গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা কিছু হালকা কথাবার্তা ও বিএনপির ওপর লবিংয়ের দায় চাপিয়ে পার করতে চাইছেন। তবে সম্প্রতি জানা গেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের আসন্ন বৈঠকে বিশ্বের ২৪টি দেশের তিন শতাধিক গুমের ঘটনা নিয়ে আলোচনা হবে। ওই আলোচনায় বাংলাদেশে গুমের বেশ কিছু অভিযোগ নিয়েও ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্যরা কথা বলবেন।
এদিকে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা নিষেধাজ্ঞার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নানা কথা বলেছেন। এখন বিএনপির বিরুদ্ধে লবিংয়ের অভিযোগ এনে নানা ধরনের হাবিজাবি কথা বলে মাঠ গরমের চেষ্টা করছেন। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা মনে হয় মন্ত্রী-এমপিরা অনুধাবন করতে পারছেন না। নিষেধাজ্ঞার গুরুত্ব ও গভীরতাকে বুঝতে না পারার ব্যর্থতা তাদের রাজনৈতিক অপরিপক্বতার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জাতিসংঘের বৈঠকে বাংলাদেশের গুম প্রসঙ্গ
জাতিসংঘের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের এক নথিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গুমের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। কয়েক বছর ধরে এ নিয়ে উদ্বেগ জানালেও বাংলাদেশ কোনো সাড়া দিচ্ছে না। কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের কাছে গুমের বেশ কিছু অভিযোগ নিয়ে জানানো হলেও সেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
১৯৯৬ সাল থেকে ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে। বাংলাদেশ কেবল একটি গুমের অভিযোগের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। ওয়ার্কিং গ্রুপ অমীমাংসিত বাকি অভিযোগের বিষয়ে শিগগির জবাব দেবে বলে আশা করে। বাংলাদেশে গুমের ক্ষেত্রে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এগুলো দ্রুত তদন্ত করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া উচিত।
২০১৩ সাল থেকে গুমবিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশ সফরের অনুমতি পেতে বেশ কয়েকবার অনুরোধ জানিয়েছে। সর্বশেষ ২০২০ এপ্রিলে বাংলাদেশকে সফরের অনুরোধ জানিয়েও সাড়া পায়নি ওয়ার্কিং গ্রুপ।
গতকাল শুক্রবার জাতিসংঘের একটি কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গুমবিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং কমিটির ১২৬তম বৈঠক ৭ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। গুম বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের এই আসন্ন বৈঠকে বাংলাদেশে গুমের বেশকিছু অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হবে।
ভার্চ্যুয়াল ওই বৈঠকে দক্ষিণ কোরিয়ার তায়-উং বাইকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজন, ২৪টি দেশের সরকারি প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং অন্য অংশীজনদের সঙ্গে গুমের অভিযোগ, প্রক্রিয়াগত বিষয় এবং গুমের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলবেন।
জানা গেছে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের সুরক্ষাবিষয়ক সনদ ঘোষণার তিন দশক পূর্তি উপলক্ষে নির্দিষ্ট দেশ সফর এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়েও পাঁচ দিনের বৈঠকে আলোচনা হবে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ গত ডিসেম্বরে এক প্রতিবেদনে বলেছিল, বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশানা করতে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী চলমান এবং ঘন ঘন গুমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। গুমের এসব অভিযোগের বিষয়ে ওয়ার্কিং গ্রুপ তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য থাকার দাবি করেছে।
গুমবিষয়ক জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ওয়ার্কিং গ্রুপ গত বছরের ২০ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর ১২৫তম অধিবেশন শেষে প্রতিবেদন পেশ করে। পরে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর ওয়ার্কিং গ্রুপ তাদের প্রতিবেদনটি হালনাগাদ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ এবং সদস্যদেশগুলোর কাছে পাঠায়।
মার্কিন কংগ্রেসম্যানের নিষেধাজ্ঞাকে দৃঢ় সমর্থন
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব সদস্যদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তাতে দৃঢ় সমর্থন দিয়েছেন দেশটির কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য ও পররাষ্ট্রবিষয়ক হাউস কমিটির চেয়ারম্যান গ্রেগরি ডব্লিউ মিকস।
মিকস বলেছেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুতে গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিবিলিটি অ্যাক্ট অনুসারে র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের বিষয়ে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা আমি দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছি।’
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। গত শুক্রবার এই বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। সেখানেই মিকসের এই বক্তব্য প্রকাশিত হয়।
গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে মিকস আরও বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হতে পারে। এ ছাড়া আমি এটাও বিশ্বাস করি, এটি পুরো দেশের বিরুদ্ধে নয়।’
