অনুপম সৈকত শান্ত
‘সৎ’ (ইংরেজিতে honest) শব্দটির নারীবাচক শব্দ ‘সতী’। আর, বিপরীত শব্দ অসৎ (dishonest) এর নারীবাচক শব্দ হচ্ছে অসতী। ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে সতী বিশেষণ পদের বিশেষ্য রূপ হচ্ছে সতীত্ব, অর্থাৎ যা থাকলে একজন সতী হয়, না থাকলে হয় অসতী, তাই হচ্ছে সতীত্ব! কিন্তু, ব্যবহারিক বাংলায় সতী শব্দটি বলতে সাধারণভাবে honest বুঝায় না, অসতী বলতেও dishonest বুঝায় না, তেমনি সতীত্ব শব্দটি honesty বুঝাতে ব্যবহৃত হয় না। ইংরেজিতে সতীত্বের কাছাকাছি শব্দ হচ্ছে chastity (the state or practice of refraining from extramarital, or especially from all, sexual intercourse.), অর্থাৎ কোন নারীর বিবাহ বহির্ভুত যৌন সম্পর্কে লিপ্ত না হওয়ার অবস্থাকে বলা হয় সতীত্ব। একইভাবে সতী হচ্ছে সেই নারী যে বিবাহ বহির্ভুত কোন সম্পর্কে জড়ায় না, আর অসতী হচ্ছে সেই নারী যে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়! ফলে, সতী, অসতী ও সতীত্ব শব্দ তিনটি যদিও ‘সৎ’ শব্দটি থেকে উদ্ভুত, কিন্তু ব্যবহারিক অর্থের দিক থেকে এটি ‘সৎ’ শব্দ থেকে আলাদা। শব্দ তিনটিই কেবল ও কেবলমাত্র নারীর জন্যে প্রযোজ্য এবং শব্দ তিনটির লিঙ্গান্তরী পুরুষবাচক বাংলা প্রতিশব্দ নেই। কেউ কেউ ব্লগে, ফেসবুকে পুরুষের chastity অর্থে ‘সতত্ব’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন, যদিও সতত্ব বলে বাংলা অভিধানে কিছু নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলা ভাষায় নারীর বিবাহ বহির্ভুত যৌন সম্পর্ক থাকা না থাকার সাথে যুক্ত শব্দ তিনটির সাথে ‘সততা’র সম্পর্ক কতখানি? যে নারী ‘অসতী’, সে কি সততার বরখেলাপ করছে? হ্যাঁ, একজন অসতী নারী অসৎ (dishonest) – তার মালিকানা যে পুরুষের তার কাছে, মানে তার বিয়ে করা স্বামীর কাছে। একজন নারী যে তার বিয়ে করা স্বামী ব্যতীত অন্য কোন ‘পরপুরুষ’ এর সংস্পর্শেও আসেনি, সে নারী তার স্বামীর কাছে সৎ (honest), সেখান থেকেই সে সতী। এভাবেই নারীর ‘সতী’ ও ‘অসতী’ শব্দটির উৎপত্তি, যেখানে নারীর একমাত্র কাজ হচ্ছে স্বামীর সংসারে থাকা, স্বামীর পদসেবা করা ও স্বামীর সন্তানদের দেখভাল করা! বিনিময়ে সে থাকা-খাওয়ার খোরাকি পাচ্ছে, ফলে স্বামীপ্রভুর বাইরে অন্য কারোর সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া মানেই তো স্বামীর সাথে অসততা! সে জায়গা থেকে নারীর সতী ও অসতী হওয়া! মজার বিষয় হচ্ছে, যে নারী এখনো বিয়েই করেনি, মানে যার স্বামী নেই, তারও পরপুরুষের সাথে সম্পর্কের জেরে তাকে অসতী বলা হয়, নারীকে বিয়ের আগ পর্যন্ত সতী হিসেবে রাখার দায়িত্ব তার বাবামা’র! এক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে তার স্বামীই নেই, সেখানে সে কার কাছে সতী বা অসতী হবে? জবাব হচ্ছে, তার ভবিষ্যৎ স্বামীর কাছে। অর্থাৎ এখন যে নারী কোন পরপুরুষের সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছে, সে তার ভবিষ্যৎ স্বামীর সাথে অসৎ আচরণ করছে! আরো, মজার প্রশ্ন হচ্ছে যে নারীর বর্তমানে স্বামী নেই, এবং ভবিষ্যতেও বিয়ে করবে না, তাহলে সে কার প্রতি সতী বা অসতী হবে? বিধবা নারীর ক্ষেত্রে, তাকে তার মৃত স্বামীর প্রতি আমৃত্যু সৎ থাকতে হবে, আর যে নারী আজীবন অবিবাহিত থাকতে চায়, তার সতী (সৎ অর্থে) বা অসতী (অসৎ অর্থে) থাকার ব্যাপারটি হচ্ছে সমাজের প্রতি। সমাজটা হচ্ছে পুরুষের। ফলে, যে নারী এখনো বিয়ে করেনি, সেই নারীকে সমাজ বা পুরুষেরা সতী হিসেবে চায় মানে হচ্ছে, যেকোন পুরুষেরই ভবিষ্যৎ স্বামী হওয়ার সম্ভাবনার জায়গা থেকে প্রতিটি পুরুষের কাছে ঐ নারীকে সৎ থাকতে হবে! অন্যদিকে, স্বামীর ক্ষেত্রে বা যেকোন পুরুষের ক্ষেত্রে তার বিচরণ যেহেতু সর্বত্র, এবং সবধরণের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত, ফলে পুরুষের সততার ধারণা সর্বব্যাপক! মূলত পুরুষের ব্যবসা-বাণিজ্যে অন্যকে ঠকানো বা না ঠকানো – এখান থেকেই তার অসৎ বা সৎ হওয়ার প্রসঙ্গ! সেখানে, বিয়ে করা স্ত্রী ভিন্ন অন্য নারীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন খুবই নগন্য, তার চাইতেও বড় কথা, স্ত্রী হচ্ছে স্বামীর সম্পদ, স্বামীই তাকে খাওয়ায় পরায়। স্ত্রী হচ্ছে বস্তুত স্বামীর কেনা কিছুটা উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন বাঁদী বা দাসী। স্বামী হচ্ছে মালিক, সে স্ত্রীর খায় না, পরে না। ফলে, স্বভাবতই স্ত্রী তার মালিকের কাছে সৎ থাকতে বাধ্য, কিন্তু স্বামী নয়! এভাবেই, সৎ ও সতী বা অসৎ ও অসতী – শব্দগুলো আলাদা হয়ে গিয়েছে!
