হোম অব ইসলাম’ নামেই সৌদি আরবের খ্যাতি। দেশটিতে দশকের পর দশক ধরে চলে আসা রক্ষণশীল ঐতিহ্য ভাঙার চেষ্টা করছেন যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান। বেশ কিছু সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
সৌদি আরবের জীবনযাত্রার ‘হাওয়া বদল’ দেখা যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। কট্টরপন্থা থেকে উদারপন্থা স্পষ্ট হচ্ছে তাদের শাসনব্যবস্থায়। আরবদের ‘নেতা’ সৌদির এই পরিবর্তনের দিক বিশ্বের কাছে তুলে ধরে ‘ভাবমূর্তি বাড়ানো’র লক্ষ্যে আমেরিকান মিডিয়া পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছে সৌদি আরব। পরামর্শক হিসেবে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তার নাম নিকোলা হিউইট, তিনি একসময় মার্কিন সংবাদ উপস্থাপক কেটি কুরিকের প্রযোজক ছিলেন। সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
জনসংযোগ নির্বাহী নিকোলা হিউইট এখন নিজের প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। জনগণের নাগরিকদের জীবনযাত্রায় উদারতা দেখাতে থাকা সৌদি আরবের ‘ভাবমূর্তি’ তৈরির গুরুদায়িত্ব বর্তেছে তার কাঁধে। অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটির হয়ে আগে থেকেই কাজ করছেন আরও অনেক মার্কিন প্রভাবশালী।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের কাছে জমা হওয়া একটি নথিতে বলা হয়েছে, হিউইট সৌদি আরবের গণমাধ্যম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করবেন। সৌদি আরবে জীবনযাপনে যে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে তা সম্প্রচার, মুদ্রণ এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণায় জনসংযোগসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করবেন তিনি।
ওই নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হিউইট ‘থিকাহ বিজনেস সার্ভিসেস’ নামে একটি কোম্পানির মাধ্যমে নতুন দায়িত্বটি পালন করবেন। ২০২০ সালে রিয়াদের মিডিয়া এজেন্সির জন্যও কাজ করেছেন হিউইট।
কট্টরপন্থি শাসনব্যবস্থার কারণে রিয়াদ গত ক’বছর আগেও সমালোচনায় ছিল। বিশেষ করে নারী ও রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি রিয়াদের নেতিবাচক আচরণসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা শাসকগোষ্ঠীকে প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে বরাবর।
এর মধ্যে আবার তুরস্কে নিজেদের দূতাবাসে ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার ঘটনায় সৌদি আরব এবং দেশটির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার শিকার হন। এমনকি ইয়েমেন যুদ্ধে রিয়াদের অংশগ্রহণ নিয়েও কম সমালোচনা হয়নি। সৌদির সঙ্গে অস্ত্র চুক্তির বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিয়ে আসছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
এই সমালোচনামূলক অবস্থানের মধ্যে সৌদির শাসকগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ইভেন্ট, কনসার্টের আয়োজন এবং নারী অধিকার সংক্রান্ত আইন শিথিল করার মাধ্যমে নিজেদের ভাবমূর্তি উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। যদিও এসব পদক্ষেপের বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে আসছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
বলা হচ্ছে, ক্রীড়া-কনসার্টসহ নানা ক্ষেত্রে ছাড়সহ নারীর অগ্রযাত্রায় সৌদির পদক্ষেপগুলোকেই ‘পরিবর্তন’ হিসেবে উপস্থাপন করা হবে আন্তর্জাতিক পরিসরে।
সৌদি বাদশাহ সালমান ভাতিজা মুহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে সিংহাসনের উত্তরসূরি করেন ছেলে মুহাম্মদ বিন সালমানকে। এরপর থেকে বদলের হাওয়া বইতে শুরু করে রক্ষণশীল দেশ বলে পরিচিত সৌদি আরবে। দেশটি অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে তেলভিত্তিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরতা কমানো, পর্যটন ও শিল্পায়নে গুরুত্ব দেওয়া, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি আর নারীদের অধিকারের বিষয়ে ধাপে ধাপে অনেকটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা হচ্ছে, যার মূল কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছে ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানকে। বাবা বাদশাহ সালমান সিংহাসনে থাকলেও কার্যত অনেক ক্ষেত্রেই মূল ভূমিকা পালন করছেন এই যুবরাজ।
সৌদি আরবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এবার গুরুত্ব বাড়ছে বিনোদন শিল্পের। সদ্যই সৌদি আরবের সংগীত উৎসব ‘সাউন্ডস্টর্ম সংগীত উৎসব’ শেষ হলো। চারদিনের সংগীত উৎসবে সাত লাখের বেশি অতিথি অংশগ্রহণ করেছে। এর রেশ যেতে না যেতেই সৌদিবাসীর জন্য ‘নিউ ইয়ার’ এসেছিল বাড়তি আনন্দ হয়ে। বিশ্বের বিভিন্ন জনপদের মতো মহা ধুমধামে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবও। জমকালো আয়োজন আর আতশবাজির রঙিন আলোর ঝলকানিতে ২০২২ সালকে স্বাগত জানিয়েছে সৌদিবাসী।
সৌদি আরবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এবার গুরুত্ব বাড়ছে চলচ্চিত্র শিল্পের। সৌদি আরবে সিনেমা মুক্তিতে ৩৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা উঠেছে মাত্র ৪ বছর হলো। তবে সংবেদনশীল ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিষয়, যৌনতা ও সমকামিতা স্পর্শ করে এমন সিনেমা দেশটিতে এখনো নিষিদ্ধ। পশ্চিম এশিয়ার সিনেমাগুলো সবচেয়ে বেশি মুক্তি পায় সেদেশে। বর্তমানে সৌদি আরবে ১৫৪টি সিনেমা হল চালু আছে।
বিশ্বজুড়ে এখন তরুণদের জয়জয়কার। তাদের অবজ্ঞা করা কোনো শাসকের পক্ষেই সম্ভব না। তরুণদের উপেক্ষার পরিণতিতে মসনদও উল্টে যেতে পারে। সৌদি বাদশা সালমানকে দূরদর্শীই বলতে হয়। তিনি বাস্তবতা বুঝতে পেরেছেন। তারুণ্যকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি তার ৩২ বছর বয়সী ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স করেছেন। সিংহাসনের এই উত্তরাধিকারী এখন সৌদির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রধান সারথি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১০০
আপনার মতামত জানানঃ