প্রাচীন চীনের ভয়ংকর কিছু প্রথার একটি ছিল পায়ের পাতার আয়তনকে মহিলাদের রূপ ও সৌন্দর্যের মাপকাঠি মনে করা। আর এই পুরুষতান্ত্রিকতা থেকেই জন্ম নেয় বর্বরোচিত পা ছোটো করার প্রথা। যার নাম— ‘ফুট বাইন্ডিং’ বা ‘পা বাঁধা’। চৈনিকদের কাছে ‘পদ্ম পা’ নামেও পরিচিত এই রীতি।
প্রায় তিন হাজার বছর আগের কথা। ১৭০০ থেকে ১০২৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত চীনে রাজত্ব ছিল শাং বংশের রাজাদের। ‘পা বাঁধা’ প্রথার প্রচলন হয় সেই সময়েই। সম্রাট ঝৌ-এর হাত ধরে এ প্রথা শুরু হয় । শাং রানি আক্রান্ত ছিলেন ক্লাবফুট রোগে। তার শারীরিক অস্বাভাবিকতাকে ঢাকতেই নর্তকীদের পা বাঁধা বাধ্যতামূলক করেছিলেন সম্রাট। ক্রমশ চৈনিক সমাজের মধ্যে সেই রীতি হয়ে ওঠে সৌন্দর্য ও আভিজাত্যের প্রতীক।
আরেক বর্ণনার জন্য ফিরে যেতে হবে ৯৬১ থেকে ৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণ ট্যাং অঞ্চলের সম্রাট লি ইউয়ের কাছে। মূল্যবান পাথর ও মুক্তা দিয়ে সাজিয়ে তিনি প্রায় ৬ ফুট উঁচু পদ্মের ন্যায় এক মঞ্চ তৈরি করেছিলেন। এরপর তার রানি ইয়াও নিয়াংকে সাদা সিল্কের কাপড় দিয়ে তার পাগুলো অর্ধচন্দ্রাকৃতিতে বেঁধে সেই মঞ্চের উপর নাচতে বলেন তিনি। সেদিন নিয়াং এতটাই চমৎকারভাবে নেচেছিলেন যে উপস্থিত সকলের মুখ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গিয়েছিলো। এরপর তার দেখাদেখি রাজসভার অন্যান্য নারীরাও পা বাঁধার নতুন সেই চর্চা শুরু করে দেয়।
তবে এই সবটাই লোককথা। ‘পা বাঁধার’ প্রথম লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায় চীনের ট্যাং বংশের রাজত্বকালে। সেই সময়ই ‘পদ্ম পা’-এর প্রচলন ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা চীনে। তৎকালীন সমাজের ধারণা ছিল, ‘পা বাঁধা’ প্রক্রিয়ার কারণে আকর্ষণীয় হয় মহিলাদের যৌনাঙ্গ। সঙ্গমে তারা বিশেষভাবে তৃপ্তি দিতে পারেন পুরুষদের।
সেই কারণেই প্রায় সমস্ত মহিলাদেরই বাধ্যতামূলকভাবে যেতে হত এই অমানবিক প্রথার মধ্যে দিয়ে। পায়ের আয়তন মাত্র ৪ ইঞ্চির মধ্যে আটকে রাখার চেষ্টা চলত প্রবলভাবে। শুধু স্বাভাবিকতা নষ্টই নয়, পা বাঁধার এই প্রক্রিয়াও ছিল যথেষ্ট কষ্টসাধ্য এবং অমানবিক।
মাত্র তিন থেকে চার বছর বয়সেই চৈনিক মেয়ে শিশুরা সাক্ষী হতো এই বর্বরতার। পায়ের পাতা রেশমের দড়ি দিয়ে মুড়িয়ে বেঁধে রাখা হতো সেই বয়স থেকে। হাড় নরম করার জন্য বিভিন্ন ভেষজ ওষুধ, গরম জল এবং পশুর রক্তে ভিজিয়ে রাখা হতো তাদের পা। তারপর করা হতো অস্ত্রোপচার। তাও সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক পথে।
ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলা হতো পায়ের প্রতিটা আঙুল। কখনো কখনো পায়ের পাতার মাঝের হাড়ও দু’টুকরো করে ব্যান্ডেজ দিয়ে মুড়ে ফেলা হতো সমস্ত পা। ব্যবস্থা ছিল না কোনো ড্রেসিং-এর। কয়েক বছর এই অবস্থাতেই চলাফেরা করতে হতো মেয়েদের। করতে হতো সমস্ত কাজ। ফলে, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটত হামেশাই।
আবার ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যান্ডেজের মধ্যে কখনো ঢুকিয়ে দেওয়া হত কাচের টুকরো বা লোহার আলপিন। যাতে দ্রুত পচন ধরে, খসে পড়ে পায়ের আঙুল। শুধু কৈশোর নয়, আজীবনই তাদের বয়ে বেড়াতে হতো সেই যন্ত্রণা।
চীনের প্রাচীন ইতিহাস অনুযায়ী প্রায় ৪০০ কোটিরও বেশি নারীদের সাক্ষী হতে হয়েছিল এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার। সপ্তাদশ শতকের মাঞ্চু বংশের রাজত্বকালে প্রথম নিষিদ্ধ করা হয় এই প্রথা। তাছাড়াও বিক্ষিপ্তভাবে চীনের বিভিন্ন অংশেও ছোটো ছোটো সাম্রাজ্যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল এই প্রথার ওপরে। তবে তারপরেও থেমে যায়নি এই চল।
উনবিংশ শতকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পদ্ম পা ছিল প্রায় ৪০ শতাংশ চৈনিক নারীদের। পরবর্তীতে পশ্চিমা শক্তির আগমনে বদলে যায় এই পরিস্থিতি। এ বিষয়টির তীব্র বিরোধিতা করে সমাজ সংস্কারকরা। আঠারো শতক থেকে অমানবিক এ প্রথার বিরুদ্ধে আস্তে আস্তে জনমত তৈরি হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নানা সফলতা-বিফলতার গল্প লিখে ১৯১২ সালে সান ইয়াত-সেনের বিদ্রোহের পর চীনে এটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপরও মোটামুটি ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চীনা সংস্কৃতিতে টিকে ছিলো পদ্ম-পা।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৪০
আপনার মতামত জানানঃ