চতুর্থ ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভোটে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এ ধাপে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে ৩৯৬ জন জয়ী হয়েছেন। অন্যদিকে ৩৯০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এ ধাপে ৮৩৬টি ইউপিতে ভোটগ্রহণ হয়েছে। এদিকে, ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) প্রতিটি ধাপের নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতা ঘটেছে। গত রোববার অনুষ্ঠিত চতুর্থ ধাপের নির্বাচনও সহিংসতামুক্ত ছিল না।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিপুল জয়
ইসির জনসংযোগ শাখার পরিচালক (যুগ্ম-সচিব) আসাদুজ্জামান এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ইসিতে ৭৯৬টি ইউপির ফলাফলের তথ্য এসেছে। এতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত ৩৯৬ জন প্রার্থী জয় পেয়েছেন, যা মোট ইউপি’র ৪৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয় পেয়েছেন ৩৯০ ইউপিতে, যা মোট ইউপির ৪৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন ২, জাকের পার্টি ১, জাতীয় পার্টি-জাপা ৬, জাতীয় পার্টি’র ১ জন জয় পেয়েছেন।
এর আগে তৃতীয় ধাপে ২৮ নভেম্বর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তৃতীয় ধাপে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছেন ৫২৫টিতে, অপরদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছে ৪৪৬টিতে। গড় হিসাব করলে দেখা যায়, ওই ধাপে নৌকা প্রতীকে ৫২.৯২ শতাংশ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৪৪.৯৬ শতাংশ ইউপিতে জয় পান।
এছাড়া জাতীয় পার্টি ১৭টি, ১টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। তৃতীয় ধাপে ১০০৮টি ইউপিতে ভোটগ্রহণ হয়েছিল।
তার আগে ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ৮৩৪টি ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে জয় পান ৪৮৬টিতে। আর ৩৩০টিতে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান।
জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা ১০টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয় পান, এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীরা ৪টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয় পান। আবার জাতীয় পার্টি (জেপি), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, খেলাফত মসলিশ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ১টি করে ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয় পান।
গত ২১ জুন অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের প্রথম অংশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ২০৪টি ইউপির মধ্যে ১৪৮টি ইউপিতে আওয়ামী লীগ জয় পায়। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান ৪৯টিতে। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জয় পেয়েছে ১ ইউপিতে, যা মোট ইউপির দশমিক ৪৯ শতাংশ। জাতীয় পার্টি-জেপি ও জাতীয় পার্টি-জাপা জয় পেয়েছে ৩টি করে।
এ পর্যন্ত চার ধাপের ইউপি ভোট সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ৫ জানুয়ারি পঞ্চম ধাপে ৭০৭টি ও ষষ্ঠ ধাপে ৩১ জানুয়ারি ২১৯ ইউপিতে ভোটগ্রহণ করবে ইসি।
সহিংসতার নির্বাচন
এদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে ঠাকুরগাঁও, পটুয়াখালী ও সিলেটে নিহত হয়েছেন তিনজন। এ ছাড়া কিছু স্থানে ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, সংঘর্ষ, গুলি এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
এর আগে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে ভোটের দিন সহিংসতায় যথাক্রমে ৬ ও ৭ জন নিহত হয়েছিলেন। আর গতকাল বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনী সংঘাতে আহত হয়েছেন ৫২ জন। এ পর্যন্ত দেশজুড়ে নির্বাচনী সংঘাতে ৭০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত থাকার কারণে ১৫টি ভোটকেন্দ্রে ভোট বন্ধ করা হয়। ভোট গ্রহণের সময় প্রার্থীদের সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় ২৯ জন আহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় ৬৩ জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এদিন ভোটের ফলাফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রাজাগাঁও ইউপিতে পরাজিত এক ইউপি সদস্য প্রার্থীর সমর্থকেরা পুলিশের ওপর হামলা চালান। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালালে হামিদুর রহমান (৬৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। গত ২৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে দক্ষিণ আসাননগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউপি নির্বাচনে ভোট পুনর্গণনার দাবিতে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন নিহত হয়েছেন। গত ২৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের নয়ারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। নিহত আবদুল খালেক (৪০) সদস্য প্রার্থী মো. জিয়াউর রহমানের (ভ্যানগাড়ি) সমর্থক।
সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ফুলবাড়ি ইউপি নির্বাচন ঘিরে সহিংসতায় আবদুস সালাম (৪৫) নামের এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, রাত ৮টার দিকে পরাজিত একজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর সমর্থকেরা বৈটিকর এলাকায় সিলেট-জকিগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে রাখেন। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করতে চাইলে অবরোধকারীরা পুলিশের ওপর চড়াও হন। এ সময় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েকটি গুলি ছোড়ে। এ সময় সংঘর্ষে পুলিশসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। আহত ব্যক্তিদের সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ সময় আবদুস সালামকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।
যশোরের অভয়নগর উপজেলায় দুটি ইউপিতে তিনটি কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছোড়ে, লাঠিপেটা করে ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এতে এক পুলিশ কর্মকর্তা, দুজন চেয়ারম্যান প্রার্থী, একজন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও একজন পোলিং কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। এ সময় চারটি কেন্দ্রে ভোট বন্ধ থাকে।
সাংবাদিকদের ওপর হামলা
সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর ইউপিতে নৌকার সমর্থকেরা কেন্দ্র দখল করে ভোট দেওয়ার ভিডিও দৃশ্য ধারণ করায় বেসরকারি টেলিভিশন মাছরাঙা ও এনটিভির দুই সাংবাদিকের ক্যামেরা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রুহিয়া পশ্চিম ইউনিয়নের একটি ভোটকেন্দ্রে ব্যালট কেড়ে নৌকায় সিল মারার ছবি তুলতে গেলে স্থানীয় এক সাংবাদিককে মারধর করে নৌকার সমর্থকেরা তার মুঠোফোন ও ক্যামেরা কেড়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্য একটি ভোটকেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট পেপার ছিনতাই করতে গিয়ে মেয়েসহ এক আওয়ামী লীগ নেতা আটক হন।
এদিকে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের কালাপাহাড়িয়া ইউপি নির্বাচনে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দুটি কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকে প্রকাশ্যে ভোট দিতে ভোটারদের বাধ্য করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বেলা ১১টার দিকে ওই ইউপির স্বতন্ত্র প্রার্থী ফাইজুল হক ও তিনজন ভোটার এমন অভিযোগ করেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নৌকার প্রার্থী সাইফুল ইসলাম।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৩০
আপনার মতামত জানানঃ