ইতিহাসে ‘রানাভেলোনা দ্য ক্রুয়েল’ নামে পরিচিত আফ্রিকার দেশ মাদাগাস্কারের রানী প্রথম রানাভেলোনা। তিনি তার রাজত্বকালে তার রাজ্যের প্রায় ৭৫ শতাংশ জনগণকে হত্যা করেছিলেন এবং তিনি জনগণের উপর আজব ও নৃশংস অত্যাচার করতেন।
যদি তার মনে হতো, কোনো ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা করছে তখন তিনি সেই ব্যক্তিকে কোনো প্রমাণ ছাড়াই শাস্তি দিতেন এবং তার জন্য তিনি রোজ নতুন নতুন ধরনের পদ্ধতি বের করতেন।
যেমন মুরগির কাঁচা চামড়া খেতে দেয়া, কুমারী মেয়েদের রক্ত দিয়ে গোসল করা আর যখন কেউ তার আদেশ মানতে অস্বীকার করতো তখন রানী সেই ব্যক্তিকে ফুটন্ত গরম তেলে ছেড়ে দিতেন।
তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস রানী হিসেবে পরিচিত। তিনি নৃশংসতার দিক দিয়ে রাজা মহারাজাদেরও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।
১৭৭৮ সালে মাদাগাস্কারের একটি সাধারণ পরিবারে রানাভেলোনার জন্ম হয়। তার বাবা ছিলেন একজন কৃষক। সেই সময় তার নাম ছিল ‘প্রিন্সেস রামাভো’। কিন্তু এবার প্রশ্ন হলো একটি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে রামাভোর নামের পূর্বে কীভাবে ‘প্রিন্সেস’ এলো? এবং কীভাবে একটি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে তিনি মাদাগাস্কারের রানী হলেন?
যেসময় রামাভোর জন্ম হয়েছিলো, ঠিক সেই সময় কিছু লোক মাদাগাস্কারের তৎকালীন রাজা আন্দ্রিয়ানাম-পোইনিমেরিনাকে গুপ্তচর দ্বারা হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলো। আর এই বিষয়ে রামাভোর বাবা জেনে যান। তিনি তখন এই ষড়যন্ত্রের কথা রাজাকে জানান। যার ফলে রাজা সাবধান হয়ে যান এবং তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
মাদাগাস্কারের রাজা এই কারণে রামাভোর বাবার উপরে খুব খুশি হন এবং উপহার হিসেবে তিনি রামাভোর সঙ্গে নিজের একমাত্র পুত্র ‘প্রিন্স প্রথম রাদামা’ এর সঙ্গে বিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
এমনকি তিনি এটাও বলেন, যদি প্রিন্স রাদামা অনেকগুলো বিয়ে করেন, তাহলে রামাভোই হবে প্রিন্সের প্রথম স্ত্রী এবং প্রিন্স যখন রাজা হবে, তখন রামাভো হবে মাদাগাস্কারের রানী। সেই হিসেবে রামাভোর গর্ভে জন্ম নেয়া ছেলে হবে মাদাগাস্কারের ভবিষ্যৎ রাজা।
এরপর বেশ কিছু বছর কেটে যায়। রামাভো এবং প্রথম রাদামার বিয়ে হয়। তবে তাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না। ১৮১০ সালে মাদাগাস্কারের রাজা আন্দ্রিয়ানাম-পোইনিমেরিনার মৃত্যু হয়। তিনি তার মৃত্যুর আগে প্রথম রাদামাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ঘোষণা দিয়ে যান।
আবার রাদামার পরে শুধুমাত্র রানাভেলোনার ঘরের সন্তানই সিংহাসনে বসবে এই ঘোষণাও দেন রাজা। আর সেই ঘোষণা অনুযায়ী প্রিন্স প্রথম রাদামা হন পরবর্তী রাজা।
