের ব্যর্থতার দায় জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার নামান্তর।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, গ্যাস সংকট জিইয়ে রেখে এলএনজির ব্যবসার দ্বার খোলা হয়েছে। সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যবসার মাধ্যমে নিজেদের পকেট ভরছেন।
এটা স্পষ্ট যে, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের লোকসান আসলে সংশ্নিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান ও দায়িত্বশীলদের অব্যবস্থাপনা, অবহেলা আর দুর্নীতির ফল। কিন্তু এর দায় মেটাতে হচ্ছে জনগণকে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২৫
আপনার মতামত জানানঃ