নারীর এই সতীত্বের ধারণার সাথে বাংলাভাষায় আরও কয়েকটা শব্দ যুক্ত বা প্রচলিত, যেমনঃ নারীর সম্ভ্রম, নারীর চরিত্র, নারীর ইজ্জত। সতীত্ব হারা নারীর কোন সম্ভ্রম নেই, নেই ইজ্জত, অসতী নারী মাত্রই চরিত্রহীন। নারীর সম্ভ্রম, চরিত্র, ইজ্জত – এমনই মহার্ঘ্য বস্তু যে, এর চাইতে মূল্যবান আর কিছু নারীর ত্রিভূবনে নেই, এর অভাবে নারীর জগৎ হয়ে পড়ে অন্ধকার, তার জীবন হয়ে যায় অর্থহীন! আর, এই সম্ভ্রম, চরিত্র, ইজ্জত রক্ষার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা হয়ে যায় নারীজীবনের সর্বপ্রধান লক্ষ ও উদ্দেশ্য। তার চাইতেও বড় যেটি ঘটে তা হচ্ছে নারীর পুরো জীবনকে এসে গ্রাস করে ভয়ানক এক ভয়! শৈশব থেকেই তার পরিবার, তার শুভানুধ্যায়ী যারা, সবাই প্রতিনিয়ত ঢুকিয়ে দিতে চায় এই ভয়, শুরু হয়ে যায় ভয়জনিত নানা নিষেধাজ্ঞা। ব্যাটাছেলেদের সাথে মেশা যাবে না, খেলা যাবে না, একা একা চলা যাবে না, একা বাস করা যাবে না, সন্ধ্যায় বা রাতের অন্ধকারে বাসা বা হলের বাইরে থাকা যাবে না, ইত্যাদি। যখন শৈশব পেরিয়ে নারীর শরীরে পরিবর্তনগুলো আসা শুরু করে, তখন থেকেই সেই ভয়গুলো আরো মারাত্মকভাবে নারীর উপরে চেপে বসে। নারীর নারী হয়ে ওঠার প্রথম প্রহর থেকে শুরু করে আমৃত্যু এই ভয়ের সাথে নারীর বসবাস! জীবনভর আরো অনেক ধরণের ভয় ভর করে, কিন্তু যাবতীয় ভয়ের মূলে থাকে ঐ সতীত্ব হারানোর ভয় তথা সম্ভ্রম হারানোর ভয়, ইজ্জত হারানোর ভয়! সতীত্ব না থাকলে সেই নারীকে বিয়ে করবে কে? ইজ্জত ছাড়া নারীর আছেই বা কি, ইজ্জত হারানো নারীর তো ভালো বিয়ে হয় না (পুরুষ করে বিয়ে, আর নারীর বিয়ে হয়)! অর্থাৎ নারীর জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য একজন ভালো স্বামী পাওয়া, একটা ভালো বিয়ে হওয়া! ভালো ও ভদ্রঘরের স্বামী চায় অক্ষত যোনী। অতএব, নারীর যোনীর মাঝেই থাকে তার ইজ্জত, সম্ভ্রম, মানমর্যাদা, তার সবকিছু! ফলে, নারীর ইজ্জতই, নারীর সম্ভ্রমই হচ্ছে নারীর একমাত্র সম্বল! যেকোন মূল্যেই তাকে রক্ষা করাই হচ্ছে, নারীজীবনের একমাত্র সার্থকতা! এসব কিছুর পেছনে আছে, সেই সতীত্বের ধারণা!
তো, নারীর সতীত্ব কার জন্যে? পুরুষের জন্যে।
নারীর একগামিতা তথা এক-স্বামী-গামিতা কার জন্য? পুরুষের জন্য।
নারীর নারীত্ব কার জন্য? পুরুষের জন্য।
এটাই হলো মূল কথা। যদিও এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এসমস্ত প্রশ্নের জবাব পাবেন অন্যভাবে:
নারীর সতীত্ব কার জন্য? এই সমাজের জন্য।
নারীর একগামিতা কার জন্য? এই সমাজের জন্য।
নারীর নারীত্ব কার জন্য? এই সমাজের জন্য।
কারণ, পুরুষ মানেই তো আজকের এই সমাজ, আজকের এই সমাজ মানেই পুরুষ।
ফলে, বাঙালি পুরুষেরা সমস্বরে আওয়াজ তুলে: “নারীত্ব কখনো সতীত্ব বর্জিত নয়”! নারীও তাল মিলে বলে, “আরে হ্যাঁ, তাই তো! নারীত্ব কখনো সতীত্ব বর্জিত নয়”! পুরো সমাজই সমস্বরে চিৎকার করে: “নারীত্ব কখনো সতীত্ব বর্জিত নয়”! বাক্যটি কিন্তু ভীষণ! “নারীত্ব কখনো সতীত্ব বর্জিত নয়”! এখানে সতীত্বকে তো বটেই, খুব চমৎকারভাবে নারীত্বকেও মহিমান্বিত করে তোলা হলো। এক ঢিলে দুই পাখি! যেন নারীত্বও খুবই মহার্ঘ্য এক বস্তু এবং সেই মহার্ঘ্য “নারীত্ব” পরিপূর্ণ হতে পারে “সতীত্ব” নামক আরেক মহার্ঘ্যের সংযোগে! এই না হলে, আমাদের পুরুষতান্ত্রিকতা! এই না বললে আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ!
