বসন্ত যে শুধুমাত্র বাংলাদেশেই রঙিন ও বৈচিত্র্যময় ফুলের সমারোহ নিয়ে আসে, তা নয়। বসন্ত তার সুবাতাসে ও আপন গুণে রাঙিয়ে দেয় পৃথিবীর প্রায় সব দেশকেই।
যুক্তরাজ্যে একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, নির্ধারিত সময়ের মাসখানেক আগেই দেশটির গাছে গাছে ফুল ধরছে। এ জন্য বিজ্ঞানীরা দায়ী করছেন বৈশ্বিক উষ্ণতাকে।
উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে শরতের পাতা ঝরতে যেমন দেরি হচ্ছে, তেমনি গাছ ও গুল্মগুলোতে আবার তাড়াতাড়ি ফুল ফুটছে।
অনেকেই হয়তো ভাবছেন, ক্ষতি কি? মাসখানেক আগেই প্রেমিকাকে দিতে পারবেন রং-বেরঙের ফুল। কবিরাও ফুল নিয়ে এক মাস আগে থেকেই কবিতা লেখা শুরু করবেন। কিংবা ফুলবাগানে গিয়ে তুলির আঁচড় দেবেন কোনো কোনো চিত্রশিল্পী।
কিন্তু বেরসিক বিজ্ঞানীরা সেসব দিকে আর যাননি। তারা দেখছেন এই ঘটনার ঝুঁকিকে।
গবেষকরা বলছেন, গাছপালা ও পোকামাকড়-একে অপরের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল এবং দুটিই তাদের জীবনচক্রের সময়সীমা নির্ধারণে পরিবেশগত সূত্র। উদাহরণস্বরূপ, গাছপালা যদি তাদের আশেপাশের পরিবেশে উষ্ণতা বাড়ছে বলে বুঝতে পারে, তারা ফুল ফোটাতে শুরু করে এবং তাদের পাতা বিকশিত হয়। একইভাবে প্রাণীর ক্ষেত্রেও তাপমাত্রা বৃদ্ধি মানেই দ্রুত বৃদ্ধি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরবর্তনের ফলে এই নিয়ম অনেক বেশি বিঘ্নিত হচ্ছে।
বিভিন্ন তাপমাত্রার প্রভাবে এখন গাছ ও পোকামাকড় আলাদা আচরণ করতে পারে। অর্থাৎ আগে যেখানে তারা বসন্তে ফুল ফোটাতো, এখন পোকামাকড়েরা তৈরি হবার আগেই গাছে আগে ফুল ফুটছে অথবা তার বিপরীত চিত্র। অর্থাৎ এর ফলে পোকামাকড় আর খাদ্য হিসেবে গাছ থেকে কিছু পাচ্ছে না। আবার গাছও পর্যাপ্ত পরাগবহনকারী পাচ্ছে না।
জলবায়ু পরিবর্তন থেকে বাঁচতে কিছু গাছ ও প্রাণী প্রজাতি ইতিমধ্যেই নিজেদের ‘উচ্চ মাত্রা ও উচ্চ অক্ষাংশ’ তে নিয়ে গেছে বলে ২০০৯ সালের এক গবেষণায় পাওয়া যায়। কারণ তারা এই পরিবর্তিত বাস্তুসংস্থানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছিল না।
গবেষকরা আরো জানান যে বাস্তুসংস্থান এরকম বড় ধরনের ওঠানামার সঙ্গে অভ্যস্ত নয়। ভবিষ্যতে উৎপাদন আরো কমে যেতে পারে এবং বাস্তুসংস্থানও ভেঙ্গে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল শুধুই ফুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ফুল দেখতে সুন্দর, তাই লোকে তা ভালোবাসে বটে, কিন্তু বাস্তুসংস্থানে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখে এমন অন্যান্য অনেক গাছপালার জীবনচক্রেও পরিবর্তন এনেছে জলবায়ু সংকট।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল শুধুই ফুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ফুল দেখতে সুন্দর, তাই লোকে তা ভালোবাসে বটে, কিন্তু বাস্তুসংস্থানে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখে এমন অন্যান্য অনেক গাছপালার জীবনচক্রেও পরিবর্তন এনেছে জলবায়ু সংকট।
জানা যায় যে, একই রকম ঘটনা বিভিন্ন অর্থকরী ফসলের ক্ষেত্রেও ঘটছে যা কৃষকদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে। খরা, ফসলহানি ও পঙ্গপালের আক্রমণের ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে এর ফলে খাদ্য সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
