মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর হামলা। ওই হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এখন তারা বাংলাদেশেও আধিপত্য বিস্তার করছে। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে মাদক বিক্রি, মানবপাচার, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি ও মাদকের টাকায় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের কাজ করছে ‘আল-ইয়াকিন’। এই বাহিনী বাংলাদেশিদের অপহরণ করে নির্জন পাহাড়ে নিয়ে যায়। এরপর হাত-পা ও চোখ বেঁধে চলে নির্মম নির্যাতন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবিকৃত টাকা পেলে ছেড়ে দেওয়া হয়, না হলে পাহাড়ে গর্ত করে পুঁতে ফেলে। কক্সবাজারে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নামেও এরা পরিচিত। কক্সবাজারবাসী এদের ‘জঙ্গি বাহিনী’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ উপজেলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অদূরে গহীন অরণ্যে ফের অস্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপন করে ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র তৈরি করছে সশস্ত্র রোহিঙ্গা সংগঠন আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। ক্যাম্পগুলোতে সক্রিয় ক্যাডারদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতেই এসব কারখানা স্থাপন করছে সংগঠনটি।
আরসা কমান্ডাররা ক্যাম্পের পাহাড়ে এরই আগেও অস্ত্র তৈরির কারখানা বসিয়েছিল। গত বছরের নভেম্বরে উখিয়ার কুতুপালং মধুরছড়া ক্যাম্পের পাশের পাহারে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র তৈরির কারিগরসহ তিন আরসা ক্যাডারকে গ্রেফতার করেছিল র্যাব। উদ্ধার করা হয়েছিল চারটি অস্ত্র এবং অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম। ঐদিন ভোরে অভিযান টের পেয়ে র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।
দীর্ঘ চার ঘণ্টা গুলি বিনিময়ের পর রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা পিছু হটলে কারখানা থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করতে সক্ষম হয় র্যাব।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আরসা সদস্যরা আবারো উখিয়া-টেকনাফের গহীন অরণ্যে একাধিক অস্ত্র তৈরির ভ্রাম্যমাণ কারখানায় চালু করেছে।
৮ এপিবিএনের অধিনায়ক এসপি শিহাব কায়ছার খান বলেন, এ ধরনের অস্ত্র তৈরির কারখানার কথা আমরাও শুনেছি কিন্তু কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। আরসা-আল ইয়াকিনসহ যেকোনো ধরনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা কঠিন হাতে দমন করার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে।
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ উপজেলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অদূরে গহীন অরণ্যে ফের অস্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপন করে ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র তৈরি করছে সশস্ত্র রোহিঙ্গা সংগঠন আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। ক্যাম্পগুলোতে সক্রিয় ক্যাডারদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতেই এসব কারখানা স্থাপন করছে সংগঠনটি।
জানা গিয়েছে, মিয়ানমারের এই সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) নিজেদের আরও মজবুত করতে এবার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে তাদের নিজস্ব মুদ্রা চালু করেছে। প্রাথমিকভাবে কয়েকটি ক্যাম্পে এ মুদ্রা চালু করলেও পর্যায়ক্রমে সব ক্যাম্পেই এ মুদ্রা চালু করতে চায় তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের গ্রুপে তারা এ মুদ্রার পক্ষে প্রচারণাও শুরু করেছে।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের একাধিক সূত্র জানায়, আরসার সদস্যরা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নতুন মুদ্রার বিষয়ে প্রচার শুরু করেছে কয়েকমাস আগে। কিছু কিছু ক্যাম্পে এরই মধ্যে নতুন মুদ্রা দিয়ে বিনিময় শুরু হয়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই আরসার নিয়ন্ত্রণাধীন ক্যাম্পগুলোতে নতুন মুদ্রা দিয়ে বিনিময় পুরোদমে শুরু হবে। প্রাথমিকভাবে এক হাজার, ৫০০ এবং ১০০ টাকার নতুন নোট ছেড়েছে আরসা। মুদ্রায় রয়েছে আরসার নেতা আতাউল্লার ছবি।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন সক্রিয়। তবে সব চেয়ে বেশি বিচরণ করছে ‘আরসা’। বাংলাদেশের ৩২টি রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের মধ্যে ২৭টিতেই রয়েছে আরসার একক আধিপত্য।
সৌদি আরবে বেড়ে ওঠা পাকিস্তানি নাগরিক আবু আম্মর জুনুনি ওরফে আতাউল্লাহ বর্তমানে আরসার একটি অংশের নেতৃত্বে রয়েছে। আতাউল্লার নেতৃত্বাধীন আরসা পাঁচটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে শরণার্থী ক্যাম্পে তৎপরতা চালাচ্ছে। এ শ্রেণিগুলি হচ্ছে- ‘ওলামা কাউন্সিল’, ‘ওলামা বোর্ড’, ‘মজলিসে আম’ এবং ‘আরকান আরমট’। তারা শরণার্থী ক্যাম্পে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি কিশোরী-তরুণী থেকে মাদক ও মানব পাচার, ডাকাতি অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি-সহ নানান অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি ক্যাম্পে নিজেদের অবস্থান আরও সুসংহত করতে নিজস্ব মুদ্রা চালু করেছে।
