কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্যারাবন নিধন আর সরকারি খাসজমি দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের মহোৎসব চলছে। থেমে নেই নদীতে ড্রেজার বসিয়ে অবৈধ বালু উত্তোলন, অবাধে পাহাড়কর্তন, বনের গাছ নিধন ও মাটি বিক্রিও। কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর তীরে সৃষ্ট প্যারাবনের (ম্যানগ্রোভ) আনুমানিক ১৫ হাজার গাছ কেটে দখল করা হয়েছে কয়েক শ একরের জলাভূমি। গাছপালা উজাড় হওয়ায় ধ্বংস হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আবাসস্থল ও জীববৈচিত্র্য। কাটা গাছের গোড়ালি যাতে প্রশাসনের কেউ দেখতে না পান এ জন্য ট্রাকে মাটি ও বালু নিয়ে চলছে ভরাটের কাজ।
কয়েক দিন ধরে প্যারাবনের বিশাল ভূমি টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখে সেখানে ভরাটের কার্যক্রম চালানো হলেও বাধা দেওয়ার কেউ নেই। বাঁকখালী নদীর দখলদারদের উচ্ছেদ, দখল বন্ধ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, দখলবাজরা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকায় তারা স্থানীয় প্রশাসনকে তোয়াক্কা করছে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিকবার চেষ্টা করেও অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে প্যারাবন উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বাধা দিতে গিয়ে হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে বন কর্মকর্তাদের।
সূত্র আরো জানায়, প্রায় দেড় হাজার একর জমি এখন তিন ভাগে প্রভাবশালীদের দখলে। এর মধ্যে প্রায় ৫০০ একর জমির অবৈধ দখল করে চিংড়িঘেরের জন্য প্রস্তুত করেছে জনৈক প্রভাবশালী। আর প্রায় ১ হাজার একরের মতো জমি দখল করে কাজ করে যাচ্ছে প্রভাবশালীরা।
বনভূমির একাংশে স্থাপনা তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আমির আলী নামের একজন। তিনি জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, এখানে (প্যারাবনে) কয়েক শ একর জমি অন্তত ২০০ লোক কিনে নিয়েছেন। তিনি (আমির আলী) কিনেছেন ১৪ শতক জমি। তবে তিনি প্যারাবনের গাছ কাটার সঙ্গে জড়িত নন। কিছু শ্রমিক রাতের বেলায় গাছগুলো কেটে নিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন দখলদার বলেন, স্থানীয় কয়েক প্রভাবশালী ব্যক্তি শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে রাতে হাজার হাজার কেউড়া, বাইনগাছ কেটে বনভূমি টিন দিয়ে ঘিরে দখলে নিচ্ছেন। এরপর প্রতি গন্ডা (দুই শতক) জমি ১০ থেকে ১২ লাখ টাকায় বিভিন্ন লোকজনের কাছে বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।
জানা গেছে, চকরিয়া চরণদ্বীপ মৌজায় দেড় হাজার একরের বেশি এই প্যারাবনে পাঁচ লাখ ৩৭ হাজারের বেশি বাইন ও কেওড়া গাছ ছিল। ইতিমধ্যে তিন লাখের বেশি গাছ কেটে চিংড়িঘের করায় উপকূলের ১০ লাখ মানুষ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অথচ বন বিভাগের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। পাশাপাশি জেলা প্রশাসনও রক্ষার কাজ না করে উল্টো কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে।
কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর তীরে সৃষ্ট প্যারাবনের (ম্যানগ্রোভ) আনুমানিক ১৫ হাজার গাছ কেটে দখল করা হয়েছে কয়েক শ একরের জলাভূমি।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, জাপানি একটি পরিবেশবাদী সংস্থার কর্মীরা জোয়ারের প্লাবন থেকে শহরবাসীকে রক্ষার জন্য বাঁকখালী নদীর তীরে কয়েক হাজার বাইন ও কেওড়াগাছের চারা রোপণ করেছিলেন কয়েক বছর আগে। সেগুলো ২০ থেকে ২৫ ফুট উচ্চতার হয়েছে। এখন সেসব গাছ কেটে জলাভূমি দখল করে নিচ্ছে প্রভাবশালী মহল।
কস্তুরাঘাটের ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের অভিযোগ, বদরমোকাম হয়ে খুরুশকুল পর্যন্ত সংযোগ সেতু নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর থেকে মূলত নদী দখল শুরু হয়। নির্মাণাধীন সেতুর দুপাশে চলছে প্যারাবন উজাড় করে নদী দখল ও ভরাটের কাজ। এতে নদীর গতিপথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। জোয়ার-ভাটার অংশ ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে স্থাপনা। প্যারাবন দখল-বেদখল নিয়ে দখলদারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব–সংঘাতও চলছে।