মাদাগাস্কারে সেই সময় একটি নিয়ম ছিল। যখন কোনো নতুন রাজা সিংহাসনে বসবে, তখন সে কয়েকজন দেশদ্রোহীকে হত্যা করবে। প্রিন্স প্রথম রাদামা তার স্ত্রী রামাভোর কয়েকজন আত্মীয়কে দেশদ্রোহীর তকমা দিয়ে হত্যা করেন। আর এর ফলে তাদের সম্পর্ক আরো বেশি খারাপ হয়ে যায়।
রামাভো ছাড়াও প্রিন্স রাদামার আরো ১১ জন রানী ছিল। আর তিনি তাদের সঙ্গেই বেশি সময় কাটাতেন। আর দাম্পত্যসুখ বঞ্চিত রানাভেলোনা দিন দিন ক্ষমতালোভী ও কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠেন। যিনি তার ১১ সতীনের উপর চালাতেন অমানবিক নির্যাতন।
রামাভো রাজা প্রথম রাদামার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং যেহেতু রাজার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো ছিল না। তাই তাদের কোনো সন্তানও ছিল না। তখন রানী নিজেই মাদাগাস্কারের সিংহাসনে বসার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর ২৭ জুলাই ১৮২৮ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে রাজা প্রথম রাদামার মৃত্যু হয়। সবাই জানতো যে, রামাভো রাজাকে খুন করেছে। কিন্তু কেউই এর প্রমাণ পায় নি।
রামাভোর সামনে আরো একটি বাধা ছিল। কারণ রাজার মৃত্যুর পর রাজার বড় বোনের ছেলে রাকোতোব মাদাগাস্কারের সিংহাসনের দাবিদার ছিল। রানী এই ছোট ছেলেটিকেও হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। তিনি মাদাগাস্কারের সিংহাসনে বসার আগে রাজপরিবারের সেই সব ব্যক্তিকে হত্যা করেন, যারা তার বিরুদ্ধে ছিল।
এরপর ১২ জুন ১৮২৯ সালে তিনি মাদাগাস্কারের সিংহাসনে বসেন। সেই সময় তিনি তার নাম রাখেন ‘কুইন রানাভেলোনা’। আর এখান থেকেই মাদাগাস্কারের ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময় শুরু হয়, যা প্রায় ৩০ বছর ধরে চলতে থাকে।
ক্ষমতা গ্রহণের আগে রাজপ্রাসাদের প্রায় ৩০ বছরের জীবনে তিনি বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন রাজ্যের সব প্রভাবশালী মন্ত্রী, তান্ত্রিক এবং বড় বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। ফলে প্রধান সেনাপতিদেরকেও হাত করে নিতে তার বেশি সময় লাগেনি।
কুইন রানাভেলোনা মাদাগাস্কারের নিয়মনীতিকে খুব মান্যতা দিতেন। যার কারণে তিনি রাজপরিবারের শুধুমাত্র পুরুষদের হত্যা করেছিলেন এবং নারীদের জেলে বন্দি করে দিয়েছিলেন। কারণ তার নিয়ম অনুযায়ী, রাজপরিবারের নারীদের রক্তপাত হলে রাজ্যের জন্য দুর্দশা ডেকে নিয়ে আসে।
এই কারণে রানী রাজপরিবারের নারীদের জেলে বন্দি করে দেন। তবে জেলে বন্দী অবস্থায় ঐ নারীদের পর্যাপ্ত খাবার ও পানি না দেওয়ার কারণে তারা কিছুদিন পর মারা যায়। মৃত্যু হয়েছে তো কী, রক্তপাত তো হয়নি!