সতীত্ব, সম্ভ্রম, ইজ্জত, চরিত্র – এই শব্দগুলোর সাথে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আরো কিছু শব্দ জুড়িয়ে দেয়। যেমনঃ সতীত্ব বর্জন, সতীত্ব বিসর্জন, সতীত্ব নষ্ট, সতীত্ব হারানো, সতীত্ব হরণ, সম্ভ্রম হানি, ইজ্জত হারানো, চরিত্র হনন, ইত্যাদি। এর বিপরীতে আবার আছে রক্ষা! সতীত্ব রক্ষা, সম্ভ্রম রক্ষা, ইজ্জত রক্ষা, চরিত্র রক্ষা! কি আপ্রাণ চেষ্টা সমাজের নারীর সম্ভ্রম রক্ষার, ইজ্জত রক্ষার, চরিত্র রক্ষার, তথা নারীর সতীত্ব রক্ষার। এরই গালভরা নাম হচ্ছে নারীত্ব রক্ষা! কোন ধর্ষকামী পুরুষ যখন বলপূর্বক নারীর ‘সতীত্ব কেড়ে’ নেয়, তাকে এমনকি প্রগতিবাদী বাঙালি পুরুষেরাও ‘ধর্ষণ’, ‘নিপীড়ন’ বলতে লজ্জা পায়, বলে ‘সম্ভ্রমহানি’, ‘ইজ্জতহরণ’, ‘চরিত্রহনন’! ১৯৭১-এর মুক্তযুদ্ধে আমাদের ২ লাখ মা-বোনের ‘সম্ভ্রমহানি’, ‘ইজ্জতহানি’ ঘটেছে, ২ লাখ মা-বোনের ‘সম্ভ্রম’ ও ‘ইজ্জত’-এর বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা! এই হচ্ছে এখনো পর্যন্ত আমাদের প্রগতিবাদীদের মুক্তিযুদ্ধে পাক হানিদার বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর হাতে ধর্ষিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত হওয়া নারীদের অবদান সম্পর্কিত বক্তব্যের ভাষা! কোন নারী যখন পুরুষের হাতে ধর্ষিত হয়, সম্ভ্রম বা সম্মান বলি আর ইজ্জত বলি, তা তো যাওয়ার কথা সেই ধর্ষক পুরুষের! চরিত্রহানি হওয়ার কথা সেই পুরুষের। অথচ, সমাজ বলছে, না তুমি নারী, তোমার সতীত্বের মাঝে আছে তোমার ইজ্জত, তোমার সম্ভ্রম, তোমার চরিত্র, তা যেহেতু তুমি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছো, ফলে তোমারই সম্ভ্রমহানি, ইজ্জতহানি, চরিত্রহানি ঘটেছে! ধর্ষণের ঘটনাকে যখন নারীর চরিত্রহানি, সম্ভ্রমহানি হিসেবে দেখানো হয়, তাতে ধর্ষক পুরুষের দিকে যতখানি আঙ্গুল তোলা হয়, তার চাইতে বেশি আঙ্গুল উঠে নারীর দিকেই। নারী, তুমি তোমার সতীত্ব রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে, ফলে তোমার কোন সম্ভ্রম, মান, মর্যাদা, ইজ্জত- কোন কিছু আর অবশিষ্ট নেই! এর সাথেই উহ্য থাকে এই কথাগুলো: সতীত্ব রক্ষার দায়িত্ব তোমার ছিল, কিন্তু ব্যর্থ হলে! এই ব্যর্থতার দায় তোমারই! তোমার চলাফেরা, তোমার পোশাক, তোমার চালচলনে এমন কিছু ছিল বলেই তুমি ব্যর্থ! হ্যাঁ, আমাদের প্রগতিবাদীরা যারা ভিক্টিম ব্লেমিং এর বিরুদ্ধে অনেক বড় বড় লেকচারও দেন, তারাই এই ধরণের শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে বুঝে না বুঝে নিজেরাই একরকম ভিক্টিম ব্লেমিং এর পথেই যাচ্ছেন। তার চাইতেও বড় বিষয় হচ্ছে, ‘ধর্ষণ’, ‘নিপীড়ন’ শব্দগুলো ব্যবহার করলে যেখানে সরাসরি ধর্ষক, নিপীড়কের দিকে আঙ্গুল তোলা যায়, সেখানে ‘ধর্ষণ’, ‘নিপীড়ন’, ‘যৌন নিপীড়ন’ এর বদলে ‘সম্ভ্রমহানি’ ‘ইজ্জতহানি’ ‘চরিত্রহনন’ এসব বলার প্রকৃত উদ্দেশ্য কি হতে পারে? সচেতন কোন উদ্দেশ্য থাক বা না থাক, এর মাধ্যমে পুরুষের অপরাধকে গোপন করা তথা ধর্ষক পুরুষকে আড়ালে রাখার কাজটিই হয়!
