সম্প্রতি ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। মিয়ানমারভিত্তিক আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) পরিচয়ধারী সন্ত্রাসীরা নতুন ছক নিয়ে এগোচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী এই সংগঠনটি ক্যাম্পের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া। চাঁদাবাজি, অপহরণ, মাদক চোরাচালান ও আশপাশ এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যে একক প্রভাব রাখতে চায় তারা।
এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক আরেক সংগঠন ‘ইসলামী মাহাজ’কে রুখতেও আগ্রাসী আরসা। তারা মনে করে, জনপ্রিয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর আদর্শে বিশ্বাসী ইসলামী মাহাজ শক্তিশালী হলে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করা আরসার পক্ষে কষ্টসাধ্য হবে। এ ছাড়া সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে ধারাবাহিক গোলাগুলির পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী চক্রের আনাগোনা বেড়েছে। যারা বাইরে ছিল তাদের কেউ কেউ ক্যাম্পে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
গত চার মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছয় মাঝিসহ অন্তত ২০ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্য সাতজন স্বেচ্ছাসেবক। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার দুই রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়।
রোহিঙ্গা নেতারা জানিয়েছেন, সম্প্রতি আরসা পরিচয়ে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাকে হুমকি দেওয়া হয়। প্রশাসনকে সহায়তা করলে তাদের পরিণতি ভালো হবে না বলে শাসানো হয়। হুমকি যারা পেয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আবুল বাশার, হাবিব, আয়াজ ও নুর আমিন। তাদের অনেককে বলা হয়- ক্যাম্পের ভেতরে যেসব দোকান রয়েছে, সেখান থেকে মাসিক চাঁদা পেতে আরসাকে দিতে হবে। আবার ইসলামী মাহাজকে বার্তা পাঠানো হয়েছে- ক্যাম্পে থাকতে হলে আরসাকে ভাগ দিতে হবে।
একাধিক রোহিঙ্গা মাঝি গণমাধ্যমকে জানান, একসময় আরসার পরিচয়ধারী সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পে টাকার বিনিময়ে বিচার-সালিশ বসাত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রতিরোধের মুখে কিছু দিন তারা কোণঠাসা হয়ে পড়লেও আবার নতুনভাবে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। আরসা নেতা পরিচয়ধারী ইয়াহিয়া চারটি বিয়ে করেন। বছর খানেক আগে মালয়েশিয়া প্রবাসী এক রোহিঙ্গা তরুণের স্ত্রীর সঙ্গে অশালীন আচরণ করলে সাধারণ রোহিঙ্গারা তাকে হাতেনাতে ধরে পুলিশে দেয়। নারী নির্যাতন, ইয়াবা কারবারের মামলায় তিন দফা কারাগারে যাওয়ার পর আবার জামিনে বেরিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে সে। এখন আরসা ‘সিঙ্গেল অ্যাটাক’ করার কৌশল নিচ্ছে।
উখিয়ার একটি ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, আরসা ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গাদের হুমকি-ধমকি দিয়ে জোর করে তাদের দলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তারা নতুন সদস্য সংগ্রহ করছে। তাদের দলে যোগ না দিলে হত্যার হুমকিও দিচ্ছে। হুমকিদাতা কয়েকজনকে শনাক্ত করেছে প্রশাসন।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, নেতা মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত নিতে কাজ শুরু করেছিলেন। আন্তর্জাতিক মহলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন রোহিঙ্গা মুখপাত্র হিসেবে। এটা মেনে নিতে পারেননি আরসার সদস্যরা। প্রত্যাবাসনের পক্ষে কেউ কাজ করলেও আরসার রোষানলে পড়তে হয়। আরও টার্গেট কিলিংয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভীতি ছড়াতে আরসার একের পর এক মাঝি ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিশানা করছে।
২০২১ সালের ২২ অক্টোবর ক্যাম্প-১৮ এর একটি মাদ্রাসায় ৬ জনকে হত্যা করা হয়। এর আগে ২৯ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে।
১৪-এপিবিএনের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) সৈয়দ হারুন অর রশীদ গণমাধ্যমকে বলেন, মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির কারণে শূন্যরেখার ক্যাম্প থেকে কৌশলে অনেক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে ঢুকে পড়েছে। মূলত তারাই ক্যাম্পে নতুন করে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই সন্ত্রাসীদের ধরতে এপিবিএন প্রতিদিন কৌশল বদলে অভিযান চালাচ্ছে।
রোহিঙ্গারা যাতে নিজ দেশে ফিরে না যায় এজন্য আরসা প্রতিনিয়ত ক্যাম্পে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) নেতা সৈয়দ মাহামুদ জানান, যারা প্রত্যাবাসনের পক্ষে এবং মাদক ও মানব পাচারসহ রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন অপরাধ ঠেকাতে কাজ করছে তারা ক্যাম্পে ভয়ে আছে। রোহিঙ্গারা যাতে নিজ দেশে ফিরে না যায় এজন্য আরসা প্রতিনিয়ত ক্যাম্পে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর হামলা। ওই হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এখন তারা বাংলাদেশেও আধিপত্য বিস্তার করছে। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে মাদক বিক্রি, মানবপাচার, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি ও মাদকের টাকায় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের কাজ করছে ‘আল-ইয়াকিন’।
এই বাহিনী বাংলাদেশিদের অপহরণ করে নির্জন পাহাড়ে নিয়ে যায়। এরপর হাত-পা ও চোখ বেঁধে চলে নির্মম নির্যাতন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবিকৃত টাকা পেলে ছেড়ে দেওয়া হয়, না হলে পাহাড়ে গর্ত করে পুঁতে ফেলে। কক্সবাজারে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নামেও এরা পরিচিত। কক্সবাজারবাসী এদের ‘জঙ্গি বাহিনী’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৎপর রয়েছে ইসলামী মাহাজ নামে আরেকটি সংগঠন। পাঁচ শরণার্থী ক্যাম্পে রয়েছে নতুন সংগঠনটির তৎপরতা। এ সংগঠনের নেপথ্যে রয়েছেন জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বার্মার কয়েকজন নেতা। এ সংগঠনের আমির শেখ সালামত নামে এক ব্যক্তি।
রোহিঙ্গাদের দুর্গতি পুঁজি করে ক্যাম্পগুলোতে শক্ত ঘাঁটি বানিয়েছে জঙ্গিরা। ৩৪ টি ক্যাম্পের সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে লুকিয়ে আছে ১৪টি সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রায় ৫ হাজার সক্রিয় ক্যাডার।
বিশ্লেষকরা বলেন, ‘সরকারের উচিত মাথাচাড়া দেওয়ার আগে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। নইলে এসব সংগঠন বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ এখনও কঠোর অবস্থান না নিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে নানা ধরনের সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতা, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠীর উস্কানি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবর ইতোমধ্যেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আসতে শুরু করেছে। এসব অপতৎপরতা দীর্ঘমেয়াদে এই অঞ্চলের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৮
আপনার মতামত জানানঃ