মিকস বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে আমি সহযোগিতা করে যাব।’ বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জের বিষয় নিয়ে কাজ করতে চান বলেও জানান তিনি।
এ ছাড়া বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, তা নিশ্চিত করতে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রবিষয়ক হাউস কমিটির এই চেয়ারম্যান।
ডেমোক্রেটিক পার্টির এই নেতা ১৯৯৮ সালে নিউইয়র্ক থেকে প্রথম প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০২১ সাল থেকে হাউস অব কমিটি অন ফরেন অ্যাফেয়ার্সের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য হওয়ার আগে ১৯৯২ সালে তিনি নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন।
নিষেধাজ্ঞাকে হালকাভাবে নিয়েছে সরকার
নিষেধাজ্ঞা পর প্রথমেই সরকারের মন্ত্রীরা লাগামহীনভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর কত মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়, তার হিসাব নিয়ে এলেন সামনে। সহযোগীরাও এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত দিতে শুরু করলেন। কয়েক দিন তারা কথার তুবড়ি ছোটালেন রীতিমতো।
এখানে বলে রাখি সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় ড্রোন হামলা করে আট লাখের বেশি বেসামরিক মানুষকে হত্যার বিষয়ে কিন্তু তারা কিছু বললেন না। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করতেই হয়, তবে এসব বেসামরিক নৃশংস হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। কিন্তু আমাদের সরকারের লোকেরা এ বিষয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেননি। কারণ, এই তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সুবিধাভোগী তারাও।
যুক্তরাষ্ট্রকে কেউ মানবাধিকারের পরম বন্ধু বলে মনে করে না। যেমন আমাদের দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে সরকারি প্রেসনোট কেউ বিশ্বাস করেন না। যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বেই শান্তি ও মানবাধিকারের জন্য যা করে বা করতে চায়, তা তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডার অংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনার পাশাপাশি যা শুরু হলো, তা আরও ভয়াবহ। এত বছর পর হুট করেই গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের কাছ থেকে মুচলেকা নিতে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন। স্বজনদের তরফেই এমন অভিযোগ উঠেছে। নির্বুদ্ধিতার একটি সীমা থাকে। অবস্থাদৃষ্টে বোঝাই যাচ্ছে, নিষেধাজ্ঞার পর বিভ্রান্ত হয়েই এসব করা হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন যদি মনে করেন, তাদের মুচলেকা নেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র নজরদারি করছে না, তবে তা মহা ভুল হিসেবে বিবেচিত হবে। তারা যদি ভেবে থাকেন, এসব মুচলেকা নিয়ে জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সরকার জমা দেবে এবং নিজেদের সাফসুতরো হিসেবে প্রমাণ করবে, তাহলে সেটা সরকারের জন্য খুবই বোকামি হবে।
এতে বরং বিপদ আরও বাড়বে; কমবে না কিছুতেই। সরকারের পক্ষ থেকে আরও একটি কথা বলা হয়েছে র্যাব নিয়ে। সেটি হচ্ছে, জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাস দমন র্যাব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ তার উপযোগিতা হারিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে নীতিকৌশল তৈরি করছে। এমনও হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদ দমনের নামে বেসামরিক লোককে হত্যার অভিযোগ এনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পৃথক অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে কথা বলতে হবে ও কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
নিষেধাজ্ঞায় জেরবার অবস্থার মধ্যেই মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে সরকারের যুক্তরাষ্ট্রে লবি নিয়োগের কিছু তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ওই সব প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সরকার গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ সামাল দিতে ওই সব লবি সংস্থাগুলোকে নিয়োগ করেছিল। এ জন্য সরকারের ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে। সরকারের লবি নিয়োগ নিয়ে আগেও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য এসব প্রতিষ্ঠানকে লবিস্ট না বলে পাবলিক রিলেশনস বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে।
সরকারের বিরুদ্ধে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ ধামাচাপা দিতে লবিস্ট নিয়োগের তথ্য প্রকাশের পর বিএনপির বিরুদ্ধেও লবিস্ট নিয়োগের অভিযোগ করা হয়েছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সম্প্রতি সংসদে বলেছেন, বিএনপি লবি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দুই মিলিয়ন টাকা দিয়েছে। এই অর্থকে তিনি অবৈধ ও কালোটাকা উল্লেখ করে বলেন, টাকা দেওয়ার প্রমাণ তার কাছে আছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
কিন্তু পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হয়তো খেয়াল করেননি তিনি কাচের ঘরে বসে বিএনপির দিকে ঢিল ছুড়ছেন। উল্লেখ্য, ২০০৪ ও ২০০৫ সালেও আওয়ামী লীগ যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট কোম্পানি নিয়োগ করেছিল। এসব মনে হয় সরকারের মন্ত্রীরা জানেন না বা ভুলে গেছেন
এসডব্লিউ/এসএস/২০৩৩
আপনার মতামত জানানঃ