পূর্বশত্রুতার জেরে গত বছর ৭ আগস্ট খুলনার তেরখাদায় নাঈম শেখ (২৭) ও হিরু শেখ (৫৫) নামে দুই ব্যক্তি খুন হন। এ ঘটনায় ১৬ জনকে আসামি করে মামলা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা তেরখাদার ইউপি চেয়ারম্যান এম দীন ইসলামসহ ১৯ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এর মধ্যে তিন আসামি শেখ সাইফুল ইসলাম, আবদুর রহমান ও খালিদ শেখ ওই বছরের আগস্ট মাসে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
১৯ ডিসেম্বর খুলনার জেলা ও দায়রা জজ আসামিদের জামিন আবেদন খারিজ করলে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে জামিন চাওয়া হয়। ওই জামিন আবেদনে তিন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার তথ্য গোপন রাখা হয়। শুনানি শেষে হাইকোর্ট সাত আসামির জামিন মঞ্জুর করেন। পরে তারা কারাগার থেকে মুক্তি পান। সাত আসামি তথ্য গোপন করে জামিন নেয়ায় তাদের জামিন আদেশ প্রত্যাহার চেয়ে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের নজরে এনে সম্প্রতি আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। রোববার ওই সাত আসামির জামিন বাতিল করেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে আদেশপ্রাপ্তির দশ দিনের মধ্যে তাদেরকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। যদি আত্মসমর্পণ না করে তাহলে তাদেরকে গ্রেফতারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি এম. আতোয়ার রহমানের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
জড়িত একাধিক চক্র
গত তিন সপ্তাহে অন্তত ৫টি জামিন জালিয়াতির ঘটনা হাইকোর্টে ধরা পড়েছে। শুধু হত্যা মামলাই নয়, জাল নথি সৃজনের পাশাপাশি তথ্য গোপন ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অস্ত্র, ধর্ষণ মাদক মামলাসহ বিভিন্ন গুরুতর মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিন নেয়া হচ্ছে। জামিন নেয়ার ক্ষেত্রে ভুয়া এফআইআর, চার্জশিট, জব্দ তালিকা দাখিল করা হচ্ছে। অভিযোগের গুরুত্ব কমিয়ে তৈরি করা কাগজপত্র দেখিয়ে আদালতকে বিভ্রান্ত করে পক্ষে নেয়া হচ্ছে আদেশ। ফৌজদারি বিবিধ শাখায় এসব ঘটনা বেশি ঘটছে। এসব জালিয়াতিতে একাধিক চক্র জড়িত।
জামিন আদেশের কপি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এর আগে ফৌজদারি মিস শাখার জমাদার মঞ্জু রানী কৈরীকে বরখাস্ত করে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। এরপর কিছুদিন জামিন জালিয়াতির ঘটনা থেমে ছিল। সম্প্রতি আবারও বেশ কয়েকটি জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে।
সূত্র জানায়, হাইকোর্টের নির্দেশে নথি ও জামিন জালিয়াতির ঘটনায় এ পর্যন্ত প্রায় ৫০টির মতো মামলা দায়ের করেছে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। এর মধ্যে ফৌজদারি বিবিধ শাখা থেকে ২৯টি, রিট শাখা থেকে ৯টি, ফৌজদারি আপিল শাখা থেকে ২টি এবং অন্যান্য শাখা থেকে ১০টি। এসব মামলা তদন্ত ও বিচারাধীন রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাইকোর্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, জামিন জালিয়াতি রোধে আমাদের তৎপরতা অব্যাহত আছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। অভিযোগ পেলেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, জামিন জালিয়াতির ঘটনায় সুপ্রিমকোর্টের পক্ষ থেকে যেসব মামলা হয়েছে সেগুলোর তদন্ত চলছে। জালিয়াতিতে কারা জড়িত তা পুলিশের তদন্তেই বেরিয়ে আসবে।
কোথায় যাব আমরা? : জামিন জালিয়াতির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আদালত বলেন, এই যদি জালিয়াতির নমুনা হয় আমরা কোথায় যাব? হয়তো আমাদের দণ্ডবিধির ৩০২ ধারার মামলার জামিন আবেদনের শুনানি গ্রহণ বন্ধ করে দিতে হবে। এভাবে কত জামিন জালিয়াতি হয়েছে কে জানে। এভাবে কোর্টের সঙ্গে প্রতারণা করলে আমরা জজিয়তি করব কীভাবে? জামিন জালিয়াতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে জালিয়াতিতে আইনজীবীর সম্পৃক্ত পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুদ্দিন খালেদ শুনানি করেন। জামিন বাতিল হওয়া আসামিরা হলেন- শেখ সাইফুল ইসলাম, আবদুর রহমান, খালিদ শেখ, ইস্কান্দার শেখ, জমির শেখ, জিয়ারুল শেখ ও আব্বাস শেখ।
