ক্রোয়েশিয়ার সবচেয়ে বড়ো শহর জ্যাগ্রেবে একটি হাসপাতালে ঢুকেই একদিন চমকে উঠেছিলেন ডায়ানা বুডিসাজেভিক। নামেই হাসপাতাল, অথচ সেখানে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থাই নেই। ভগ্ন স্বাস্থ্যের শিশুরা সারি সারি পড়ে আছে মেঝেতে। তার মধ্যে কেউ কেউ মারাও গেছে। মৃতদেহ পড়ে আছে। মাছি উড়ছে। শিউরে উঠেছিলেন বছর পঞ্চাশের ডায়ানা।
নাৎসি জার্মানিতে এই দৃশ্যের কথা তিনি শুনেছেন। তবে জ্যাগ্রেব শহর নাৎসি অধ্যুষিত নয়। সার্বিয়ার কিছু অংশ এবং ক্রোয়েশিয়া নিয়ে তখন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র রয়েছে ঠিকই। তবে সেই রাষ্ট্রের পুতুল সরকার নিয়ন্ত্রণ করতেন নাৎসিরাই। আর তাই নাৎসি জার্মানির সঙ্গে ক্রোয়েশিয়ার ছবিটাও প্রায় একই ছিল।
সময়টা তখন ১৯৪১ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তখনও জার্মানি অপ্রতিরোধ্য। তবে পাল্লা দিয়ে সামরিক প্রযুক্তির উন্নতি ঘটিয়ে চলেছে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড। এই সময় জার্মানিও সামরিক প্রযুক্তির দিকে বিশেষ নজর দেয়। সামরিক কারখানাগুলিতে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে। ঘেটোয় বন্দি ইহুদিদের দিয়েও চাহিদা মিটছে না।
এই পরিস্থিতিতে ক্রোয়েশিয়া থেকে সুস্থ নারী-পুরুষদের বন্দি করে নিয়ে আসতে শুরু করে নাৎসি বাহিনী। ক্রোয়েশিয়ার সরকারও তাতে বিন্দুমাত্র আপত্তি করেনি। তবে বাবা-মা বন্দি অবস্থায় জার্মানিতে চলে গেলেও তাদের সন্তানরা থেকে যায় ক্রোয়েশিয়ায়। তাদের জন্য আলাদা হোম তৈরি করা হলেও তার অবস্থা নাৎসি ঘেটোগুলির চেয়ে কোনো অংশে উন্নত ছিল না। এমনকি অসুস্থ শিশুদের চিকিৎসারও কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
এই সময় নিজেই শিশুদের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ডায়ানা। স্থানীয় এক চিকিৎসকের স্ত্রী তিনি। অভিজাত পরিবারের সদস্য হওয়ায় তিনি নিশ্চিন্তেই কাটিয়ে দিতে পারতেন যুদ্ধের দিনগুলো। কিন্তু অসহায় শিশুদের অবস্থা দেখে তিনি চুপ করে থাকতে পারলেন না। আশ্চর্যজনকভাবে এই সময় ডায়ানার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন এক জার্মান অফিসার, গুস্তাভ ভন ক্রোজিয়ান।
এই অফিসার না থাকলে সরকারের অনুমতি পেতেন না ডায়ানা। এরপর দুই সহকর্মী মার্কো ও দুরোকে নিয়ে শুরু হল কাজ। প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা তো হল। বহু শিশু মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এল। মোটামুটি ৭ হাজার ৭০০ শিশুকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল ডায়ানার এই উদ্যোগ। তবে এখানেই শেষ নয়।
ডায়ানা চেয়েছিলেন সমস্ত শিশুকে তাদের বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু তাদের সন্ধান পাবেন কীভাবে? নাৎসি ঘেটো থেকেও অনেকে চিঠি লিখতেন সন্তানদের উদ্দেশে। সরকারি নথি থেকে সেইসব চিঠি খুঁজে বের করেছিলেন ডায়ানা। তবে ছোট্ট শিশুরা যে নিজেদের নামই বলতে পারে না। কিছু শারীরিক বর্ণনাকে সম্বল করে কয়েকজনের বাবা-মায়ের সন্ধান পেয়েছিলেন ডায়ানা। তবে তাদেরও অনেকেই যুদ্ধের মধ্যে জার্মানিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। ছোট্ট শিশুদের বেশিরভাগই আর নিজের পরিবারে ফিরে যেতে পারেনি।
১৯৪৭ সালে একটি ডায়রি লিখেছিলেন ডায়ানা। সেখানে এই ব্যর্থতার যন্ত্রণাই ঘুরেফিরে এসেছে বারবার। অবশ্য নিজের বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে না পারলেও সেই শিশুদের মাতৃত্ব দিয়ে আগলে রেখেছিলেন তিনি। আজ জীবনের শেষ লগ্নে এসেও ‘দ্বিতীয় মা’-এর কথা ভুলতে পারেন না সেদিনের সেই শিশুরা।
প্রায় নীরবেই কাজ করে গিয়েছেন ডায়ানা। তার ডায়রিও কোনোদিন প্রকাশ করার কথা ভাবেননি। পরবর্তী শতাব্দীতে এসে তার নাতনি সিলভিয়া জ্যাবো সেই ডায়রি প্রকাশ করেন, ২০০১ সালে। এরপর ডায়ানাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক তথ্যচিত্র। এমনকি একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছে তার ডায়রি অবলম্বনে।
তবে তার থেকেও বড়ো পুরস্কার বোধহয় এটাই, আজও সেই শিশুরা তার মাতৃত্বের কথা মনে রেখেছেন। মনে রেখেছেন একসঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো। এর থেকে বেশি কিছু হয়তো চাননি ডায়ানা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৩০
আপনার মতামত জানানঃ