এমনকি কিছু অঞ্চলে কৃষকরা হয়ত নিজেদের ফসল আবাদের ধরন বদলে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের এখনকার ফসল উৎপাদনের পক্ষে জলবায়ু অনেক উষ্ণ হয়ে উঠতে পারে। আবার অন্যদিকে বন্যা, তুষারপাত, বাতাসে জলবায়ুর পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। বিজ্ঞানীদের এর মতে, কৃষিকাজ এখন অনেকটা জুয়া খেলার মত হয়ে উঠেছে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন হুটহাট বাস্তুসংস্থান ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাসখানেক আগে ফুল ফোটার এ প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তবে তা পোকামাকড়, পাখিসহ পুরো বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া এই পরিবেশগত অমিল কৃষিকাজের উৎপাদনশীলতার ওপর নাটকীয় প্রভাব ফেলতে পারে, এমনটাই ধারণা করছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গবেষক উলফ বুন্টজেন।
বুন্টজেন বলেন, ‘আমাদের জলবায়ুব্যবস্থা এমনভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, যা আমাদের এবং আমাদের পরিবেশকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে।’
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এখন বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে বসন্ত তাড়াতাড়ি আসে এবং শরৎ অনেক জায়গায় দেরিতে আসে, ফলে প্রাণী ও গাছপালাগুলো একই হারে অভিযোজিত হচ্ছে না।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, প্রজাতিগুলো যদি একে অপরের সমন্বয়ের বাইরে চলে যায়, তবে তা বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিকে ‘ইকোলজিক্যাল মিসম্যাচ’ বলা হয়ে থাকে।
উদ্ভিদের পরাগ, মধু, বীজ ও ফল কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে পাখি এবং অনেক বন্যপ্রাণীর খাবার। ফলে যদি ফুল খুব তাড়াতাড়ি আসে, তবে তারা তুষারপাতে আক্রান্ত হতে পারে। ফলে গাছের ফল ও খাদ্যশস্য নষ্ট হবে। এর ওপর নির্ভর করা প্রাণিকুল ও পোকামাকড়ও খাদ্যসংকটে পড়তে পারে।
বিজ্ঞানীদের গবেষণার পরিধি ছিল দক্ষিণে চ্যানেল আইল্যান্ডস থেকে উত্তরে শেটল্যান্ড ও পশ্চিমে উত্তর আয়ারল্যান্ড পূর্বে সাফোক পর্যন্ত সমগ্র যুক্তরাজ্য এবং প্রায় ১৮ শতক থেকে প্রথম ফুল ওঠার তারিখ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।
ক্যামব্রিজের গবেষকরা ৪০৬টি উদ্ভিদ প্রজাতির প্রথম ফুলের তারিখগুলোকে জলবায়ু রেকর্ডের সঙ্গে তুলনা করে দেখেছেন যে সময়ের আগেই ফুল ফোটা বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সম্পর্কযুক্ত।
ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যে মৌলিক বাস্তুতন্ত্রে প্রভাব ফেলছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি যেমন পরিবেশগত, তেমনি একই সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকও বটে। উন্নত দেশগুলোর কারণেই এই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে তাদের কার্বন উদ্গিরণ হ্রাসে বাধ্য করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা, কার্যকর কূটনীতি ও রাজনীতি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