সতীত্ব বিষয়ক আলোচনায় ‘নারীত্ব’কে যে টেনে আনা হয়, সেই ‘নারীত্ব’ আসলে কি? জবাব পাওয়া যায়ঃ “নারীত্ব হচ্ছে নারীর বৈশিষ্ট্য”। নারীর সেই বৈশিষ্ট্য আসলে কি? পুরুষের মতে- নারীর সতীত্ব। অনেকে নারীত্বের সমার্থক হিসেবে সতীত্ব বলে, আবার অনেকে সতীত্বের সমার্থক হিসেবে নারীত্ব বলে ফেলে। এর মাঝে এসে যুক্ত হয়, যৌনতা। এই যৌনতা নারীর নয়, অর্থাৎ নারীর যৌনতা তার নারীত্ব নয়, এ হচ্ছে নারীকে কেন্দ্র করে পুরুষের যৌনতা। মানে, পুরুষের কাছে নারীর যে যৌনাবেদনময়তা, তাই হচ্ছে তার নারীত্ব। ফলে, নারী হচ্ছে তুলার মতো তুলতুলে নরম-সরম, মোলায়েম, নারী ফুলের মত সুন্দর, নারী আবেদনময়ী, নারী আকর্ষণীয়, নারী মায়াময় – স্নেহময় – দয়ার সাগর! এই হচ্ছে নারীর বৈশিষ্ট্য বা নারীত্ব! পুরুষের কাছে নারীমাত্রই একান্ত অনুগত ও সেবাদায়ী যৌনবস্তু, ফলে এরকম অনুগত ও সেবাদায়ী যৌনবস্তু হওয়াই হচ্ছে নারীত্ব, এবং স্বামীর প্রতি এই অনুগত ও বিশ্বস্ত থাকার অপর নাম হচ্ছে সতীত্ব।
নারীত্ব নিয়ে অনেকে গালভরা আলাপ দিয়ে বলেন, “সামাজিক – মানসিক – মনন – রুচি – সংস্কৃতি মিলে নারী, বলা যায় সেগুলোকে মিলিয়েই নারীত্বের ধারণা”। কিন্তু এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর সামাজিক অবস্থানটি কোথায়? রুচি কি? সংস্কৃতিটাই বা কি? সবকিছুর মধ্যেই পাওয়া যাবে পুরুষতান্ত্রিকতার ছাপ, নারী দুর্বল, নারী অবলা, নারী অসহায়, নারী স্বয়ংসম্পূর্ণা নয়, নারী নরম- এ সমস্তই নারীত্ব বা নারীর বৈশিষ্ট্য হিসাবে সমাজে প্রচলিত। নারী ও পুরুষের কাজের বিভাজন অর্থাৎ নারীর কাজ ঘরের ভিতরে, সন্তান উৎপাদন ও সন্তান লালন-পালন, ঘরকান্না- রান্না বান্না, পতির সেবা করা, শক্ত পোক্ত কাজ নারীর জন্য নয়, বাইরের কাজ নারীর নয় – এগুলোও নারীত্বের নাম দিয়েই সমাজে প্রচলিত। নারী সুন্দর (বিপরীতে পুরুষ অসুন্দর এমনটি কিন্তু নয়, পুরুষ সুন্দর কি অসুন্দর- এটা কোন ধর্তব্যই নয়, পুরুষের সৌন্দর্য কোন বিবেচনাতেই আসবে না), তাই তো পুরুষ তাকে মাথায় তুলে রাখে আর পুরুষের মন পেতে তাই নারীকে আরো সুন্দর হওয়ার চেষ্টা করতে হয়, সাজগোজ করতে হয়, সৌন্দর্য নিয়ে নারীকে অনেক মাথা ও সময় ব্যয় করতে হয়। এই হচ্ছে এই সমাজের সামাজিকতা, রুচি ও সংস্কৃতি অনুসারে নারী। নারীকে নিয়ে সমাজের মনন ও মানসিকতাও এরকমই।
তবে, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর মনন ও মানসিকতার উপরে প্রভাব বিস্তার করলেও, একজন নারীর মনন ও মানসিকতা, তার নারীদেহকে চেনা, জানা ও বুঝা তথা নারী আইডেন্টিটি নিয়ে সচেতনতা, তার আবেগ-অনুভূতি – এর মাঝেই নারী ও নারীত্ব পাওয়া সম্ভব। কিন্তু, পুরুষের সমাজ নারীর মনন ও মানসিকতাকে অস্বীকার করে, অগ্রাহ্য করে, সেখানে সমাজ, রুচি, আদর্শ, সংস্কৃতি এসব যুক্ত করে দেয়! নারীর পোশাক ঠিক নেই, বুকে ওড়না নেই, জোরে কথা বললো বা হাসাহাসি করলো, মাঠে ‘ছেলেদের’ মত খেললো, ছেলেদের সাথে মিশলো – ঘুরলো, সন্ধার পরে রাতের অন্ধকারেও ঘরের বাইরে থাকলো- সবেতেই পুরুষেরা তেড়ে এসে আমাদের সংস্কৃতি, রুচি ও সামাজিক মূল্যবোধের ফিরিস্তি দিবে! সেখানে নারীর চাওয়া, নারীর স্বাচ্ছন্দ্য, নারীর পোশাকের – চলার – সঙ্গের – পছন্দের স্বাধীনতা, নারীর খেয়াল – খুশি – আনন্দ – এসবের কোন মূল্য নেই। পুরুষের সমাজের সংস্কৃতি, রুচি, আদর্শ রক্ষার এই দায় কেন নারীকেই পালন করতে হবে, সে প্রশ্ন করা যাবে না! নারীর উপরে চাপিয়ে দেয়া এই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বোঝাকে বলা হচ্ছে মহান দায়িত্ব এবং সেই মহান দায়িত্ব পালনের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে নারীত্ব বা সতীত্ব!
