১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর ভূমিকম্পে চট্টগ্রাম নগরের হামজারবাগে সওদাগর ভিলা নামে পাঁচতলা একটি ভবন ধসে পড়ে। এ ঘটনায় ২৩ জন নিহত হন। বর্তমানেও শহরে অসংখ্য বহুতল ভবন আছে, যেগুলো বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণ করা হয়নি। ফলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ভবন ধসের ঝুঁকি আছে। সবশেষ ২৬ নভেম্বরের (শুক্রবার) ভূমিকম্পে চট্টগ্রাম নগরীতে দুটি ভবন হেলে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন অবস্থানগত কারণে রিখটার স্কেলে সাত দশমিক পাঁচ থেকে আট দশমিক পাঁচ মাত্রার বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে চট্টগ্রাম। এই মাত্রায় ভূমিকম্প হলে নগরীর দেড় লাখ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। এক্ষেত্রে ভূমিকম্প সহনীয় নয় এমন ভবন চিহ্নিত করে সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতে এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
গত কয়েক দিনের ভূমিকম্পে চট্টগ্রাম মহানগরীর দালান-কোঠাগুলো নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ভবনগুলোর কি অবস্থা হতে পারে, তা ভেবে শঙ্কিত অনেকে বিশেষজ্ঞ। চট্টগ্রাম মহানগরীর বেশির ভাগ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। নগরীতে পাঁচ-ছয় তলা বিশিষ্ট ভবনের সংখ্যা সর্বাধিক। কিন্তু এই সব ভবন বা স্থাপনা স্ট্রাকচারাল ডিজাইন বা গাঠনিক নকশার নিয়ম মেনে করা হয়েছে কিনা তা প্রকৃতপক্ষে দেখার কেউ নেই।
ভূমিকম্পের যে ভয়াবহ ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম
ভূমিকম্পের জন্য যে কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ ফল্ট লাইন আছে তার বেশ কয়েকটা বাংলাদেশের আশপাশে অবস্থান করছে। চট্টগ্রাম অঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় পড়েছে। এই অঞ্চলে যে ফল্ট লাইন আছে তাতে ৭.৫ থেকে ৮.৫ মাত্রায় ভূমিকম্প হতে পারে।
সূত্র মতে, ভূ-স্তরের ইউরোশিয়ান বা বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের ভূ-অবস্থানগত ভূমিকম্প জোনের মধ্যেই রয়েছে চট্টগ্রাম। এগুলোর সংযোগস্থল আশপাশের এলাকাতেই। তাই বলা যায় এই জোনটা ভেরি অ্যাক্টিভ।
ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চিটাগাং (ইউএসটিসি)-এর উপাচার্য প্রফেসর ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, চট্টগ্রাম নগরীর ১ লাখ ৮৩ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার ভবনই ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব ভবনের মধ্যে ৭৫০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছোটবড় বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে।
এক গবেষণায় দেখা যায়, রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৫ বা তার চেয়ে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে চট্টগ্রাম শহরে মারাত্মক মানবিক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দর, শাহ আমানত বিমানবন্দর, ইস্টার্ন রিফাইনারিসহ কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম তীর সংলগ্ন অধিকাংশ বৃহদাকার স্থাপনাই বেলে মাটির ওপর নির্মিত। এ কারণে ভূমিকম্পের সময় সেখানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
কোনো পেট্রোকেমিক্যাল স্থাপনায় আগুন লাগলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। কর্ণফুলী ও হালদা নদীর ওপর ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি সেতু ভেঙে পড়লে নগরীর সঙ্গে বৃহত্তর চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। কক্সবাজারের মহেষখালী ও মাতারবাড়িতে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলমান রয়েছে। কক্সবাজারের পাশেই ইউরেশিয়ান প্লেটের অবস্থান যা ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
এ কারণে এসব প্রকল্পের স্থাপনাগুলো যদি সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে নির্মিত না হয় তাহলে বড় ভূমিকম্প বা সুনামির সময় মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। তিনি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা ভবনসমূহের শক্তি বাড়ানোর জন্য নিয়মিত অ্যাসেসমেন্ট করার পরামর্শ দেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালসহ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের শক্তি বৃদ্ধিতে সহজ শর্তে ঋণ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
যে সব কারণে বাড়ছে ঝুঁকি
ভবনের নকশা অনুমোদন থেকে নির্মাণকাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত তদারকি করতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিম ছাড়া কলাম ও স্লাব বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে। নিচের তলাগুলোতে বাণিজ্যিক ও ওপরের দিকে আবাসিক সুবিধা রেখে নির্মিত ভবনগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড-১৯৯৩ অনুসরণ করে ভবন নির্মাণের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ভূমিকম্প প্রতিরোধী নিয়মাবলী প্রয়োগ করলে ভবন নির্মাণ খরচ মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
চট্টগ্রাম নগরীর ১ হাজার ৩৩টি স্কুলের মধ্যে ৭৪০টি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে মন্তব্য করে ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অনেক স্কুলই টেকসই নয়। বিভিন্ন ভবনের নিচের তলায় গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় স্কুল করা হয়েছে। এসব স্কুলকে টেকসই করতে খুব শিগগিরই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম তীর সংলগ্ন অধিকাংশ স্থাপনা ঝুঁকিপূর্ণ মন্তব্য করে ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, কর্ণফুলী নদীর তীর পশ্চিম তীর ঘেঁষে যেসব বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে সেগুলো ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে সতর্ক হলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এ ধরনের স্বল্প উচ্চতার ভবনের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন পরীক্ষা করা হয় না। সিডিএর স্ট্রাকচারাল ডিজাইন পরীক্ষার কোনো সেল বা বিভাগ নেই। ফলে স্ট্রাকচারাল ডিজাইন পরীক্ষা না হওয়ায় নকশায় কম বেশি দুর্বলতা থাকার সম্ভাবনা থেকে যায় বলে সংশ্লিষ্ট সিডিএর এক প্রকৌশলী জানান।
তিনি জানান, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) কর্তৃক যে সব ভবন ও স্থাপনার নকশা দেওয়া হয় তার মধ্যেও নির্মাণের সময় অধিকাংশই কম বেশি পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। এর ফলেও ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সংশ্লিষ্টদের মতে নগরীর ভবন ও স্থাপনার শতকরা ৯০ ভাগই নকশা বহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন কিংবা সরকারি যেকোনো সংস্থার উদ্যোগে দেশে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা চিহ্নিত করা জরুরি। বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় অন্তত প্রথমে এই দুটি অঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা চিহ্নিত করে স্থাপনাসমূহের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। আবার ভবনসমূহের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন পরীক্ষা করে প্রয়োজনে রেক্টোফিটিং সিস্টেমের মাধ্যমে দুর্বল ভবনসমূহের স্ট্রেংগথ বাড়ানো যেতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