বিশ্বে চলছে সোশ্যাল মিডিয়ার রাজত্ব। যুগের চাহিদায় দিন দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে। ফেসবুক ছাড়া এখন ভাবাই অসম্ভব। কী নেই এখানে? চাইলেই সবকিছু মেলে নেট দুনিয়ায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে ফেসবুক। ভুয়া তথ্য প্রচার, অশালীন মন্তব্য ও ঘৃণা ছড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এ মাধ্যম। এ ছাড়া ফেসবুকের বিরুদ্ধে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদে সমর্থন ও পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ তুলেছেন বিশ্বের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। মানুষকে বিপথগামী করতে রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি।
ইয়াহু ফাইন্যান্সের এ বছরের জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে বাজে কোম্পানি হিসেবে উঠে এসেছে ফেসবুকের নাম। তালিকায় বিশ্বের সেরা কোম্পানি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে মাইক্রোসফট।
এক হাজারেরও বেশি ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন এই জরিপে। বর্তমানে মেটা নামে পরিচিত ফেসবুকের ওপর ব্যবহারকারীদের ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে এই জরিপের মাধ্যমেই। সেন্সরশিপ, মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ইন্সটাগ্রামের প্রভাব এবং গোপনীয়তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন এসব ব্যবহারকারী।
তবে, ৩০ শতাংশ অংশগ্রহণকারীর মতে, ফেসবুক তাদের উপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে। চলতি বছর ফেসবুকের নাম পরিবর্তনের সময় কোম্পানির প্রধান নির্বাহী মার্ক জুকারবার্গ একে নতুন সূচনা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
অন্যদিকে আরেক উত্তরদাতা বলেন, ফেসবুকের নিজের অপকর্ম স্বীকার করে এর ক্ষমা চাওয়া উচিত। সেইসাথে ক্ষতিপূরণ হিসেবে একটি ফাউন্ডেশন তৈরির পরামর্শও দেন তিনি। কিছু ব্যবহারকারী মেটা রিব্র্যান্ডিংকে নেতিবাচক হিসেবে নিলেও অনেকেই কোম্পানিটির সম্ভাবনার বিষয়ে আশাবাদী।
ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তার বিষয়ে সারা বছর জুড়েই আলোচনায় ছিল ফেসবুক। অক্টোবরে আমেরিকার কংগ্রেসে ফেসবুকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন কোম্পানির সাবেক কর্মী ফ্রান্সেস হাউগেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন ফেসবুক কীভাবে সমাজের ক্ষতি করে সে সম্পর্কে মানুষের কাছে বারবার মিথ্যে কথা বলেছে।
ফ্রান্সেস হাউগেন বলেন, ফেসবুকের প্ল্যাটফর্মগুলো যে কিশোরীদের মানসিক ক্ষতি করে, তা কোম্পানি জানত। এছাড়াও বিদ্বেষমূলক কথা ছড়ানো ঠেকানোর জন্য সফটওয়্যার ব্যবহারেও ফেসবুকের নির্বাহীরা বাধা দিয়েছে বলে জানান হাউগেন। কারণ বিদ্বেষমূলক কথা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি চর্চা হয়। এতে প্ল্যাটফর্মটির প্রবৃদ্ধি বাড়ে।
এক হাজারেরও বেশি ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন এই জরিপে। বর্তমানে মেটা নামে পরিচিত ফেসবুকের ওপর ব্যবহারকারীদের ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে এই জরিপের মাধ্যমেই। সেন্সরশিপ, মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ইন্সটাগ্রামের প্রভাব এবং গোপনীয়তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন এসব ব্যবহারকারী।
হাউগেন বলেন, আরএসএস গোষ্ঠীর ফেসবুক অ্যাকাউন্টগুলো মুসলিম-বিদ্বেষী কনটেন্টের প্রচারণা চালায়। হিন্দুপন্থী জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে এ প্রচারণা চালায় তারা।
সূত্র মতে, মুসলমানদের ‘শুকর’ এবং ‘কুকুর’-এর সাথে তুলনা করে অসংখ্য অমানবিক পোস্ট করা হয়েছে এসব অ্যাকাউন্ট থেকে। হয়েছে কোরআন অবমাননা করা পোস্টও। কিন্তু এসব মুসলিম-বিদ্বেষী কনটেন্ট ফেসবুক মডারেট করেনি বলে অভিযোগ হাউগেনের। তার দাবি, ভারতে বাংলা ভাষার কনটেন্টগুলো পর্যবেক্ষণ করার জন্য বাঙালি মডারেটরের ঘাটতি ছিল।
হাউগেন আরও দাবি করেছেন, বিদ্বেষ ছড়ানো কনটেন্টের মাত্র ০.২ শতাংশ পোস্ট সরানো হয় ফেসবুকের অটোমেটেড সিস্টেমের দ্বারা। মুসলিমবিরোধী পোস্টকে প্রায় কখনও ‘ফ্ল্যাগ’ করা হয়নি ফেসবুকে। ফেসবুকের সিভিক ইন্টেগ্রিটি গ্রুপের প্রোডাক্ট ম্যানেজার ছিলেন ফ্রান্সেস হাউগেন। গত মে মাসে সংস্থাটির চাকরি ছাড়েন তিনি।
ফেসবুক বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী মাসে তাদের দুইশ সত্তর কোটি নিয়মিত ব্যবহারকারী রয়েছে। লাখ লাখ মানুষ এই প্রতিষ্ঠানে হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইন্সটাগ্রামের মতো পণ্যও ব্যবহার করে।
কিন্তু ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা রক্ষা করতে ব্যর্থতা থেকে শুরু করে ভুয়া তথ্য ছড়ানো বন্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ রয়েছে ফেসবুকের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি সময়ে একের পর এক অভিযোগে বিদ্ধ হচ্ছে ফেসবুক। আর প্রতিটি অভিযোগের মাত্রাই ছাড়িয়ে যাচ্ছে আগেরটা।
জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিরুদ্ধে সম্প্রতি বিভাজন সৃষ্টি, শিশুদের ক্ষতি করা, নিরাপত্তার চেয়ে লাভের দিকে বেশি নজর দেওয়া ও গুজব ছড়ানোসহ নানা অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি ফেসবুককে গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে অভিযোগ করেছেন সদ্য নোবেলজয়ী সাংবাদিক মারিয়া রেসা। এছাড়া ফেসবুকের বিরুদ্ধে ভুয়া খবর ও গুজবকে প্রাধান্য দেওয়ারও অভিযোগ তুলেছেন তিনি।
রেসা বলেন, ফেসবুক গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যটি ঘৃণা, ভুয়া তথ্য ও গুজব ছড়ানো রুখতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। ফেসবুক তথ্য নিয়ে একেবারেই নিরপেক্ষ নয় বলে অনেকবার প্রমাণ পাওয়া গেছে। নিরপেক্ষতার চেয়ে ঘৃণা, ক্ষোভ এবং মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর উপরই বেশি গুরুত্ব দেয় জনপ্রিয় এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি।
এদিকে সম্প্রতি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা ফেসবুকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। সোস্যাল মিডিয়া জায়ান্টটিকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে দেওয়ায় অভিযুক্ত করা হয়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, মামলা দায়ের করা রোহিঙ্গারা ১৫ হাজার কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। মামলায় দাবি করা হয়েছে ফেসবুক প্লাটফর্ম নিপীড়িত জনগোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দিয়েছে। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে ২০১৭ সালে সেনা অভিযানের সময় প্রায় দশ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম নিহত হয় বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।
তবে এ ঘটনায় ফেসবুকের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