বৈশ্বিক প্রভাবশালী তামাকের কম্পানিগুলো বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষেত্রে শক্তিশালী জায়গায় রয়েছে। সামাজিক কল্যাণ তথা করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি কর্মসূচিকে ব্যবহার করে সহজেই তারা তামাকবিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে কার্যক্রম চালাচ্ছে। তাদের এসব তৎপরতার জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও তেমন কোনো সুফল মিলছে না।
সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে তামাক কম্পানিগুলো এমনকি নীতিনির্ধারক, সরকারি কর্মকর্তা ও প্রশাসনের সহযোগিতায় ব্যবসায়িক সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক ওয়েব সেমিনার তথা ওয়েবিনারে উত্থাপিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য হাজির করা হয়েছে। ২৮ নভেম্বর ২০২০ অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারে ‘তামাক কম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক: এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ বাস্তবায়ন প্রতিবেদন, বাংলাদেশ ২০২০’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রগতির জন্য জ্ঞান-প্রজ্ঞা এই গবেষণা চালিয়েছে।
সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কম্পানির হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ এর আলোকে একটি নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে বেশ কয়েক বছর ধরে এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে প্রজ্ঞা। এ বছর বিশ্বের ৫৭টি দেশে এই গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। তামাক ম্পানির হস্তক্ষেপের বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭তম। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে তামাক কম্পানির হস্তক্ষেপ সবচেয়ে বেশি।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “তামাক কম্পানিগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক (সিএসআর) কর্মসূচির অজুহাতে নীতিনির্ধারক, সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রশাসনযন্ত্রের সাথে মিশে ব্যবসায়িক সুবিধা আদায় এবং তামাকনিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদানের চেষ্টা করেছে। “আর এজন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে তামাক কম্পানির সকল প্রকার সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক (সিএসআর) কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা দরকার।”
প্রজ্ঞা ও আত্মা (অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স) আয়োজিত এই ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা-বাসসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী। বক্তারা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।
গবেষণায় সরকার তামাক কম্পানির হস্তক্ষেপ কীভাবে আমলে নেয় এবং সেগুলো মোকাবেলায় কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ গাইডলাইনের আলোকে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। সূচকে স্কোর যত বেশি, হস্তক্ষেপ তত বেশি। ব্লুমবার্গ ফিল্যানথ্রপিসের স্টপ (স্টপিং টোব্যাকো অরগানাইজেশন্স অ্যান্ড প্রোডাক্টস) প্রজেক্টের আওতায় এই গবেষণায় সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছে গ্লোবাল সেন্টার ফর গুড গভার্নেন্স ইন টোব্যাকো কন্ট্রোল (জিজিটিসি) এবং থাইল্যান্ডের থামাসাত ইউনিভার্সিটি।
গবেষণায় বলা হয়, ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল-এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ বাস্তবায়নে বাংলাদেশে কিছুটা অগ্রগতি হলেও তা ‘সন্তোষজনক নয়’। তামাক কম্পানির হস্তক্ষেপ সূচকে বাংলাদেশের প্রাপ্ত স্কোর ৬৮ অর্থাৎ বাংলাদেশ এখনও তামাক কম্পানির ‘শক্তিশালী হস্তক্ষেপ ঝুঁকির’ মধ্যে রয়েছে। ২০১৯ সালের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রজ্ঞার চালানো এই গবেষণায় বলা হয়, গত বছরের স্কোর ৭৭ থেকে নেমে এবার ৬৮ হয়েছে। কিন্তু এই ধারা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে আশানুরূপ নয়।
প্রধান অতিথি সাবের হোসেন চৌধুরী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “প্রজ্ঞার এই গবেষণার ফলাফলে আশান্বিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ ২০২০ সালে আমরা ভালো অবস্থানে নেই। তামাক কম্পানির প্রভাবের কারণে কোভিড-১৯ এর বছর ২০২০ সালের গবেষণার ফলাফলে (২০২১ সালে প্রকাশিত হবে) আমরা পিছিয়ে যাব।” মহামারীর মধ্যে তামাক কম্পানিগুলো নিত্য প্রয়োজনীয় তালিকায় তামাক পণ্য থাকার সুযোগ নিয়ে বিক্রয়-বিপণন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য সংসদের বিল জমা দেওয়া হয়েছে। এটা পাশ হলে ২০৪০ সালে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার আরেকটি ধাপ এগিয়ে যাবে।” তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন, এফসিটিসি ৫.৩ সহ যেসব ধারা আছে সেগুলো টোব্যাকো নিয়ন্ত্রণ আইনে যাতে যুক্ত হয় সেজন্য চেষ্টা করবেন তিনি।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের প্রাক্তন সমন্বয়ক মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছাড়াও অর্থ, শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়কে এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ প্রতিপালনের বাধ্যবাধকতা বিষয়ে সচেতন করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “এতে চলমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন প্রক্রিয়াসহ সকল ক্ষেত্রে তামাক কম্পানির হস্তক্ষেপমুক্ত থাকা যাবে।”
এসডাব্লিউ/আরা/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