দুর্নীতি, অদক্ষ প্রশাসন ও অর্থায়নের সীমাবদ্ধতাই বাংলাদেশে ব্যবসায় পরিবেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে এক জরিপে উঠে এসেছে। তবে ব্যবসায় পরিবেশের ক্ষেত্রে একজন বড় ব্যবসায়ী যেভাবে বাধা মোকাবিলা করতে পারেন, সেটা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীর জন্য অনেক কঠিন। তাই ব্যবসায় এ ধরনের ব্যবসায়ীর টিকে থাকা আরও বেশি চ্যালেঞ্জের।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) পরিচালিত ‘বাংলাদেশে ব্যবসায় পরিবেশ ২০২১’ শীর্ষক উদ্যোক্তা মতামত জরিপের ফলাফলে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সিপিডি গতকাল বুধবার এ জরিপের ফলাফল তুলে ধরে। এ উপলক্ষে রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘ব্যবসায় পরিবেশ ২০২১: উদ্যোক্তা মতামত’ শীর্ষক জরিপের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
সিপিডি গত বছরের এপ্রিল, জুন, জুলাই—এই তিন মাস ঢাকা, চট্টগ্রাম নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও ফরিদপুরের ৭৩টি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের ওপর এই জরিপ চালায়। এর মধ্যে ৩৯টি বড়, ১৭টি মাঝারি, ১২টি ছোট এবং পাঁচটি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান।
জরিপে অংশ নেওয়া ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, দুর্নীতির পর অদক্ষ আমলাতন্ত্র ব্যবসার জন্য আরেকটি বাধা। এ ছাড়া ৫৫ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, অর্থায়নে সীমাবদ্ধতাও ব্যবসার জন্য আরেকটি বড় সমস্যা।
জরিপের তথ্য বলছে, দেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে দুর্নীতি, ৬৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। এর পরই রয়েছে অদক্ষ সরকারি আমলাতন্ত্রের ভূমিকা ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা রয়েছে ৫৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এছাড়া ব্যবসার প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে দুর্বল অবকাঠামো ৪৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ, পলিসিগত সমস্যা ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ, শ্রমিকের স্বাস্থ্য ৩৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ, উচ্চকর হার ৩৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ, কর ব্যবস্থাপনার জটিলতা ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ, শিক্ষিত কর্মীর অভাব ২৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
এগুলোর পাশাপাশি উদ্ভাবন সামর্থ্য না থাকা, শ্রমিকদের নৈতিকতার অভাব, অপরাধ ও চুরি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি ও শ্রম আইনের সীমাবদ্ধতার মতো বিষয়গুলো দেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরিতে ভূমিকা রাখছে।
তবে প্রতিষ্ঠানভেদে এসব সমস্যার ভিন্নতা রয়েছে বলে জানান সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বড় ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে এর হার ও তীব্রতা তুলনামূলক কম। তবে ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে এসব সমস্যা অনেক বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। এছাড়া মহামারী-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য তিন বছরের বেশি সময় প্রয়োজন। ব্যবসায়ীরা আগের অবস্থানে ফিরে এসেছেন বা দ্রুত আসবেন এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
সিপিডির জরিপ বলছে, অর্থনৈতিক খাতের জন্য শীর্ষ ঝুঁকির মধ্যে বৃহৎ অর্থনীতিতে ঋণ সংকট রয়েছে ২৬ শতাংশ, অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তার ২৩ শতাংশ এবং বৃহৎ অর্থনৈতিক প্রকল্পে দুর্বল বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার অবদান ১৬ শতাংশ। এছাড়া এক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি করছে জলবায়ুগত ব্যর্থতা, পরিবেশে মানবসৃষ্ট ক্ষতি, ভূরাজনৈতিক সমস্যা, সামাজিক খাতে কর্মসংস্থান ও জীবিকার সংকট, সংক্রামক রোগ এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার পতনের মতো বিষয়গুলো। একই সঙ্গে রয়েছে প্রযুক্তিগত ঝুঁকিও। ডিজিটাল অসমতা, সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা ও প্রযুক্তিগত সুশাসনের ব্যর্থতাও আর্থিক খাতে ঝুঁকি তৈরি করছে।
জরিপে অংশ নেওয়া ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, দুর্নীতির পর অদক্ষ আমলাতন্ত্র ব্যবসার জন্য আরেকটি বাধা। এ ছাড়া ৫৫ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, অর্থায়নে সীমাবদ্ধতাও ব্যবসার জন্য আরেকটি বড় সমস্যা।
জরিপে অংশ নেওয়া ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী, ব্যবসার ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তারা বলেছেন, ব্যবসার জন্য বিভিন্ন পরিষেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁদের আর্থিক লেনদেন করতে হয়েছে। দুর্নীতির পর অদক্ষ আমলাতন্ত্রকে ব্যবসার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ব্যবসায়ীরা। জরিপে অংশ নেওয়া ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী এ মতামত দিয়েছেন। আর ব্যবসার ক্ষেত্রে পুঁজির জোগানের সংকটের কথা বলেছেন ৫৫ শতাংশ ব্যবসায়ী। ৪২ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি পরিস্থিতি এখন বেশ চাপে আছে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা আগামী দুই বছরে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়া, অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরির হওয়ার আশঙ্কা করছেন।