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আগে ইংরেজীতে ‘ফেইথ মুভমেন্ট’ নামে তাদের তৎপরতা চালাতো। স্থানীয়ভাবে এটি পরিচিত ছিল ‘হারাকাহ আল ইয়াকিন’ নামে। মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে একটি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী বলে ঘোষণা করে।
মিয়ানমারের সূত্র মতে, এই গ্রুপটির নেতৃত্বে রয়েছে রোহিঙ্গা জিহাদীরা, যারা বিদেশে প্রশিক্ষণ পেয়েছে। তবে সংগঠনটি কত বড়, এদের নেটওয়ার্ক কতটা বিস্তৃত, তার কোন পরিস্কার ধারণা তাদের কাছেও নেই।
মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের ধারণা, এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছে ‘আতাউল্লাহ’ নামে একজন রোহিঙ্গা। তার জন্ম করাচীতে, বেড়ে উঠেছে সৌদি আরবে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ তাদের এক রিপোর্টে বলছে, সংগঠনটি মূলত গড়ে উঠেছে সৌদি আরবে চলে যাওয়া রোহিঙ্গাদের দ্বারা।
মক্কায় থাকে এমন বিশ জন নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা এই সংগঠনটি গড়ে তোলে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতে এদের যোগাযোগ রয়েছে। সংগঠনটির নেতা আতাউল্লাহ ‘আবু আমর জুনুনি’ নামেও পরিচিত। আতাউল্লাহর বাবা রাখাইন থেকে পাকিস্তানের করাচীতে চলে যান। সেখানেই আতাউল্লাহর জন্ম। তিনি বেড়ে উঠেছেন মক্কায়। সেখানে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন।
ইউটিউবে তার একটি ভিডিও থেকে ধারণা করা হয়, রাখাইনের রোহিঙ্গারা যে ভাষায় কথা বলে সেটি এবং আরবী, এই দুটি ভাষাই তিনি অনর্গল বলতে পারেন। ২০১২ সালে আতাউল্লাহ সৌদি আরব থেকে অদৃশ্য হয়ে যান। এরপর সম্প্রতি আরাকানে নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর তার নাম শোনা যায়।
আরাকানে যারা এই সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত, তাদের আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ আছে বলে মনে করা হয়। স্থানীয় রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই সংগঠনটির প্রতি সমর্থন এবং সহানুভূতি আছে।
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা ‘আরসা’ ২০১৭ সালের মার্চে এক বিবৃতিতে একেবারে খোলাখুলিই জানিয়েছিল, তারা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে এবং তাদের ‘আত্মরক্ষা-মূলক’ হামলার মূল টার্গেট হচ্ছে মিয়ানমারের ‘নিপীড়নকারী শাসকগোষ্ঠী’।
আরসার প্রধান দাবি হচ্ছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব এবং সমান মর্যাদা দিতে হবে। ‘আরসা’ তাদের এই বিবৃতিতে আরও জানায়, তারা বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে কোন ধরণের সন্ত্রাসবাদী কাজে লিপ্ত নয়। তাদের অধিকার আদায়ের জন্যও তারা সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসী নয়। বিশ্বের কোন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গেও তাদের কোন সম্পর্ক নেই। এমনকি তারা রাখাইনের বিভিন্ন ধর্মের ও জাতির মানুষকে এবং তাদের ধর্মীয় উপাসনার স্থানের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দিচ্ছে।
সূত্র মতে, বর্তমানে আল-ইয়াকিনের প্রায় দুই হাজার সদস্য রয়েছে কক্সবাজারে। দেড়শ’র মতো নারী সদস্যও রয়েছে তাদের। কক্সবাজার ও টেকনাফের প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তারা। তবে কুতুপালং ও বালুখালিতে তাদের সদস্য সংখ্যা বেশি।
কক্সবাজার পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে আল-ইয়াকিনের হাতে কমপক্ষে ২৫ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি নাগরিক খুন হয়েছেন। প্রায়ই স্থানীয়দের (বাংলাদেশি) অপহরণ করে তারা। নির্জন পাহাড়ে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়ের সংবাদও শোনা যায়। ভুক্তভোগী এমন বেশ কয়েকটি পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ পাহাড়ে অভিযান চালায়। তবে এখন পর্যন্ত এ চক্রের একজন সদস্যকেও গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বিশ্লেষকরা বলেন, ‘সরকারের উচিত মাথাচাড়া দেওয়ার আগে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। নইলে এসব সংগঠন বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ এখনও কঠোর অবস্থান না নিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে নানা ধরনের সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতা, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠীর উস্কানি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবর ইতোমধ্যেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আসতে শুরু করেছে। এসব অপতৎপরতা দীর্ঘমেয়াদে এই অঞ্চলের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।
আরও বলেন, এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে আরও বেশি গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় আনা এবং তাদের প্রত্যাবাসনে যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২০
আপনার মতামত জানানঃ