অদ্ভুত শোনালেও ঢাকায় মোট সড়কের ৭০ ভাগ জায়গা দখলে রাখছে মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি। অথচ ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ মানুষ। এসব গাড়িতে চলাচল করেন মাত্র ৭ শতাংশ। বাকি ৯৩ শতাংশ মানুষ চলাচল করেন বাস, রেল, নৌপথ, রিকশা ও হেঁটে। কিন্তু এ মাধ্যমগুলোর জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে না; ফলে বাড়ছে যানজট।
এই যানজটের কারণে অতিষ্ঠ শুধু সাধারণ মানুষের জীবন নয়, প্রতিনিয়ত শূন্য হচ্ছে রাষ্ট্রের পকেটও। নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান কর্মঘণ্টা। পাশাপাশি যানজটে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় তৈরি হয় মানসিক অবসাদ। গবেষণা বলছে, যানজটের কারণে শুধু ঢাকায় দিনে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার আর্থিক ক্ষতি দিয়ে তিনটি পদ্মাসেতু নির্মাণ সম্ভব ছিল। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যেভাবে যানজট পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে, তাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
নির্মাণ করা যেত ৩ টি পদ্মাসেতু
শুধু ঢাকার যানজটের কারণেই বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৯ শতাংশে। ২০১৫-১৬ সালের নতুন ভিত্তি বছরের হিসাবে অর্থমূল্যে এই ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। আর অপরিকল্পিত নগর সম্প্রসারণের পরোক্ষ ক্ষতির হিসাব যুক্ত হলে এ ক্ষতি জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি হয়ে যায়।
রাজধানী ঢাকার অসহনীয় যানজটে শুধু মানুষের ভোগান্তি ও কর্মঘণ্টাই নষ্ট হচ্ছে না— এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জিডিপি এবং মাথাপিছু আয়ও। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি সম্মেলনে উপস্থাপিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।
দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে পদ্মা সেতু। এই সেতুতে বদলে যাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য। অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়াবে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়াবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। আর দারিদ্র্য বিমোচনের হার বাড়াবে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ। এই সেতুর নির্মাণ ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি।
রাজধানীর যানজটের কারণে প্রত্যক্ষ যে টাকার ক্ষতি হচ্ছে, তা দিয়ে তৈরি করা যেত পদ্মা সেতুর সমান দৈর্ঘ্য ও সুবিধার তিনটি সেতু। এতে অবকাঠামোর উন্নয়ন যেমন হতো, তেমনি গতি বাড়ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেরও। ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারত ৩ শতাংশের বেশি। দারিদ্র্য বিমোচনের হারও বাড়ত আড়াই শতাংশের কাছাকাছি।
নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা
এছাড়াও ঢাকার যানজটের কারণে প্রতি মাসে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে কর্মজীবীদের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জিডিপিতে। অর্থনীতির এই ক্ষতিকে আরও বড় করে তুলেছে রাজধানীর অপরিকল্পিত নগরায়ণ।
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে নগরে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপের বিষয়টিও উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ১১ দশমিক ২ শতাংশই বাস করে ঢাকায়— যা এই অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ।
চীনের বৃহত্তম শহর সাংহাই, দেশের জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ যেখানে বাস করে। প্রতিবেশী ভারতের প্রধান শহরে বাস করে দেশের জনসংখ্যার ২ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৪ শতাংশ, পাকিস্তানে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ভিয়েতনামে ৮ দশমিক ১ শতাংশ।
প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ১০ লাখের বেশি মানুষ বাস করে বাংলাদেশে এমন শহর আছে মাত্র ৫টি। চীনে এমন শহরের সংখ্যা ১০২। এছাড়া ভারতে ৫৪, ইন্দোনেশিয়ায় ১৪, পাকিস্তানে ১০।
এআরআই’র গবেষণায় বলা হয়, ২০১৫ সালের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) অনুযায়ী, ঢাকায় দৈনিক প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ ট্রিপ হয়। উল্লেখ্য, একজন মানুষ কোনও একটি বাহনে উঠে নির্ধারিত গন্তব্যে নামলে একটি যাত্রা বা ট্রিপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এই প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিসীমা গড়ে ছিল ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার। ২০০৯ সালে তা ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৮ কিলোমিটারে এসে দাঁড়ায়। যানবাহনের পরিমাণ যদি একই হারে বাড়তে থাকে এবং তা নিরসনের কোনও উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীর অসহনীয় যানজটের সবচেয়ে বড় কারণ শহরটির দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থাপনা ও যোগাযোগ অবকাঠামো। ঢাকার রাস্তা যে পরিমাণ গাড়ি ধারণে সক্ষম, তার চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ বেশি গাড়ি চলে।
পাশাপাশি ঢাকার সব যানজটের ৩০ শতাংশের জন্য দায়ী পার্কিং ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা। ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে নতুন নতুন অবকাঠামো গড়ে তুললেও সেগুলোর ব্যবস্থাপনা ভালো নয়। ফলে এসব অবকাঠামোর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো বাড়ছে যানজট।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার অসহনীয় যানজট সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য রাজধানীতে সঠিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও পরিবহন ব্যবস্থাপনা চালু করা দরকার। এছাড়াও পথচারীবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা, উন্নত গণপরিবহন প্রবর্তন, গণপরিবহনের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ, পার্কিং ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারীদেরও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এসএস/১১০১
আপনার মতামত জানানঃ