অন্যদিকে পুরুষের বৈশিষ্ট্য কি তাহলে পুরুষত্ব? কি সেই বৈশিষ্ট্য? প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার শিশ্নের আকৃতি, যৌনসক্ষমতা বা যৌনক্রিয়ায় বীর্যপাতের স্থায়িত্ব। টিভিতে কনডমের বিজ্ঞাপনের মারফৎ যৌন সক্ষম ব্যক্তিকে “আসল পুরুষ” অভিহিত করার কথা নিশ্চয় মনে আছে। “আপনার লিঙ্গের আকৃতি ছোট? আগা মোটা, গোড়া চিকন? সহজে শক্ত হয় না? দ্রুত বীর্যস্খলন হয়ে যায়? কোন চিন্তা নাই, এক সপ্তাহের মাঝে আপনার পুরুষত্বের যেকোন সমস্যা দূর হয়ে যাবে। গ্যারান্টিসহ চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে, বিফলে মূল্য ফেরত”, “জোঁকের তেলে তিনদিনে পুরুষত্ব ফিরে পাবেন” – এরকম বিজ্ঞাপনের সাথে পরিচয় কমবেশি সকলের থাকার কথা! শিক্ষিত বাঙালি পুরুষ এসব কবিরাজি চিকিৎসায় বিশ্বাস রাখে না, তবে পুরুষত্বের সমস্যা নিয়ে কমবেশি অনেকেই চিন্তিত থাকে! বিশেষ করে পর্ণো দেখে যৌনশিক্ষায় অভ্যস্ত বাঙালি পুরুষের পুরুষত্ব নিয়ে একধরণের হীনমন্যতাও থাকে! সেই হীনমন্যতার জায়গা থেকেও তারা পুরুষত্ব হিসেবে জাহির করে, তার নারীকে আয়ত্বে বা নিয়ন্ত্রণে রাখার সক্ষমতাকে! গ্রামে গঞ্জে দেখা যায়, যার বউ-এর একটু বেশি দাপট, চটাং চটাং কথা বলে বা স্বামীর সাথেও সমান স্বরে বাৎচিত করে, ঘর-গৃহস্থালির নানা কাজের নির্দেশ দেয়, তাকে নিয়ে পাড়া মহল্লার লোকজন টিটকারি দেয়, অন্যঘরের বউরাও হাসাহাসি করে, বয়স্করা ডেকে বলে, তুই কেমন ব্যাটাছেলে (পুরুষের গ্রাম্য ভার্সন)? যে ব্যক্তি বাড়িতে যত বেশি গর্জন তর্জন করতে পারে, যার বউ ও বাচ্চা কাচ্চা তাকে যত বেশি সম্মান-আত্তি করে, ভয়ে থর থর করে কাঁপে, সেই ব্যক্তি তত বেশি পুরুষ! এককালে তো বউ পিটাতে পারার সক্ষমতাও পুরুষত্ব হিসেবে বিবেচিত হতো! আর, কি আছে পুরুষের বৈশিষ্ট্য? পুরুষ হবে শক্ত, সমর্থ, পেশীবহুল ও মেদবিহীন। ইদানিংকালে মিডিয়া, নাটক, সিনেমার মাধ্যমে পুরুষত্বের বৈশিষ্ট্য হিসেবে যুক্ত হয়েছে জিম করা পেটা শরীর, বাহু ও বুকের ফোলানো মাসল আর পেটের সিক্স প্যাক! পুরুষ হবে নারীর চাইতে গায়ে গতরে বড়, অর্থবিত্তে, শিক্ষায় দীক্ষায়, মানে মর্যাদায়, চাকুরি বাকুরিতে এবং বয়সে – সবদিক দিয়েই বড়। ফলে, পুরুষ প্রেমের সময়ে তার চাইতে বয়সে সমান বা ছোট, লম্বায় খাটো, বুদ্ধিতেও কম নারী খোঁজে, আর বিয়ের সময় এর সাথে যুক্ত হয় বয়সে ছোট, শিক্ষায় কম, চাকুরিতে নীচু এরকম কাউকে, এসবই করে নিজের পুরুষত্ব জাহির করতে! কারো প্রেমিকা সমান বয়সের বা সমান শিক্ষার হলে, সমমর্যাদার চাকরির হলে, সেই পুরুষের মা, খালা, নানি, দাদিরা এসে পরামর্শ দেয়, বিয়ের পরে এই বউকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবি না! এই যে নিয়ন্ত্রণে রাখার যে প্রশ্ন, সেটিই হচ্ছে তার পুরুষত্ব! পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীও একইভাবে তার চাইতে সবদিকে দিয়ে এগিয়ে থাকা পুরুষকেই প্রেমিক বা স্বামী হিসেবে খুঁজে নিতে চায়, এর মাধ্যমে আসলে ‘যথার্থ পুরুষ’কেই খুঁজে নিতে চায়, কেননা ‘কম পুরুষ’-এর সাথে বিয়ে বা প্রেম হলে তো পরিচিত সমাজে মুখ দেখানোই কঠিন হয়ে যাবে!