সরেজমিনে দখল তৎপরতা দেখে পরিবেশবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘এনভায়রনমেন্ট পিপল’–এর প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, স্থানীয় লোকজনের অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনাস্থলে গিয়ে প্যারাবনের অন্তত ১৫ হাজার গাছ কেটে নেওয়ার চিত্র দেখতে পান তিনি। শুধু গাছ কাটাই নয়, সেখানে প্রকাশ্যে নদী দখল, ভরাট ও দূষণ করা হচ্ছে। মৌখিক ও লিখিতভাবে একাধিকবার সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে অভিযোগ দেওয়া হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
এদিকে গত শনি ও রোববার সকাল ও বিকেলে দুই দফায় বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাটের বদরমোকাম জামে মসজিদসংলগ্ন পয়েন্টে দেখা গেছে, উজাড় করা বনভূমিতে (জলাশয়) ট্রাকে করে আনা মাটি ও বালু ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। একই সঙ্গে চালানো হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও নির্মাণকাজ। দখলদারদের কেউ কেউ প্যারাবনের জমিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি উল্লেখ করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছেন।
খুটাখালী বনবিটের অধীন পাগলিবিল এলাকায় অসংখ্য শক্তিশালী ড্রেজার বসিয়ে ছড়া থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের কারণে আশপাশের এলাকায় ভাঙন ধরেছে। হুমকির মধ্যে রয়েছে জীববৈচিত্র্য।
এ বালি উত্তোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রায় ৪ কিলোমিটার এলাকার বসতবাড়ি রাস্তাঘাট, মুক্তিযোদ্ধা সামাজিক বনায়ন, ২০০৭/২০০৮ সালের বনবিভাগের সৃজিত সেগুন বাগিচা, মধুশিয়ার শত বছরের গর্জন বাগানসহ বিভিন্ন অবকাঠামো।
অনেকই পরিবেশ বির্পযয়ের আশংকায় বসতবাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। নানাভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হলেও এর সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জড়িত থাকায় নেয়া যাচ্ছে না কোনো পদক্ষেপ।
শহরের কলাতলী হোটেল মোটেল জোন এলাকার সুগন্ধা পয়েন্টে কোটি টাকা মূল্যের সরকারি জমি দখল করে নির্মিত হয়েছে মার্কেট ও দোকানঘর। একইভাবে মেরিন ড্রাইভ সড়কের দুপাশেই অসংখ্য দখলবাজ থাবা বিস্তৃত করে রেখেছে। দখল করা হয়েছে হিমছড়ি এলাকার বনভূমি।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, পাহাড় ও বন কাটার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের মাঝেমধ্যে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। গাছ কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বা পরিবেশ আদালতে মামলা করেই যেন পরিবেশ অধিদপ্তর দায়িত্ব শেষ। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং বন ধ্বংসকারীদের আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। জরিমানা ছাড়াও পাহাড় বেষ্টনী দিয়ে বনায়ন করতে হবে।
তারা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, সেগুলোতে একই অপরাধ বারবার হলে শাস্তির মাত্রা কয়েক গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পরিবেশ আইনে যদি এমন দুর্বলতা থাকে, তাহলে তা দূর করা এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে পরিবেশ ধ্বংসকারী দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ দ্রুতই বনশূন্য হয়ে যাবে, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল বলে কিছু থাকবে না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে মিলে বন থেকে গাছ চুরি করলে বন রক্ষা করার আর কোনো উপায় থাকে না। তারা শক্তিশালী সিন্ডিকেটে পরিণত হয়েছে বলেই বুক সটান করে গাছ চুরি করে থাকে। এব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়ার মতো সাহসও কেউ দেখাতে পারে না। উল্টো তাকে দৌড়ের ওপর থাকতে হয়। গাছ চুরি বন্ধে এসব শক্তিশালী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উর্ধবতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৩
আপনার মতামত জানানঃ