মানুষের দেখার জন্য চোখের কর্নিয়া ও লেন্স খুবই প্রয়োজনীয়। চোখের স্বচ্ছ লেন্স বয়সজনিত বা অন্য কোনো কারণে অস্বচ্ছ হলে দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। স্বাভাবিক কাজকর্মও ব্যাহত হয়। চোখের লেন্স অস্বচ্ছ হওয়ার নাম ছানি। বয়স বাড়লে, আঘাত লাগলে, চোখে অন্য কোনো প্রদাহ হলে, ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ হলে, দীর্ঘদিন চোখে ড্রপ দিলে চোখে ছানি পড়ে।
চোখের সাহায্যে আমরা পৃথিবী দেখি। সেই চোখে যখন অসুখ হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই দৃষ্টিশক্তি ব্যাহত হবে এবং এই সব অসুখের ভেতর চোখের ছানি পড়া সবচেয়ে পরিচিত ও বেশিমাত্রায় হওয়া অসুখ। একটি হসপিটালের চক্ষু বিভাগে যত রোগী আসেন তার অধিকাংশই চোখে ছানি পড়ার সমস্যা নিয়ে আসেন।
দেশে ১০০ জনের মধ্যে ১৯ জন কোনো না–কোনো কারণে দৃষ্টি ত্রুটিজনিত সমস্যায় ভুগছে। এর ৭১ শতাংশ অন্ধত্বের কারণ হচ্ছে চোখের ছানির চিকিৎসা না করানো।
সবশেষ জাতীয় অন্ধত্ব জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে এই জরিপের তথ্য উপস্থাপন করা হয়। ‘দেশব্যাপী অন্ধত্ব জরিপ–২০২০’ শিরোনামের এই জরিপটি করেছে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)।
দেশের ৬৪ জেলার গ্রাম ও শহরে ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এই জরিপ হয়। জরিপে ১৮ হাজার ৮১০ জন নারী ও পুরুষের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপে দেখা গেছে, গত ২০ বছরে দেশে অন্ধত্বের হার ৩৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
জাতীয় জরিপ বলছে, দেশে ১০০ জনের মধ্যে একজন অন্ধত্বের শিকার। দেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ চোখে দেখে না। ১০০ জনের মধ্যে ১৯ জন কোনো না–কোনো কারণে দৃষ্টি ত্রুটিজনিত সমস্যায় ভুগছে।
জরিপ পরিচালনায় যুক্ত গবেষকেরা বলছেন, দেশে অন্ধত্বের প্রধান কারণ চিকিৎসাবিহীন ছানি। ৭১ শতাংশ অন্ধত্বের কারণ হচ্ছে চোখের ছানির চিকিৎসা না করানো। এ ছাড়া অন্য কারণগুলোর মধ্যে আছে ডায়াবেটিসজনিত রেটিনোপ্যাথি, গ্লুকোমা এবং বার্ধক্যজনিত কারণ। গবেষকেরা বলছেন, দৃষ্টিজনিত সমস্যা বা অন্ধত্ব শুধু স্বাস্থ্যের সমস্যা নয়, এটি বড় ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা।
চোখের লেন্স ঘোলাটে হয়ে যাওয়ার নাম হলো ছানি পড়া। ইংরেজিতে একে ক্যাটারেক্ট বলা হয়। এই ছানি সম্পর্কে আমাদের কমবেশি ভুল ধারণা আছে।
দেশে ১০০ জনের মধ্যে একজন অন্ধত্বের শিকার। দেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ চোখে দেখে না। ১০০ জনের মধ্যে ১৯ জন কোনো না–কোনো কারণে দৃষ্টি ত্রুটিজনিত সমস্যায় ভুগছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চোখের ছানি সাধারণত বয়স্কদের বেশি হয়। ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়স্কদের জন্য এটা খুবই সাধারণ একটি অসুখ। তবে সব সময় বয়স্কদেরই হবে এমনটা ভাবা ভুল। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের অপেক্ষাকৃত কম বয়সে ছানি হতে দেখা যায়। এমনকি ছানি হতে পারে ছোটদেরও। গর্ভবতী মায়ের কিছু জীবাণু সংক্রমণ হলে সন্তানের চোখে ছানি থাকতে পারে জন্ম থেকেই। গর্ভবতী মায়ের গর্ভধারণের তিন মাসের মধ্যে এক্স-রের মতো কোনো বিকিরণ রশ্মির সংস্পর্শে এলেও গর্ভের সন্তানের জন্মগত ছানির ঝুঁকি থাকে। ছোটদের বা বড়দের চোখে মারাত্মক আঘাত থেকে ছানি হতে পারে। ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করেন কিংবা বিকিরণ এলাকায় কাজ করেন, এমন ব্যক্তির ছানি হওয়ার ঝুঁকি থাকে যেকোনো বয়সে।
ছানি দেখা দিলে কখন অস্ত্রোপচার করতে হবে সেটি নির্ভর করে রোগীর পেশাগত প্রয়োজনের ওপর। অনেকে মনে করেন, নির্দিষ্ট সময় না পেরোলে বা ভালো করে ছানি না পাকলে অস্ত্রোপচার করানো যাবে না। এমন ধারণার কোনো ভিত্তি নেই। প্রয়োজনে যেকোনো সময় ছানির অস্ত্রোপচার করানো যেতে পারে। যেমন, শিক্ষক বা নিয়মিত কম্পিউটার ব্যবহারকারী ব্যক্তির দ্রুত অস্ত্রোপচার করানোটা পেশাগত প্রয়োজন। অন্যান্য পেশাজীবী, যাদের প্রতিনিয়ত খাতা-কলম, কম্পিউটার বা সুই-সুতা ব্যবহার অথবা অন্য কোনো সূক্ষ্ম কাজ করতে হয় না, তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা সময় অপেক্ষা করা যেতে পারে। তবে কখন অস্ত্রোপচার করা নিরাপদ, সেটি চক্ষু বিশেষজ্ঞ ছানির অবস্থা দেখে বলে দেবেন। অতিরিক্ত দেরি হয়ে গেলে ছানিজনিত জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন: গ্লুকোমা ও লেন্স ডিজলোকেশন বা চোখের লেন্স নির্দিষ্ট স্থান থেকে সরে যাওয়া, দৃষ্টি হারানোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
তারা বলেন, চোখের ছানি এড়ানোর জন্য নিয়মিত চোখের যত্ন নেওয়া, দীর্ঘমেয়াদি অসুখ হলে তার চিকিৎসা করা, চোখের ডাক্তারের কাছ থেকে নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করার মতো নিয়মসমূহ মেনে চলা জরুরি। এছাড়া যেসব খাবারের উপাদান সমূহ চোখের জন্য উপকারী সেসব খাবার খাওয়ার দ্বারা ঝুঁকি কমানো যেতে পারে। যেমন-রসুন (অ্যালিসিনন), বাদাম (ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড), পালংশাক (ফাইটো নিউট্রেয়ান্ট), গাজর (ভিটা ক্যারোটিন) পেঁপে (প্যাপিন), মধু, অশ্বগন্ধা, গ্রিন টি ইত্যাদি। চোখের ছানি হলে অন্ধ হয়ে যেতে হবে এমন ভয় না পেয়ে যত দ্রুত সম্ভব চক্ষুবিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন। তাতে রোগমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৭
আপনার মতামত জানানঃ