শুনানিতে ডিএজি সাইফুদ্দিন খালেদ বলেন, মামলার মূল এজাহার পরিবর্তন করে জালিয়াতি চক্র নিজেরাই এজাহার সৃজন ও নিম্ন আদালতের আদেশের অনুলিপি তৈরি করেছে। আর যিনি আসামিদের পক্ষে আইনজীবী হয়ে কাজ করে তাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট জামিন বাতিলের নির্দেশ দেয়। এদিকে একই মামলায় মাহবুর শেখসহ তিন আসামির জামিন আবেদন উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, আসামিদের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এদের নাম এসেছে। এই মুহূর্তে জামিন নয়।
গত দু’ সপ্তাহে দুটি জামিন জালিয়াতির মামলা পরিচালনায় এক আইনজীবীর নাম আসায় বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। আদালত ওই আইনজীবীকে বলেন, এ ধরনের ঘটনায় আইনজীবী হিসেবে কেন আপনার নাম বারবার আসছে? তখন ওই আইনজীবী দাবি করেন, তিনি জালিয়াতি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। হাইকোর্ট তদন্তের নির্দেশ দিয়ে বলেন, জালিয়াতির ঘটনায় আইনজীবী জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। ধর্ষণ মামলার রায় পাল্টে জামিন আবেদন : গত মাসে হাইকোর্টে কয়েকটি জামিন জালিয়াতির ঘটনা মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ধর্ষণ মামলার রায় পাল্টে জামিন আবেদনের ঘটনা। নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, মামলায় আসামি কবির বিশ্বাসের যাবজ্জীবন সাজা হয়। কিন্তু তিনি দুই কারারক্ষী ও মামলার তদবিরকারকের সহযোগিতায় রায়সহ মামলার সব মূল নথি পাল্টে যাবজ্জীবন সাজার স্থলে সাত বছর দেখিয়ে জামিন চান। জালিয়াতির বিষয়টি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পী হাইকোর্টের নজরে আনলে দুই কারারক্ষীসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ। ওয়ান শুটার গানের জায়গায় চাইনিজ কুড়াল : চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার আবদুস সাত্তার নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে পুলিশ এক রাউন্ড গুলিসহ ওয়ান শুটার গান উদ্ধার করে। ওই ঘটনায় করা মামলায় বিচারিক আদালত তাকে দুটি ধারায় ১৭ বছরের সাজা দেন। কিন্তু নিম্ন আদালতের ওই রায় বদল করে সেখানে অস্ত্রের পরিবর্তে ‘চাইনিজ কুড়াল’ উদ্ধারের বিষয়টি উল্লেখ করে হাইকোর্টে আপিল করে জামিন চান সাত্তার। হাইকোর্ট আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে তাকে এক বছরের জামিন দেন। কিন্তু সন্দেহ হওয়ায় তার আইনজীবীই বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ জামিনাদেশ প্রত্যাহার করে নেন। জালিয়াতি করে জামিন নেয়ায় ঝিনাইদহ কারাগারের দুই কারারক্ষীসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
২০১৮ সালে ৯০ হাজার পিস ইয়াবা মামলার দুই আসামির জামিন আদেশের কপি জালিয়াতির ঘটনায় হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রারকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। কমিটি ওই বছরের ১১ জুলাই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে হাইকোর্টে দাখিল করে। সেই প্রতিবেদনে জাল জামিন আদেশ তৈরির ক্ষেত্রে হাইকোর্টের ফৌজদারি বিবিধ শাখার ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়ী করা হয়। তদন্তে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী, আইনজীবীর সহকারী, সংশ্লিষ্ট ডেপোনেন্ট ও অন্যান্য ব্যক্তিকেও দায়ী করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে সুপ্রিমকোর্টের একাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকার কথা থাকলেও শুধু জমাদার মঞ্জু রানী কৈরীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে শাহবাগ থানায় মামলা করে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। পরে মঞ্জুরানী কৈরীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। গত বছরের ২২ মার্চ সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সুপ্রিমকোর্টে একের পর এক জামিন জালিয়াতির খবর শুনছি। বিশেষ করে মাদক ও অস্ত্র মামলার ক্ষেত্রে এসব জালিয়াতি হয়। জামিন জালিয়াতির ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ না হলে পরবর্তীতে আর নেয়া হয় না। এভাবেই অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