সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বেলাভূমি খ্যাত পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটা সৈকতের ১২ কিলোমিটার এলাকা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। অব্যাহত ভাঙন এবং দায়সারা উন্নয়নে দিন দিন অস্তিত্ব হারাতে বসেছে সৈকতটি।
চলতি বর্ষায় সাগরের তীব্র ঢেউয়ে বালুক্ষয় হয়ে এর পরিধি কমছে। ভাঙনের কবলে ঝুঁকির মুখে পড়েছে সৈকতের ট্যুরিজম পার্ক, কুয়াকাটা ইসলামিয়া মাদরাসা পয়েন্ট, বেড়িবাঁধসহ বিভিন্ন স্পট। এরইমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে দর্শনীয় স্থান নারিকেল বাগান ও জাতীয় উদ্যান। সৈকত চলে এসেছে কুয়াকাটা চৌমাথার ২০০ ফুটের মধ্যে। এ অবস্থায় প্রতি বছর ভাঙন থেকে সৈকত ও মূল বেড়িবাঁধ রক্ষায় অর্থ ব্যয় করা হলেও তা খুব বেশি কাজে আসছে না।
অপরদিকে, কুয়াকাটা সৈকতের গঙ্গামতি পয়েন্ট এলাকায় বনাঞ্চলের বিশাল একটি অংশের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ মরছে। ফলে একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে তেমনি প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলবাসীর জানমালের ঝুঁকিও বাড়ছে।
বন বিভাগ ও পরিবেশকর্মীদের দাবি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে স্ফীত জোয়ারের সঙ্গে সৈকতে বালু জমা হয়ে গাছের শিকড় আটকে থাকছে। আর এতেই মরছে এসব গাছ।
বন বিভাগের তথ্য মতে, প্রায় ২০ একর জায়গাজুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মারা যাওয়া গাছগুলো। এসবের বেশিরভাগই কেওড়া ও গেওয়া। এছাড়া ছইলা, হিজল, কাঠবাদাম, ক্যাজা, নিম, পাকুড়, তেঁতুলসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছও রয়েছে।
পটুয়াখালীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন সংবাদমাধ্যমকে জানান, সৈকতে প্রতিবছর গাছ লাগানো হচ্ছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাগরের উচ্চতা ক্রমশ বাড়ছে এবং উঁচু জোয়ারের পানি সৈকতে আঘাত হানছে। এ জোয়ারের সাথে প্রচুর বালু সৈকতে জমছে আর এ বালুতে গাছের গোড়া বা শ্বাসমূল ঢেকে যাচ্ছে। এভাবে শ্বাসমূল ঢেকে যাওয়ায় গাছগুলো মারা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, বছরে কমপক্ষে ১০ হাজার কেওড়া গাছ মারা যায়।
গঙ্গামতি এলাকার মহিউদ্দিন (৪২) সাগরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি বলেন, যে সব স্থানের গাছ মরে গিয়ে ফাঁকা হয়ে গেছে সেখান থেকে সাগরের প্রচণ্ড ঢেউ সরাসরি উপকূলে আঘাত করে এবং তীব্র ভাঙন দেখা দেয়।
অপর জেলে আবুল কালাম জানান, গাছগুলো একে একে মারা যাচ্ছে এটা আমাদের জন্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। গাছগুলো মারা যাবার কারণ খুঁজে আবারো গাছ রোপণের ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।
প্রায় ২০ একর জায়গাজুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মারা যাওয়া গাছগুলো। এসবের বেশিরভাগই কেওড়া ও গেওয়া। এছাড়া ছইলা, হিজল, কাঠবাদাম, ক্যাজা, নিম, পাকুড়, তেঁতুলসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছও রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার কলাপাড়া জোনের সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন মাননু সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সিডর ও আইলা-পরবর্তী সময়ে উপকূলীয় অঞ্চলে আয়তন ঠিক থাকলেও কমছে বন। নদীভাঙনের কারণে অনেক গাছ বিলীন হচ্ছে। আবার সমুদ্র পিষ্টে পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত বালু জমা হয়ে হাজারো গাছের শ্বাসমূল বালুতে আটকে থেকে মরছে।
