করোনা মহামারির সময়েও ত্রাণ বিতরণে তালিকা তৈরিতে স্থানীয় ক্ষমতাবানদের নেতিবাচক প্রভাব ছিল। বিশেষ করে উপকারভোগীর তালিকা তৈরিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা হস্তক্ষেপ করেছেন। ফলে ত্রাণ পাওয়ার উপযুক্ত না হয়েও কেউ একাধিকবার পেয়েছেন, অন্য দিকে যার প্রয়োজন তিনি ত্রাণ পাননি।
‘করোনা সংকট মোকাবিলায় সাড়াদানকারী বেসরকারি সংস্থাসমূহের ভূমিকা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গতকাল বৃহস্পতিবার ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে টিআইবি।
২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই গবেষণা করা হয়। গবেষণার অংশ হিসেবে ৪৪টি জেলার ৭৪টি বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ৯টি আন্তর্জাতিক, ২৩টি জাতীয় ও ৪২টি স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে সেবা নেওয়া ৫৮৯ জন উপকারভোগী জরিপে অংশ নেন।
গবেষণায় অংশ নেওয়া বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে দুই–তৃতীয়াংশের বেশি সংস্থা প্রথম ৩ মাসের মধ্যে (মার্চ ২০২০ থেকে মে ২০২০) কোভিড-১৯–সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ৮৩ শতাংশ প্যাকেজ আকারে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে। ত্রাণ প্যাকেজের মধ্যে খাদ্য ও সুরক্ষাসামগ্রী, ক্ষেত্রবিশেষে নগদ অর্থও অন্তর্ভুক্ত ছিল। করোনার প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মহামারিতে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যে ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, তার মধ্যে উপকারভোগী নির্বাচন ও তাদের কাছে সাহায্য পৌঁছানো অন্যতম। বিশেষ করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে। কিছু কিছু জায়গায় সাহায্য প্রাপ্তির জন্য উপযোগী না হওয়া সত্ত্বেও প্রভাবশালীরা তাদের পরিচিত লোকজন ও আত্মীয়-স্বজনের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে এবং ক্ষেত্র বিশেষে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী তালিকা প্রণয়ন করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে।
উপকারভোগীদের তালিকা প্রণয়নে কোন কোন জায়গায় একজন ব্যক্তির নাম একাধিকবার লিপিবদ্ধ করা হলেও সাহায্যের উপযোগী হওয়া সত্ত্বেও কারও কারও নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
টিআইবির গবেষণায় বলা হয়েছে, অংশগ্রহণকারী ৫৪ শতাংশ সংস্থা ত্রাণের তালিকায় উপকারভোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এছাড়া ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ সংস্থা বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা এবং স্থানীয় ক্ষমতাশালীদের প্রভাবের শিকার হয়েছে।
গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ২টি প্রতিষ্ঠান জেলা প্রশাসন কর্তৃক উপকারভোগীর তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ করে। প্রায় ২৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান কর্মসূচি বাস্তবায়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অসহযোগিতার কথাও উল্লেখ করেছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে। কিছু কিছু জায়গায় সাহায্য প্রাপ্তির জন্য উপযোগী না হওয়া সত্ত্বেও প্রভাবশালীরা তাদের পরিচিত লোকজন ও আত্মীয়-স্বজনের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে এবং ক্ষেত্র বিশেষে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী তালিকা প্রণয়ন করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি সংস্থাগুলোর প্রায় সাড়ে ৩৬ শতাংশ করোনা–সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবা দেয়। প্রায় ৫৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠান করোনাকালে দুস্থ ও অসহায় মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তা দেয়। আর পিপিই, স্যানিটাইজার ও সাবানের মতো সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করে প্রায় ৮৩ শতাংশ সংস্থা।
করোনার সময়ে করোনার সংক্রমণ ও উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দাফন ও সৎকার অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। জরিপে অংশ নেওয়া সাড়ে ৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান করোনায় লাশ দাফন ও সৎকারে ভূমিকা পালন করেছে। এসব সংস্থার মধ্যে আল মানহিল, আল মারকাজুল ইসলাম, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, রহমতে আলম সমাজসেবা সংস্থা উল্লেখযোগ্য।
করোনার সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ রাখা ও সুবিধাজনক সময়ে ঋণ বা কিস্তি পরিশোধের নির্দেশনা ছিল। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ২৬ শতাংশ উপকারভোগী করোনার সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধে সমস্যার সম্মুখীন হন। তারা অভিযোগ করেন, কিস্তি পরিশোধে চাপ প্রয়োগ করা হয় এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মীর অশোভন আচরণের শিকার হন।
গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গবেষণায় আমরা দেখেছি, তহবিল সঙ্কটসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও করোনা সঙ্কট মোকাবিলায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শুদ্ধাচার বজায় রেখে মানুষের জন্য বিভিন্ন মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পেরেছে। কিছু কিছু অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও সার্বিকভাবে অবৈধ আর্থিক লেনদেনের উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে করোনাকালে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে তহবিল সঙ্কট ছিল মূল চ্যালেঞ্জ’।
প্রতিবেদনে করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাসমূহের কার্যকর অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণের জন্য ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে।
এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো করোনাকালে তৃণমূল পর্যায়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহের বিভিন্ন কার্যক্রমের (সচেতনতা বৃদ্ধি, খাদ্য সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা, নগদ অর্থ সহায়তা এবং ত্রাণ তৎপরতা) ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং সমন্বয় সাধন করতে হবে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক করোনাকালীন গৃহীত কর্মসূচির ধরন, আওতা, ব্যয়, উপকারভোগীর তথ্য ইত্যাদি নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ ও নিয়মিতভাবে হালনাগাদ করতে হবে। করোনাকালে মাঠ পর্যায়ে বেসরকারি সংস্থার পরিচালিত কার্যক্রম বিশেষত উপকারভোগীদের ত্রাণসংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে তদারকি সংস্থার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০৫
আপনার মতামত জানানঃ