করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন ঘরবন্দি শিশুরা অধিকাংশ সময় এখন অনলাইনে কাটায়। করোনা সংক্রমণের আগে বাচ্চারা বাবা-মায়ের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে যেতে পারত, এখন সেটাও করতে পারে না। ঘরবন্দি বাচ্চারা সময় কাটাতে মোবাইলকে বেছে নিচ্ছে। ঘুমের সময় ছাড়া বাকি সময় কাটছে মোবাইলের মাধ্যমে।
বাচ্চাদের হাতে উঠেছে মোবাইল কিংবা ল্যাপটপ, নোটবুক। যারা আগে এসব ডিভাইস থেকে দূরে ছিল তারাও হয়েছে আসক্ত। খেলার সময়, খাওয়ার আগে, অনলাইন ক্লাস, ঘুমের সময় ক্ষণে ক্ষণে চাই মোবাইল। আর এতে করে শিশুদের মাঝে ‘মায়োপিয়া’ বা চোখের ক্ষীণ দৃষ্টিজনিত রোগ বাড়ছে।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএস মট চিলড্রেনস হাসপাতালের তথ্যমতে, সাধারণত ৬ থেকে ১২ বছরের মধ্যেই ক্ষীণদৃষ্টির লক্ষণ দেখা যায়। সাধারণত কিশোর বয়সের শেষের দিকে দৃষ্টি আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও অনেকের চোখে এ সমস্যা থেকে যায়, কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর প্রথমবারের মতো দেখা দেয় এ সমস্যা।
চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. পল ব্রায়ার জানান, ক্ষীণদৃষ্টিতে আক্রান্ত প্রায় ২০ শতাংশ মানুষের এ সমস্যা দেখা দেয় ২০তম জন্মদিনের পর।
হিউস্টন কলেজ অব অপটোমেট্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক মার্ক বুলিমোর বলেছেন, সাধারণত যত আগে মায়োপিয়া শুরু হয়, তা ধীরে ধীরে ততই গুরুতর হয়।
এমনকি হালকা রকমের মায়োপিয়ার চিকিৎসার জন্য সময় এবং অর্থ উভয়ই প্রয়োজন। নিউ সাউথ ওয়েলস স্কুল অফ অপটোমেট্রি অ্যান্ড ভিশন সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদ্মজা শঙ্করিদুর্গ বলেন, ‘জীবনযাত্রার মানের মধ্যেও দৃষ্টিশক্তি খরচ পরিমাপ করা যায়, যা সংশোধনের করলেও উন্নতি হয় না অনেক সময়; কারণ কোনো চিকিৎসাই নিখুঁত নয়। চশমা ভুলে যাওয়া বা ভাঙলে লেন্স পরতে হয়। প্রায়ই পরিচ্ছন্নতা ছাড়া লেন্স ব্যবহার করা যায় না। চোখের প্রতিসরণজনিত অস্ত্রোপচারও ঝুঁকি বহন করে। আবার অস্ত্রোপচারের সুফল সবসময় স্থায়ী হয় না’।
শঙ্করিদুর্গর মতে, ‘মায়োপিয়ার চিকিৎসা খরচ সম্পর্কে জেনে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি প্রায় সারাজীবনের বোঝা হিসাবে বয়ে বেড়াতে হতে পারে’।
করোনার সময়ে মায়োপিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। কী পরিমাণ এমন রোগী রয়েছে তার পরিসংখ্যান না থাকলেও দেশের সবচেয়ে বড় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগের পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক।
গেল দুই বছরে এই হাসপাতাল থেকে সেবা নেওয়া মায়োপিয়া রোগী বেড়েছে ১০ শতাংশ। হাসপাতালের পরিসংখ্যান বলছে, করোনার আগে এই হাসপাতালে সেবা নেয়া রোগীর ২২ শতাংশ মাইয়োপিয়া আক্রান্ত রোগী পাওয়া যেতে। করোনা কারণে ঘরবন্দি থাকায় শিশুদের মধ্যে বেড়েছে এ রোগ। এখন বেড়ে ৩৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, প্রায় দুই বছর শিশুরা ঘরবন্দি। কাজ না থাকায় সারাক্ষণ স্ক্রিনে; দূরের জিনিস দেখেনি। ফলে তাদের দূরের দৃষ্টিশক্তি ঠিকমতো তৈরিই হচ্ছে না। আটবছর পর্যন্ত শিশুদের চোখের গঠনগত পরিবর্তন হতে থাকে। এই বয়সের শিশুরা যদি দূরের জিনিস না দেখে তাহলে আস্তে আস্তে দূরের দৃষ্টিশক্তিই হারিয়ে ফেলবে। বড় হওয়ার পরেও তাদের এই সমস্যা কাটবে না।
করোনাভাইরাস মহামারিতে ঘরে আটকে থাকা শিশুদের দৃষ্টিশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য বেরিয়ে এসেছে চীন ও হংকংয়ে পরিচালিত কয়েকটি গবেষণাতেও।
হংকংয়ের দ্য চায়নিজ ইউনিভার্সিটি অফ হংকং-এর একদল গবেষক দেড় বছরের বেশি সময় গবেষণা চালানোর পর বলছেন, দূরের বস্তু পরিষ্কার দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছে অনেক শিশু। তাদের নিবন্ধটি ব্রিটিশ জার্নাল অফ অফথমলজিতে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষকরা গত বছর ৬ থেকে ৮ বছর বয়সী ৭০৯ শিশুকে পর্যবেক্ষণ করে অনেকের মধ্যেই হ্রস্বদৃষ্টি বা মায়োপিয়ার লক্ষণ দেখতে পান। এ ধরনের শিশুরা কাছের বস্তুকে ভালোভাবে দেখতে পেলেও দূরের বস্তু ছিল ঘোলাটে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের তুলনায় করোনার প্রথম বছরে শিশুদের মায়োপিয়ায় আক্রান্তের হার বেড়েছে ১০ শতাংশ।