নারীত্বের সাথে যেমন সতীত্বের সম্পর্ক, পুরুষত্বের সাথে তাহলে কিসের সম্পর্ক? আগেই বলেছি, সতীত্ব শব্দটির পুরুষবাচক কোন শব্দ নাই! কেননা, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর একগামিতা চায়, পুরুষের না! পুরুষের বহুগামিতা নিয়ে সমাজে যতখানি অস্বস্তি আছে, তা ঐ নারীর একগামিতা রক্ষা করতে না পারার ভয় থেকেই। এই অস্বস্তির বাইরে আসলে কোন আপত্তি বা বাঁধাও নেই। বরং, যৌন সক্ষমতা যেহেতু পুরুষের সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য বা সবচেয়ে বড় পুরুষত্ব, ফলে বহুগামি পুরুষও তার পুরুষত্ব নিয়ে গর্বে ভোগে! কৃষ্ণের লীলাখেলা এ ভূখণ্ডে খুব জনপ্রিয়, হাজার নারীর সাথে নেচে গেয়ে যে সম্পর্ক, তাই তাকে পুরুষোত্তম এর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। হাদিস অনুযায়ী, নবী মুহাম্মদও পর পর তার ৯ স্ত্রীর সাথে সহবাস করতে সক্ষম ছিলেন, খোদ আল্লাহ ওনাকে এমন পুরুষত্ব দান করেছিলেন যে, তিনি এরও কয়েকগুণ নারীর সাথে সহবাসে সক্ষম ছিলেন (আমিও মনে করি, এই হাদীস জাল বা মিথ্যা, কেননা এখানে যা বলা হয়েছে, তার সাথে বাস্তবতার সম্পর্ক থাকা সম্ভব নয়। তবে, যে পুরুষ এই হাদিস লিখেছেন, বা যে পুরুষ সাহাবিরা হাদীস সংগ্রাহককে এ কথা বলেছিলেন, তাদের দৃষ্টিতে পুরুষত্ব মানে কি, সেটা দেখা যেতে পারে)। ফলে, নারীত্বের সাথে সতীত্বের যে সম্পর্ক, পুরুষত্বের সাথে ঠিক তার উল্টা সম্পর্ক, মানে যে পুরুষ যত সতীত্ব বা সতত্ব হারাবে, তার পুরুষত্ব তত বেশি! পুরুষের সমাজে নারীত্ব ও পুরুষত্বের ধারণা একমুখী, আর তা হচ্ছে আরো নারীকে পুরুষের আয়ত্বে রাখার ধারণা। বস্তুত সতীত্বের ধারণার মাধ্যমেই পুরুষ নারীর শরীর তথা যৌনতার উপরে একচ্ছত্র অধিকার লাভ করে।
সতীত্বের পরীক্ষা আরেক ভয়ানক অধ্যায়! প্রাচীণ যুগে, মধ্যযুগে সতীত্বের পরীক্ষার নামে নারীদের আগুনে নিক্ষেপ করার চল ছিলো! আসলেই যদি সতী হয়, তাহলে সে নারী এতটুকু না পুড়ে আগুন থেকে বেরিয়ে আসবে! কোথাও অগ্নিকুণ্ডে ঠেলে পাঠানো হতো, কোথাও জ্বলন্ত কয়লার উপরে হেঁটে পার হতে হতো! রামায়নে সীতার গল্প আমরা জানি! রাবণ সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছে, সীতাহরণের পরের সীতার সতীত্বহরণ করেছে কি না, এই হলো প্রজাদের প্রশ্ন, ফলে রাম রাজা হয়েও সীতাকে অগ্নিপরীক্ষায় বাধ্য করেন। একবার নয়, বারবার! শেষে রাগে, দুঃখে অপমানে সীতা ধরণির মাঝে আশ্রয় নেন। সতীত্বের সাথে আগুনের সম্পর্ক কেবল এতটুকু নয়। এখানে সতীদাহ ও সহমরণ প্রথাতেও নারীকে জীবিত মারার চল ছিল। মৃত স্বামীর মরদেহ যদি দূরে সৎকার করা হয়, তাহলে তার স্ত্রীকে একা পুড়িয়ে মারা হচ্ছে সতীদাহ, আর মৃত স্বামীর মরদেহের সাথে একই চিতায় জ্যান্ত স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারাকে বলা হয় সহমরণ। এই যে মৃতের জ্যান্ত স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা, তা কেন? এর মাধ্যমেই সেই নারী সতী হিসেবে মৃত্যুবরণ করছে। মানে, স্বামীর মৃত্যুর পরেও যাতে স্ত্রীর সাথে আর কারো যৌন সম্পর্ক গড়ে উঠে, তাই নিশ্চিত করা হচ্ছে এই পুড়িয়ে মারার মধ্য দিয়ে! এরকম আগুনে পুড়িয়ে মারার ইতিহাস শুধু এই ভারত উপমহাদেশেই নয়, ইউরোপ জুড়ে মধ্যযুগেও একই চল ছিল! তার নাম ছিল উইচ হান্টিং! স্বাধীনচেতা, জ্ঞানে বিজ্ঞানে এগিয়ে থাকা, চিকিৎসাশাস্ত্রে পারদর্শী, যৌনতা নিয়ে সামাজিক ট্যাবু থেকে মুক্ত অসংখ্য নারীকে উইচ বা ডাইনি আখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে! বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্ক, গণ্যমান্য পরিবারের কমবয়সী ছেলের সাথে সম্পর্ক, বিবাহ বহির্ভুত ‘অবৈধ’ যৌনসম্পর্কের অভিযোগে যেমন অনেক নারীকে উইচ হিসেবে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, তেমনি সমাজের ক্ষমতাধর ব্যক্তির যৌন আবেদনে সাড়া না দেয়াতেও উইচ বানানো হয়েছে! ইসলামী শরিয়তে অবশ্য আগুনে পোড়ার বিধান নেই, তবে জেনাকারীকে জ্যান্ত পুঁতে পাথর নিক্ষেপে মেরে ফেলার বিধান রয়েছে। এখানে অবশ্য জেনাকারি নারী ও পুরুষ উভয়কেই সাজা দেয়ার বিধান রয়েছে এবং ৪ জন পর্যন্ত সাক্ষীর বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তবে মুসলিম দুনিয়ায় এর ভুক্তভোগী প্রধানত নারীরাই। তবে সুখবর এই যে, আমাদের আইনে দুজন প্রাপ্তবয়স পুরুষ ও নারীর যৌনসম্পর্কের জন্যে কোন সাজার ব্যবস্থা নেই। কিন্তু সামাজিকভাবে, সংস্কৃতি, রুচি, আদর্শের ধুয়া তুলে সতীত্ব রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে এই পুরুষ সমাজ। এখন সতীত্ব পরীক্ষার জন্যে আগুনের পরীক্ষা নেই, তবে বিয়ের রাতে নতুন স্ত্রীর সতীত্ব পরীক্ষার একটি প্রথা প্রচলিত আছে। এর আরেক নাম কুমারিত্ব পরীক্ষা। নারীর যোনীমুখে একরকম পর্দা থাকে, যার বাংলা নামই হচ্ছে ‘সতীচ্ছেদ’, প্রথমবার যৌনক্রিয়ায় তা ছিন্ন হয় ও রক্তপাত হয়। বাসর রাতে সাদা বিছানার চাদর দেয়া হয়, যাতে করে স্বামী জানতে পারে বিছানার চাদর স্ত্রীর সতীচ্ছদ এর রক্তে লাল হয়েছে কি না, অর্থাৎ স্ত্রী সতী কি না! (অথচ, একেক নারীর এই সতীচ্ছেদ একেক রকম হয়, ফলে সকলের ক্ষেত্রেই রক্তপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না, আবার অনেক নারীর ক্ষেত্রে যৌনক্রিয়া ছাড়াও আগেই নানা কারণে এই পর্দা ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।) বিয়ের পরে স্ত্রীর সতীত্ব নিয়ে সন্দেহ হলে স্বামী কর্তৃক গালিগালাজ, হুমকি ধামকি, মাইরপিট, চোখ অন্ধ করে দেয়া, এমনকি মেরে ফেলারও নজির আছে। ফলে, সতীত্বের পরীক্ষা ব্যাপারটিই নারীর জন্যে এক বীভিষিকার নাম!
তবে, সতীত্বের ধারণার বিরুদ্ধে লাগাতর সমালোচনা ও এ নিয়ে নানাবিধ বিজ্ঞানভিত্তিক আলাপের কারণে শিক্ষিত বাঙালি পুরুষ এখন মনে মনে যাই হোক, প্রকাশ্যে সতীত্ব পরীক্ষার পক্ষে কিছু বলতে পারে না। ফলে, তারা ঘুরিয়ে কথাটা বলে এভাবে, “সতীত্ব পরীক্ষা করাটা অন্যায় কিন্তু সতীত্ব রক্ষা করাটা দায়িত্ব”। কিন্তু, সতীত্ব রক্ষা মানে আসলে কি? কে রক্ষা করবে, কেন করবে, কার জন্য করবে? সতীত্ব রক্ষার এই মহোত্তম দায়িত্ব কে নারীর উপর অর্পন করলো? সতীত্ব রক্ষার এই দায় কেন নারীরা বহন করবে? এসব প্রশ্নের জবাব তাদের কাছে নেই, কিন্তু সতী ও কুমারী নারীকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার এবং বিয়ে করা স্ত্রীকে আজীবন সতী হিসেবে রাখার আকাঙ্ক্ষা পুরোমাত্রাতেই আছে। আজকে যে নারীর সতীত্ব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সমালোচনা হচ্ছে, সতীত্বের ধারণা ছুড়ে ফেলে দেয়ার কথা বলা হচ্ছে, যৌনতার স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে, বিয়ে নামক জবরদস্তির এক ইনস্টিটিউশনকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে, লিভ টুগেদার, প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের সম্মতিতে বিবাহ বহির্ভুত যৌন সম্পর্কের পক্ষে কথা বলা হচ্ছে, এসবই সতীত্বের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, কমজোর করে! সতীত্বের ধারণার সাথে পুরুষতন্ত্রের যেহেতু সরসারি সম্পর্ক, সেহেতু সতীত্বের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, কমজোর করা মানেই হচ্ছে পুরুষতন্ত্রেরই কিছুটা হলেও দুর্বল হওয়া! নারীর উপরে, নারীদেহের উপরে, নারীর যৌনতার উপরে পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্য ক্ষুন্ন হওয়ায়, এমনকি ব্যক্তি স্বাধীনতার ধ্বজা উড়ানো তথাকথিত প্রগতিবাদী পুরুষরাও পুরোপুরি মেনে নিতে পারে না। ফলে, তারা যুক্তি করে, “নারীর ব্যাক্তি স্বাধীনতা জরুরি, কিন্তু এটাকে রুচি এবং সংস্কৃতির আধারেই তৈরি করতে হয়। ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠাটা মোটেই ঠিক নয়”। এ এক অদ্ভুত যুক্তি, নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতার জরুরত স্বীকার করে, তাকে এমন রুচি ও সংস্কৃতির সীমার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে, যে রুচি ও সংস্কৃতি হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারক ও বাহক। তাহলে এহেন ব্যক্তি স্বাধীনতার রূপটি কেমন হবে? একটি লোহার খাঁচার মধ্যে পাখিকে ঢুকিয়ে বলা যে, এই খাঁচার ভিতরে তুমি যা ইচ্ছে করো, “ইচ্ছা হইলে গাইবে, নাচিবে, খাইবে, ঘুমাইবে, খেলিবে, হেলিবে, দুলিবে – অর্থাৎ যাহাই ইচ্ছা