এর আগে সর্বশেষ জরিপটি করা হয়েছিল ২০২০ সালে। সেবার ব্যবসার পরিবেশ জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীদের সিংহভাগই ব্যবসা করার ক্ষেত্রে অদক্ষ প্রশাসনকে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ওই জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীরা দুর্নীতিকে দ্বিতীয় ও পুঁজি বা অর্থায়নের সমস্যাকে তৃতীয় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেন। আর এবারের জরিপে ব্যবসার প্রধান অন্তরায় হিসেবে শীর্ষে উঠে এসেছে দুর্নীতি।
সিপিডি বলছে, দুর্নীতির কারণে বড় ব্যবসায়ীদের তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা। জরিপে অংশ নেওয়া ৫২ শতাংশ বড় ব্যবসায়ী বলেছেন, দুর্নীতির কারণে তাদের ব্যবসা ব্যাহত হয়েছে। আর ১০০ ভাগ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেছেন, দুর্নীতির কারণে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীদের কাছে প্রশ্ন ছিল, করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কত সময় লাগতে পারে বলে তারা মনে করছেন। জবাবে ৪৫ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, তিন বছরের বেশি সময় লাগবে। তাদের হিসাবে, ২০২৫ সালে গিয়ে দেশের অর্থনীতি ক্ষতি কাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। আর ৭ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে এক বছরের কম সময় লাগবে।
ব্যবসায়ীদের মতামতভিত্তিক জরিপটি করা হয়েছিল করোনাকালে। তাই স্বাভাবিকভাবে ব্যবসায়ীদের কাছে করোনার প্রভাব ও ক্ষতি পোষাতে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় এ জরিপে। জবাবে ২৮ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, করোনার প্রভাবে বাধ্য হয়ে তাদের খরচ কমাতে হচ্ছে। সে কারণে কমাতে হচ্ছে শ্রমিক। ২২ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, তারা নতুন ক্রেতার সঙ্গে কাজ করছেন। আর ১৯ শতাংশ বলেছেন, তারা ব্যবসা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন।
করোনার ক্ষতি পোষাতে সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, জরিপে সে বিষয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। জবাবে ৬৩ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, সরকারের প্রণোদনা বাস্তবায়নে নজরদারি ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। করোনার কারণে স্বাস্থ্য খাতকে অন্যতম সমস্যাগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া কর হার, কর ব্যবস্থাপনা এবং অদক্ষ শ্রমিককে ব্যবসার পথে নতুন বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আগামী ১০ বছরে দেশে নতুন বেশ কিছু ব্যবসার খাত তৈরি হবে বলে জরিপে উঠে এসেছে। ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, ডিজিটাল আর্থিক সেবা আরও বিকশিত হবে। দক্ষ মানবসম্পদ খাতকে সম্ভাবনার দ্বিতীয় অবস্থানে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। তৃতীয় অবস্থানে আছে তথ্য-উপাত্ত (ডেটা) ব্যবস্থাপনা।
কভিড-পরবর্তী ব্যবসা পুনরুদ্ধারে অন্তত তিন বছর সময় প্রয়োজন হবে বলে জরিপে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। তাই এখন যে পুনরুদ্ধার দেখা যাচ্ছে তা আংশিক পুনরুদ্ধার বলে জানায় সিপিডি। এক বছরের মধ্যে পুনরুদ্ধার সম্ভব, এমনটা বলেছেন মাত্র ৭ শতাংশ ব্যবসায়ী। অন্যদিকে ৪৫ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে তিন বছরের বেশি সময় তাদের প্রয়োজন।
ব্যবসা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে আর্থিক প্রণোদনা, কর হ্রাস, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও অর্থায়ন সহজলভ্য করার পরামর্শ দিয়েছেন বেশিরভাগ ব্যবসায়ী, যা আগামী বাজেটে সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে পারে। ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন ব্যয় কমানোর বিষয়ে। ব্যবসায় ব্যয় কমানোর ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় বিষয়টি শ্রমিক কমানো। ২৮ শতাংশ ব্যবসায়ী বলছেন, বাধ্য হয়ে তাদের ব্যয় কমানোর পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।
আগামী দুই বছরের জন্য বৈশ্বিক কী কী ঝুঁকি দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য তৈরি হতে পারে, এমন প্রশ্নে তারা জানিয়েছেন অর্থনৈতিক, পরিবেশগত, ভূরাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। অর্থনৈতিক ঝুঁকির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা যেগুলো বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বড় দেশগুলোর ঋণ বা দায়ের সংকট, যা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এ ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বড় দেশগুলোতে যদি সংকট তৈরি হয়, তা আমাদের আমদানি, রপ্তানি ও ঋণ সম্পর্ক সংকুচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জরিপের ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘দুর্নীতি, অদক্ষ আমলাতন্ত্র ও পুঁজির জোগানের সীমিত সুযোগ—এ তিন চ্যালেঞ্জ ব্যক্তি খাতের জন্য সুখকর নয়। অথচ দেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশই আসে ব্যক্তি খাত থেকে। উল্লেখিত প্রতিবন্ধকতার কারণে ব্যক্তি খাত সামনে এগোতে পারছে না। তাই আমরা আশা করব, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টির দিকে নজর দেবেন।’
অনুষ্ঠানে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হচ্ছে। তবে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে সেটি বৈষম্যমূলক। সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ যাদের হাতে যাওয়ার কথা তারা পাচ্ছে না। বরং দুর্নীতি, অদক্ষ প্রশাসন ও টাকা পেতে সীমাবদ্ধতা এ ত্রয়ী চ্যালেঞ্জের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বড় ধরনের চাপে রয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১২
আপনার মতামত জানানঃ