আরবের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ ইয়েমেন। এর ওপর মধ্যপ্রাচ্যের মোড়ল সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট গত ছয় বছর ধরে দেশটির ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আধিপত্য বিস্তারের এই লড়াইয়ে ইয়েমেনের কয়েক লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে আরও লাখ লাখ মানুষ। দেশটির অবকাঠামো খাত প্রায় ধ্বংসের মুখে। এদিকে ইয়েমেনে সৌদি জোটের বিভিন্ন রকম হামলা অব্যাহত রয়েছে।
জাতিসংঘের নতুন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের শেষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মিলে সৌদি জোটের সঙ্গে যুদ্ধরত ইয়েমেনে মৃত্যু তিন লাখ ৭৭ হাজারে দাঁড়াবে। দেশটিতে ২০৩০ সালের মধ্যে সংঘাত, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কারণে প্রায় ১৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
মঙ্গলবার প্রকাশিত ইউএনডিপির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চলতি বছরের শেষে ইয়েমেনে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৩ লাখ ৭৭ হাজারে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু। মূলত বিমান হামলা ও সংঘাতের মতো প্রত্যক্ষ এবং সংক্রামক রোগ, ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের মতো পরোক্ষ কারণে দেশটিতে মৃত্যুর এসব ঘটনা দেখা যেতে পারে বলে মনে করছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে ইউএনডিপি বলেছে, ৬০ শতাংশ মৃত্যু ঘটতে পারে পরোক্ষ কারণে।
এ বিষয়ে ইউএনডিপি’র কর্মকর্তা আচিম স্টেইনার বলেন, ‘ইয়েমেনে যুদ্ধের ময়দানের তুলনায় রোগ-ক্ষুধায় বেশি মানুষের মৃত্যুর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা যুদ্ধ ক্ষেত্রে মৃত্যুর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে।এটা ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকট। এই সংকট নিরসনে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।’
যুদ্ধে ইয়েমেনে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে বলে বর্ণনা করেছে জাতিসংঘ। ইতোমধ্যে কয়েক লাখ মানুষ মারা গেছেন। দেশটির দেড়কোটিরও বেশি মানুষ চরম দারিদ্রের মধ্যে বসবাস করছেন।
ইউএনডিপির নতুন প্রতিবেদনে ধারণা করা হয়েছে, বিবদমানপক্ষগুলোর মধ্যে ২০২২-এর জানুয়ারি মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তিতে পৌঁছাতে পারে তবে ইয়েমেনিরা ২০৪৭ এর মধ্যে দারিদ্র দূর করতে পারবে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুদ্ধের ফলে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অপুষ্টির শিকার ইয়েমেনের নারী ও শিশুরা। তীব্র অপুষ্টির শিকার ১২ লাখ নারী ও ২৩ লাখ শিশুর জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা প্রয়োজন। এর মধ্যে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ঝুঁকিতে আছে চার লাখ শিশু।
সেভ দ্য চিলড্রেনের হিসেবে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তীব্র অপুষ্টিতে মারা গেছে ৮৫ হাজার শিশু। জাতিসংঘের হিসেবে দেশটির এক কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষ থেকে মাত্র এক কদম দূরে রয়েছে।
প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের সুবিধা না পাওয়ায় ২০১৭ সালে ইয়েমেনে ভয়ংকর রূপে ছড়িয়ে পড়েছিল কলেরা রোগ। ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশটিতে কলেরায় সাত হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। অথচ সৌদি আরব যুদ্ধ বন্ধ তো দূরের কথা এক প্যাকেট স্যালাইনও ইয়েমেনে পাঠায়নি।
ইয়েমেনের মানবিক পরিস্থিতির বিষয়ে আগেই সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। যদি চলতি বছরে জরুরিভিত্তিতে যথাযথ সহায়তা করা না যায় তাহলে ইয়েমেন মৃত্যুকূপে পরিণত হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। ইয়েমেনে সহায়তার জন্য যে পরিমাণ অর্থ জাতিসংঘ চেয়েছে তার অর্ধেক দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দাতারা। তারপরই এমন সতর্ক করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
গুতেরেস বলেন, লাখ লাখ ইয়েমেনি শিশু, নারী এবং পুরুষের বেঁচে থাকার জন্য জরুরিভিত্তিতে সহায়তা প্রয়োজন। এই সহায়তা যদি কমানো হয় তাহলে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হবে। এক্ষেত্রে দাতারা যে সাড়া দিয়েছেন তাকে ‘হতাশাজনক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘ প্রধান।
গুতেরেস জানিয়েছেন, সাহায্যের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া মানে, ইয়েমেনের মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া। লক্ষ্য ছিল ৩৮৫ কোটি ডলার তোলার। মোট একশটি দেশের কাছ থেকে এই অর্থ জোগাড় করা হচ্ছিল। জাতিসংঘের মতে, মানবিক সমস্যা সমাধানের জন্য এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে মাত্র ১৭০ কোটি ডলার উঠেছে।
‘ইয়েমেনে যুদ্ধের ময়দানের তুলনায় রোগ-ক্ষুধায় বেশি মানুষের মৃত্যুর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা যুদ্ধ ক্ষেত্রে মৃত্যুর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে।এটা ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকট। এই সংকট নিরসনে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।’