রানী রানাভেলোনা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক আরো পাকাপোক্ত করতে সমর্থ হন, যারা ছিলেন তার ক্ষমতার প্রধান উৎস। ব্যবসায়ীরা ইউরোপীয় দেশগুলোকে একদম বিশ্বাস করতেন না। এমনকি ইউরোপের সংস্কৃতিও তারা পছন্দ করতেন না। তাই রানী ইউরোপ থেকে আসা শিক্ষক, ব্যবসায়ী, রাজদূত সবাইকে ইউরোপে ফেরত পাঠিয়ে দেন। এমনকি তিনি ইউরোপের সঙ্গে সব রকমের ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ করে দেন।
আর এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ফরাসিরা মাদাগাস্কারের উপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ফ্রান্স থেকে আসা সব সৈন্যরা মাদাগাস্কারের জঙ্গলে থাকা মশার কামড়ে ম্যালেরিয়ার শিকার হয়। আর তারা রানীর সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে যায়। রানী তখন বন্দী সৈন্যদের মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দেন এবং তাদের শরীর সমুদ্রের তীরে ঝুলিয়ে রাখেন, যাতে ইউরোপ থেকে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে রানাভেলোনার ভয় বজায় থাকে।
আর এই ঝুলানো শরীরগুলো দিতো একটি মৌন বার্তা, ‘সাবধান হে, এটা ফিমেল ক্যালিগুলার রাজত্ব!’ এই ঘটনার পর রানাভেলোনা তার প্রজাদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
তবে রানী এখানেই শান্ত ছিলেন না। তিনি সব সময় ভয় পেতেন তার সৈন্যরা হয়তো ইউরোপের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তাকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করবে। এই কারণে তিনি মাঝে মাঝে তার সৈন্যদের অনুগত্য পরীক্ষা করার জন্য তাদের মুরগির কাঁচা চামড়া খেতে দিতেন। যদি কেউ সেই কাঁচা চামড়া খেতে অস্বীকার করতো, তখন রানী সেই সৈন্যদের দেশদ্রোহীতার তকমা দিয়ে তাকে গরম ফুটন্ত তেলে ছেড়ে দিতেন। আর সেই সৈন্যের মৃত্যু হতো।
এছাড়া রানাভেলোনা খ্রিষ্টান ধর্ম মোটেই পছন্দ করতেন না। তাই তিনি ধীরে ধীরে মাদাগাস্কারে থাকা সব পাদ্রীকে হত্যা করেন। এরপর তিনি খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার ও পালন করার উপর জোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তখন যদি কেউ খ্রিষ্টান ধর্ম পালন করতে গিয়ে ধরা পড়তো, তবে তিনি সেই ব্যক্তিকে ফাঁসি দিতেন। এই সময় তিনি ১০ হাজারের বেশি খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষকে হত্যা করেন।
এমনকি তিনি ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনেন। এই পন্থায় কোনো ব্যক্তির বিচার যুক্তি তর্ক আর প্রমাণের ভিত্তিতে নয়, বরং তাকে অত্যন্ত বিষাক্ত বিষ পান করানো হতো। যদি বিষপানের পরও কোনো ব্যক্তি বেঁচে যায় তাহলে সে নিষ্পাপ বলে প্রতীয়মান হবে। এ ব্যবস্থায় কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিই যে নির্দোষ প্রমাণিত হয়নি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
রানাভেলোনা একজন পাগলাটে ধরনের রানী ছিলেন। তিনি অপরাধীদের নতুন নতুন ধরনের শাস্তি দিতেন। আর একজন অপরাধী যত বেশি কষ্ট পেয়ে মারা যেতো, রানী ততো বেশি আনন্দ পেতেন। তিনি সরাসরি হিটলারিয় পন্থায় মানুষকে শাস্তি দিতো। এমনকি তিনি দোষীদের তাদের পরিবারের সামনে হত্যা করতেন, যাতে শাস্তি পাওয়া ব্যক্তি আরো বেশি কষ্ট পায়।
কুইন রানাভেলোনার বয়স যেমন বাড়ছিলো, তেমনি তার পাগলামীও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিল। তিনি তার সৈন্যদের নিজের অধীনে রাখার জন্য তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেন এবং সেই সৈন্যরা রাজ্যের নারীদের ধর্ষণ করে, খুন করে, লুটপাট চালায় আর সব সৈন্যরা বেলাগাম হয়ে যায়।
১৮৪৫ সালের দিকে তিনি এক অদ্ভুত আদেশ জারি করেন, যা কোনো একজন পাগলাটে মানুষের পক্ষে দেয়া সম্ভব। তিনি তার সব সৈন্যদের বন্য মোষ মারার হুকুম দেন। হঠাৎ এমন এক আদেশ পেয়ে সৈন্যরা যখন বন্য মোষ মারতে যায়, তখন প্রায় ১০ হাজার সৈনিক প্রাণ হারায়।
এদিকে রানাভেলোনার ছেলে দ্বিতীয় রাদামা বড় হয় এবং সে তার মায়ের এসব কাণ্ড দেখে বুঝে যায় যে তার মা একজন পাগল রানী। এই কারণে সে তার মাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু রানাভেলোনা খুবই চালাক ছিলেন। তিনি তার ছেলের ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে যান। ফলে দ্বিতীয় রাদামার এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। তবে ১৬ই আগস্ট ১৬৬১ সালে ঘুমের মধ্যে রানাভেলোনার মৃত্যু হয়। তিনি দীর্ঘ ৩০ বছরের শাসনকালে প্রায় ৩৭ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিলেন।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৫৫
আপনার মতামত জানানঃ