লন্ডন থেকে পালিয়ে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএসে যোগ দিতে সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শামীমা বেগম। তারপর ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। তিনি দেশে ফেরার জন্যে আবেদন জানিয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে কিন্তু সেটা খারিজ করে দেয়। বার বার আকুতি জানানো পরও ব্রিটেনে ফিরতে পারছেন না শামীমা।
যুক্তরাজ্যে ফিরতে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আকুতি জানাচ্ছেন আইএস-বধূ শামীমা, চান স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আর একটা সুযোগ। যুক্তরাজ্যকে উদার হয়ে তাকে দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়ার এই আহ্বান জানান তিনি।
শামীমা বেগম ব্রিটিশ জনগণ ও সরকারের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাকে ব্রিটেনে ফেরার সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। ব্রিটেনে ফিরে তিনি সন্ত্রাসবাদ দমনে ব্রিটিশ সরকারকে সহায়তাও করতে চান।
শামীমা বেগম ব্রিটিশ নাগরিকত্ব হারানোর পর বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ব্রিটেনে ফিরে আসার সুযোগ পেতে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন ছয় বছর আগে সিরিয়ায় পালিয়ে যাওয়া শামীমা।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসে যোগ দিতে যাওয়ার সময় তিনি যুক্তরাজ্যকে ঘৃণা করতেন না। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো মোকাবিলায় আদালতে আইনি লড়াইয়ের সুযোগ পাওয়ার আবেদন জানিয়েছেন তিনি।
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যেকোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার এবং অভিযোগের মুখোমুখি হওয়ার জন্য তিনি কীভাবে যুক্তরাজ্যে ফিরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন সেসব নিয়ে আগেও কথা বলেছিলেন শামীমা বেগম।
স্কাই নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তার বিরুদ্ধে আনা আইএসের হয়ে চালানো নৃশংসতার অভিযোগ বারবার অস্বীকার করে বলেছেন, এসব একেবারে মিথ্যা।
ব্রিটেনের নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার ‘আশা এবং স্বপ্ন’ দেখেন শামীমা বেগম। তবে নাগরিকত্ব যদি পুনর্বহাল করা না হয়, সেক্ষেত্রে অন্য কোনো পরিকল্পনার বিষয়ে এখনও ভাবছেন না বলেও জানিয়েছেন। স্কাই নিউজকে শামীমা বলেছেন, ‘আমি এসবের বিরুদ্ধে আদালতে লড়তে ইচ্ছুক। কিন্তু আমাকে কোনো সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।’
তিনি বলেছেন, ‘‘একজন কিশোরী হিসেবে যুক্তরাজ্য ছাড়ার সিদ্ধান্তটি দ্রুত নেওয়া হয়নি। বরং এটি এমন একটি বিষয় যা নিয়ে তিনি ‘কিছুক্ষণের জন্য ভেবেছিলেন।’’ শামীমা বেগম বলেন, ‘আমি ব্রিটেনকে ঘৃণা করিনি। আমি আসলে আমার জীবনকেই ঘৃণা করছি।’
‘আমি খুব সংকুচিত বোধ করছি এবং আমার মনে হয়েছে, আমি একজন ব্রিটিশ নারী হিসাবে যুক্তরাজ্যে যে জীবন চেয়েছিলাম; তা নিয়ে আমি বাঁচতে পারব না।’
‘মনে হচ্ছে এখানে আসাটাই আমার একমাত্র অপরাধ। আর এই অপরাধে আমি কারাগারে যেতে ইচ্ছুক। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, আমি কেবলমাত্র সেসবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাই।’
শামীমা বেগম ব্রিটিশ নাগরিকত্ব হারানোর পর বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ব্রিটেনে ফিরে আসার সুযোগ পেতে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন ছয় বছর আগে সিরিয়ায় পালিয়ে যাওয়া শামীমা।
বর্তমানে সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আল-রোজ শরণার্থী শিবিরে আছেন শামীমা বেগম। বসবাসের জন্য এই শিবির এখন অত্যন্ত ভীতিকর হয়ে উঠছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। আইএসের এই বধূ বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে এই শরণার্থী শিবিরে সহিংসতা ছিল না। কিন্তু বর্তমানে কিছু কারণে এখানে বসবাস করা আরও ভীতিকর হয়ে উঠেছে। নারীরা অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
তিনি বলেন, সঠিক সময়ে তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পুনর্মিলিত হতে চান। আমি মনে করি না, তারা আমাকে ব্যর্থ করবে; যেভাবে আমি তাদের ব্যর্থ করেছি।