তাহাই করিবে এবং তাহা করিবে এই খাঁচার ভিতরে”! এই রুচি ও সংস্কৃতির যে খাঁচা, তার বাইরে গেলেই তা ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারিতা! “ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারিতা” হচ্ছে সেই পরীক্ষিত জু জু, যা দিয়ে ‘অবাধ’ ব্যক্তি স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয়, তার গায়ে – হাতে – পায়ে লাগাম পরানো হয়! নারীর স্বেচ্ছাচারিতা বলতে এখানে নারীর পুরুষের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে আসা, ঘরের বাইরে আসা, রাতে ঘরের বা হলের বাইরে থাকা, যৌনতা নিয়ে ট্যাবু কাটিয়ে ফেলা, বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করা, ইত্যাদি বুঝানো হয়। নারীর স্বেচ্ছাচারিতা নামক যে জু জু’র ভয় তারা দেখে ও দেখায়, তা হচ্ছে নারীর সতীত্ব বর্জন, তথা বিয়ে করা বাঁধা স্বামীতে আটকে না থেকে বিয়ের আগেই বা বিয়ে না করেই যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া! যেখানে নারীরা পুরুষতান্ত্রিকতার চাপে পিষ্ঠ এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধটাই রহিত, সেখানে নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতার কথাটাই মুখ্য। সেটা শুনে যখন কেউ স্বেচ্ছাচারী হওয়ার ভয় দেখে ও দেখায়, তাদের উদ্দেশ্য বলা যায়, এমন ক্ষেত্রে কখনো কখনো স্বেচ্ছাচারী হওয়াও জরুরী হতে পারে।
নারীর স্বেচ্ছাচারী হওয়াও জরুরী হতে পারে, এমন কথা শুনে বাঙালি পুরুষ হায় হায় করে উঠে, তার মানে কি নারীর সতীত্ব বর্জন (বা বিসর্জন) এর ডাক দিচ্ছি- এমন প্রশ্ন করে ফেলে! নারীর স্বেচ্ছাচারিতা, নারীর সতীত্বের ধারণা বর্জন আর নারীর যৌনতার স্বাধীনতা – এই তিনের অর্থ বাঙালি পুরুষের কাছে একটিই, তা হচ্ছে নারীর বহুগামিতা, একেকদিন (পড়তে হবে রাত, যৌনতা কেবল রাতেই হয়, রাত শব্দটাই যৌনতার সমার্থক) একেক পুরুষের সাথে শুয়ে বেড়ানো! বস্তুত এরকম ধারণা হচ্ছে বাঙালি পুরুষের ফ্যান্টাসিজাত কষ্টকল্পনা! প্রকৃতপ্রস্তাবে নারীর যৌনতার স্বাধীনতা হচ্ছে- নারীরও যে যৌন চাহিদা, যৌন আকাঙ্ক্ষা, যৌন তাড়না আছে এবং নারী যে কেবল পুরুষের যৌন চাহিদা পূরণের নিমিত্তে কোন যৌন সামগ্রী নয় – তার স্বীকৃতি। নারীর যৌন স্বাধীনতার মানে হচ্ছে – নারীর প্রেম, বিয়ে থেকে শুরু করে যেকোন সম্পর্ক বা যৌনসম্পর্কের ক্ষেত্রে পার্টনার পছন্দ করা বা বাছাই করার এবং সেই সম্পর্কচ্ছেদ ঘটানোর স্বাধীনতা। নারীর যৌন স্বাধীনতার মানে হচ্ছে, পার্টনারকে যেমন যৌন ক্রিয়ায় আহবান জানাতে পারা (এক্টিভ অংশগ্রহণ করা, কেবল প্যাসিভ না থাকা), তেমনি যৌন ক্রিয়ায় অংশ নিতে ইচ্ছে না করলে পার্টনারকে না-ও বলতে পারা। নারীর যৌন স্বাধীনতা মানে হচ্ছে, কোন পুরুষ অসতী নারী বিয়ে করবে না বা করতে চাইবে না বা অসতী নারীর বিয়ে হবে না- এই ভয়ে কুকড়ে না থেকে নারীকে এহেন পুরুষকে ছুড়ে ফেলতে পারা, নিজের ইচ্ছেয় বা স্বমতে ও পছন্দে কোন পুরুষকে বিয়ে করতে বা না করতে পারা! নারীর যৌন স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে: “আমার শরীর, আমার যৌনতা, আমার সিদ্ধান্ত”! অর্থাৎ, নারীর যৌন স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে সম্পূর্ণভাবেই সতীত্ব সংক্রান্ত ধারণাকে বর্জন করা।
সতীত্বের ধারণা বর্জন করার মানে হচ্ছে: নারীর ‘সম্ভ্রম’, ‘ইজ্জত’, ‘চরিত্র’ প্রভৃতিকে নারীর যোনী থেকে উপড়ে ফেলা। সতীত্বের ধারণা বর্জন করার মানে হচ্ছে: যে বিয়ে নারীকে স্বামী নামক প্রভুর দাস বানিয়ে দেয়, স্বামীর উপরে প্রচণ্ড নির্ভরশীল ও তার অনুগত হতে হয়, সেই বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করা! সতীত্বের ধারণা বর্জন করার মানে হচ্ছে: নারীর শরীর বা যৌনতার উপরে পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করা, সেই আধিপত্যিকে ছুড়ে ফেলে দেয়া। সতীত্বের ধারণা বর্জন করার মানে হচ্ছে: নারীর শরীর তথা যৌনতার উপরে নিজের নিয়ন্ত্রণ ও একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা, অর্থাৎ “আমার শরীর, আমার যৌনতা, আমার সিদ্ধান্ত”!
[প্রকাশিতব্য ই-বই “বাঙালি পুরুষের মন” থেকে]
আপনার মতামত জানানঃ