সাধারণত ৬ থেকে ১২ বছরের মধ্যেই ক্ষীণদৃষ্টির লক্ষণ দেখা যায়। সাধারণত কিশোর বয়সের শেষের দিকে দৃষ্টি আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও অনেকের চোখে এ সমস্যা থেকে যায়, কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর প্রথমবারের মতো দেখা দেয় এ সমস্যা।
আধুনিক জীবনে বিভিন্ন দেশেই মায়োপিয়া উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনের ৯০ শতাংশের মতো মানুষ হ্রস্বদৃষ্টির সমস্যায় আক্রান্ত, এ কারণে দেশটিতে মায়োপিয়াকে মহামারি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, চীনে ২০২০ সালে ৬ বছর বয়সী শিশুদের মায়োপিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে তিন গুণ বেড়েছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রকাশিত ওই গবেষণায় চীনে মায়োপিয়া বাড়ার কারণ হিসেবেও লকডাউনকে দায়ী করা হয়েছে।
ভুগতে পারেন প্রাপ্তবয়স্করাও
নর্থওয়েস্টার্ন মেডিসিনের চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ মিশেল আন্দ্রেওলি বলেছেন, ‘প্রাপ্তবয়স্করা ক্ষীণদৃষ্টিতে ভুগতে পারেন। কারণ তাদের চোখ যথেষ্ট লম্বা হতে থাকে’।
এতে স্বাভাবিকভাবেই তাদের বেশি দূরত্বের বস্তু দেখার দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়। কারো কারো শারীরবৃত্তীয় কারণে দূরদৃষ্টির প্রতি সামান্য প্রবণতা থাকতে পারে। তাদের ভিজ্যুয়াল ফোকাসিং সিস্টেমের পেশীগুলি এটির জন্য পরিবর্তিত হয়েছে। শারীরিক ক্লান্তি এসকল পেশীগুলিকে দূর্বল করে দিতে পারে। ফলে যৌবনের সময় মায়োপিয়া দেখা দেয়’।
কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তির শারিরীক অবস্থা ক্ষীণদৃষ্টিশক্তির জন্য দায়ী। এছাড়া সময়ের সাথে সাথে মায়োপিয়া বৃদ্ধি পাওয়া প্রমাণ করে যে ,পরিবেশও এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু মায়োপিয়ার পিছনে সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক কারণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। কারণ বেশিরভাগ গবেষণা প্রচলিত ‘শৈশবে মায়োপিয়া বিকাশের’ উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।
সাধারণত বলা হয় যে, পড়া-লেখা এবং অন্যান্য কাজ চোখকে ক্লোজ-আপ ক্রিয়াকলাপের (কাছাকাছি বস্তুর উপর ফোকাস করে কাজ করা) জন্য তার ফোকাসিং সিস্টেমকে অপ্টিমাইজ করার জন্য দীর্ঘায়িত করতে উত্সাহিত করে। সাধারণত কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় আমরা স্ক্রীনের দিকে ঝুঁকে পড়ি। এটি মায়োপিয়া বিকাশে ভূমিকা পালন করে।
যদিও বয়স্ক ব্যক্তিদের মায়োপিয়াকে আরও ভালভাবে বোঝার জন্য আরও গবেষণা করা প্রয়োজন। বর্তমান গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যারা আর অফিসে যাতায়াত করেন না, তাদের মধ্যে ক্ষীণদৃষ্টিজনিত সমস্যা বৃদ্ধি পেতে পারে।
গবেষক রিচম্যান বলেন, ‘যারা দিনে অন্তত তিনবার ঘরের বাইরে কাজ করেন, দূরে তাকান এবং একটানা কম্পিউটারের মতো ডিভাইস ব্যবহার করেন না, তাদের মধ্যে এ ধরনের জটিলতা খুব কম প্রকাশ পায়’।
প্রাপ্তবয়স্কদের মনে রাখা উচিত যে তারা মায়োপিয়ার ঝুঁকি মুক্ত নয়। তাদেরও নিয়মিত চোখের যত্ন নেওয়া উচিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কম্পিউটারে কাজ করার সময় ২০/২০/২০ (প্রতি ২০ মিনিটে ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০ ফুট দূরে একটি বস্তুর দিকে তাকানো) নিয়মটি অনুসরণ করা উচিত। পাশাপাশি, প্রতিদিন বাইরে সময় কাটানো এবং নিয়মিত চোখের পরীক্ষা করানো উচিত।
তাদের মতে, ‘মহামারি কয়েক বছর স্থায়ী হতে পারে, কিন্তু আমার চোখ চিরকাল আমার সাথেই থাকবে’।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৩
আপনার মতামত জানানঃ