শামীমার পিতা যুক্তরাজ্যপ্রবাসী আহমেদ আলী সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার আশারকান্দি ইউনিয়নের দাওরাই গ্রামের বাসিন্দা। একই গ্রামের আসমা বেগমকে বিয়ে করে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছিলেন। সেখানে আসমা বেগম এবং আহমদ আলী দম্পতির চার মেয়ে। এর মধ্যে শামীমা বেগম সবার বড়। একপর্যায়ে স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ১৯৯০ সালে আহমদ আলী দেশে চলে আসেন। সেখানে আবার বিয়ে করেন। বর্তমানে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে তিনি গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। মাঝেমধ্যে অল্প কিছুদিনের জন্য যুক্তরাজ্যে গেলেও অধিকাংশ সময় দেশে থাকেন।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাংলাদেশী অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রীন এলাকা থেকে দুই বান্ধবী খাদিজা সুলতানা ও আমিরা আবাসি-সহ আইএসে যোগ দিতে সিরিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন শামীমা বেগম। তারা তাদের বাবা-মাকে বলেছিলেন, তারা একসাথে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন। তুরস্কে নামার পর তারা সীমান্ত পেরিয়ে সিরিয়ায় ঢোকেন। তখন সিরিয়া ও ইরাকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে রয়েছে আইএস।
ইসলামিকে স্টেটের স্বঘোষিত ‘খেলাফতের’ রাজধানী রাক্কায় এসে তারা প্রথম একটি বাড়িতে ওঠেন। সেখানে তাদের সাথে ছিল আরো কয়েকজন মেয়ে— যারা আইএস যোদ্ধদের বধূ হবার জন্য দেশ ছেড়ে এসেছিল।
শামীমা বলেন, “আমি একটা আবেদনপত্র দেই যে আমি ইংরেজিভাষী একজন যোদ্ধাকে বিয়ে করতে চাই—যার বয়েস ২০ থেকে ২৫ বছর বয়েসের মধ্যে।”
দশ দিন পর তার সাথে ২৭ বছর বয়স্ক একজন ডাচ লোকের বিয়ে হয়– যে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তাদের তিনটি সন্তান হয়— কিন্তু তাদের সবারই অল্প বয়সে মৃত্যু হয়।
২০১৯ সালের প্রথম দিকে লন্ডনের দৈনিক দি টাইমসের একজন সাংবাদিক সিরিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে শামীমা বেগমের খোঁজ পান। ঐ সাংবাদিকের মাধ্যমে শামীমা বেগম ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন যে তাকে যেন ব্রিটেনে ফেরত আসতে দেওয়া হয়। সে অনুমতি না দিয়ে সরকার তার নাগরিকত্ব বাতিল করে।
শামীমা ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যে ফিরতে চান। তবে দেশটির সরকার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে তার নাগরিকত্ব বাতিল করে। এরপর বিষয়টি আদালতে গড়ায়। পরে গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি শামীমার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করার সিদ্ধান্তকে বৈধ বলে রায় দিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের একটি আদালত। রায়ে আদালত বলেছিলেন, নাগরিকত্ব বাতিলের ফলে শামীমা বেগম রাষ্ট্রহীন হয়ে যাননি। বংশগতভাবে তিনি ‘বাংলাদেশের নাগরিক’। তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দাবি করতে পারেন।
বাংলাদেশ সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল, শামীমা বাংলাদেশের নাগরিক নন। তাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়ার কোনো কারণ নেই।
বিবিসি জানায়, শামীমা বেগমকে সাক্ষাত্কারে জিজ্ঞাসা করা হয় যে তিনি বংশগতভাবে বাংলাদেশের নাগরিক, কাজেই তিনি কেন বাংলাদেশে যাচ্ছেন না?
জবাবে শামীমা বেগম বলেন, তিনি জীবনে কখনো বাংলাদেশে আসেননি, বাংলাদেশি নাগরিকত্বের কোনো অধিকার তার নেই। আর বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, তাকে সেখানে যেতে দেওয়া হবে না এবং গেলে তাকে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে হবে।
তিনি প্রশ্ন করেন, ব্রিটেনের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশ, যারা মৃত্যুদণ্ডে বিশ্বাস করে না, তারা কিভাবে আশা করে যে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হওয়ার জন্য তিনি বাংলাদেশে যাবেন?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫৩
আপনার মতামত জানানঃ