কুয়াকাটা সৈকতের কোল ঘেঁষে রয়েছে বিশাল বনাঞ্চল। একসময় কুয়াকাটার সৈকত ঘেঁষা নারকেল বাগান, জাতীয় উদ্যানের ঝাউ বাগান, ম্যানগ্রোভ বন পর্যটকদের আকৃষ্ট করতো। কিন্তু সেই বনভূমি ক্রমশ দখল হয়ে যাচ্ছে। বনের গাছ কেটে সেখানে বসতি স্থাপন করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। দেদারছে সংরক্ষিত বন ধ্বংস করে বনের জমিতে বাড়ি-ঘর তুলছে এক শ্রেণীর অসাধু মানুষ। বন বিভাগ চেষ্টা করেও থামাতে পারেনি। সম্প্রতি দখল হয়ে যাওয়া বনভূমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছে তারা।
জানা যায়, দখলদাররা ইতোমধ্যে ৩২৯.৬০ একর বনভূমি দখল করে ফেলেছে। তবে তাদের মধ্যে ৩৮৩ জনকে চিহ্নিত করে একটি তালিকা তৈরি করেছে বন বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা মনে করেন, বনভূমি বেদখল হয়ে যাওয়ার অর্থ শুধু এই নয় যে এভাবে রাষ্ট্রের সম্পত্তি ব্যক্তি–প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে চলে যাচ্ছে। এর অর্থ এটাও যে এইভাবে দেশের বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে এবং তার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রতিটি রাষ্ট্রে মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বনভূমি উজাড় হতে হতে এখন ১৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে; অবশ্য এই হিসাব সরকারের বন অধিদপ্তরের। বেসরকারিভাবে ধারণা করা হয়, আমাদের দেশে এখন প্রকৃত বনভূমির পরিমাণ এর চেয়ে কম।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, অবৈধ দখলদারেরা সাধারণত স্থানীয়ভাবে ক্ষমতাবান হয়ে থাকে, বিশেষত রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে এমন ব্যক্তিরা এসব তৎপরতায় লিপ্ত হয় এবং তাদের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা যথাযথভাবে কাজ করে না। তাই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অবৈধ দখলদারদের দমন করার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। বন বিভাগের অসাধু অংশের সঙ্গে অবৈধ দখলদারদের যোগসাজশও ছিন্ন করতে হবে। আর অবিলম্বে বেদখলে থাকা বনভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য কঠোর ও ব্যাপক অভিযান চালানো প্রয়োজন বলে জানান তারা।
বন ধ্বংস হওয়ার ফলে বিপন্ন হচ্ছে পশু-পাখির আশ্রয়স্থল। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। দেশে এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় বনাঞ্চল অনেক কম। এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশ অথবা পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ এখনো যুগোপযোগী ও কল্যাণকর বন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।
শিল্পোন্নত দেশ জাপানের ভূখণ্ডের শতকরা ৭০ ভাগ এবং জনবহুল দেশ ইন্দোনেশিয়ার ৫০ ভাগ ভূখণ্ড বনে আচ্ছাদিত। সঠিক, বাস্তব ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের দেশেও বন সংরক্ষণ করা সম্ভব।
তারা বলেন, এজন্য নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ। দেশে যে সামাজিক বনায়ন বিধিমালা করা হয়েছিল, সেটির ফলাফল আশাব্যঞ্জক নয়। গত শতকের আশির দশকে সামাজিক বনায়নের ভুল ও অপরিকল্পিত বাস্তবায়নের কারণে দেশের ‘শালবন’ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। কাজেই দেশের বনাঞ্চল রক্ষায় একটি যথোপযোগী বন আইন প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন জরুরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫২
আপনার মতামত জানানঃ