তাই গুতেরেস জানিয়েছেন, পরিস্থিতি খুবই হতাশাজনক। ২০১৯ সালে দেশগুলি ইয়েমেনকে সাহায্য করার জন্য যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা তারা রাখেনি। ফলে ইয়েমেনে মানুষের অবস্থা ভয়াবহ। সেখানে শৈশব নারকীয়। তাদের না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। তাই গুতেরেসের আবেদন, সব দেশই আবার বিষয়টি ভেবে দেখুক এবং প্রতিশ্রুত অর্থ দিক। না হলে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ থেকে ইয়েমেনকে বাঁচানো যাবে না।
জাতিসংঘের হিসাব, এই বছর দেশের এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ না খেয়ে থাকবেন। পাঁচ বছরের কম বয়সী চার লাখ শিশু না খেতে পেয়ে মারা যেতে পারে।
২০১৫ সালে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদিকে উচ্ছেদ করে রাজধানী সানা দখলে নেয় দেশটির ইরান সমর্থিত শিয়াপন্থী হুথি বিদ্রোহীরা। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন ক্ষমতাচ্যুত হাদি। হুথির ক্ষমতা দখলের পর থেকেই হাদির অনুগত সেনাবাহিনীর একাংশ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। হাদির পক্ষ হয়ে হুথির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনে প্রায় ছয় বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছে। দেশটির বিভিন্ন অংশে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। বলা হয়ে থাকে, ইয়েমেনের যুদ্ধের আড়ালে আদতে লড়াই চলছে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে। ওদিকে আবার সৌদি আরব ও ইরানের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মতো পরাশক্তিরা। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনীতির কলকাঠি নাড়ছে ইসরায়েল। ইয়েমেনের হাউছি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আবদুল মালিক আল-হাউছির দাবি, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের দেশগুলো গোপনে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা করছে। তারা মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাতে লিপ্ত। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে সৌদি আরবের শাসকরা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোট করেছে।
ইয়েমেনের এই সংঘাতকে মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্যের লড়াইয়ে সৌদি-ইরানের ‘ছায়াযুদ্ধ’ হিসেবে দেখা হয়। টানা গৃহযুদ্ধ ও সংঘাত চলার ফলে প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এবং এক সময়ের স্বচ্ছল এই দেশ। জাতিসংঘ বলছে, ইয়েমেনের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ খাদ্য ও ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের গুরুতর সংকটে ভুগছেন।
ইয়েমেনের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ইন্ধন জুগিয়েছিল আরব বসন্ত। ক্ষমতার পালাবদলের আগে ইয়েমেনের দীর্ঘকালের প্রেসিডেন্ট ছিলেন একনায়ক আলী আবদুল্লাহ সালেহ। প্রচণ্ড বিক্ষোভের মুখে ২০১১ সালে আবদ রাব্বু মনসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শুরু থেকেই নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছিলেন হাদি। একদিকে জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল, অন্যদিকে ইয়েমেনের দক্ষিণে বিস্তার লাভ করছিল বিচ্ছিন্নতাবাদ। আর হুথি বিদ্রোহীরা তো ছিলই।
ইয়েমেনে ওই সময় আরও কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যা ছিল। আগের প্রেসিডেন্টের প্রতি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের আনুগত্য ছিল বিব্রতকর। দুর্নীতি, খাদ্যাভাব ও বেকারত্বের উচ্চ হারের মতো বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে ইয়েমেন। এর মধ্যে শিয়া ধর্মাবলম্বী হুথিরা নতুন করে বিদ্রোহ শুরু করে। নতুন প্রেসিডেন্ট হাদির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে উত্তর ইয়েমেনের ‘সাদা’ প্রদেশ এবং এর আশপাশের এলাকা দখল করে নেয় হুথিরা।
এ সময় সুন্নিসহ অনেক সাধারণ ইয়েমেনি নাগরিকও হুথি বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়েছিল। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে সানা দখল করে নেয় হুথিরা। ফলে ইয়েমেনে দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। একটি সরকার পক্ষ, আরেকটি হুথি বিদ্রোহীরা। আলী আবদুল্লাহ সালেহর সমর্থক সেনারাও হাত মিলিয়েছিল হুথিদের সঙ্গে। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে এমন বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান আবদ রাব্বু মনসুর হাদি।
শিয়া হুথি বিদ্রোহীদের ইরান সহযোগিতা করছে— এমন অভিযোগ তুলে এর পরপরই দৃশ্যপটে আসে সৌদি আরব। সৌদিদের পক্ষে যোগ দেয় আরব বিশ্বের সুন্নিপ্রধান আরও ৮টি দেশ। শুরু হয়ে যায় হাদির পক্ষে জোটগত সামরিক অভিযান। এই জোটকে গোয়েন্দা তথ্য ও সামরিক সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। সেই থেকে ইয়েমেনে হানাহানি চলছেই।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সংঘাতজর্জর দেশটিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। যতদিন যাচ্ছে ততই ইয়েমেন সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আর বিশ্ব অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের ফলে দেশটি বর্তমানে ইতিহাসের চরম মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছে। অচিরেই এই যুদ্ধ থামানো না গেলে বিশ্ব একটি মানব সভ্যতাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৭
আপনার মতামত জানানঃ