মাত্র ১৫ বছর বয়সে সিরিয়ায় পালিয়ে ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এ যোগ দেওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ মেয়ে সাবেক আইএস বধূ শামীমা বেগম আবারও আলোচনায়। বুধবার সিরিয়ার এক শরণার্থী শিবির থেকে ব্রিটেনের আইটিভির ‘গুড মর্নিং ব্র্রিটেন’ অনুষ্ঠানে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের পর তাকে নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। সাক্ষাৎকারে শামীমা বেগম ব্রিটিশ জনগণ ও সরকারের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাকে ব্রিটেনে ফেরার সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। ব্রিটেনে ফিরে তিনি সন্ত্রাসবাদ দমনে ব্রিটিশ সরকারকে সহায়তা করতে চান। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শামীমা বেগম বলেন, ‘আমি বলতে চাই আপনি সন্ত্রাসবাদ দমনে নিশ্চয়ই হিমসিম খাচ্ছেন, আমি এ নিয়ে আপনাকে সাহায্য করতে চাই। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে আপনাকে বলতে পারবো এই জঙ্গিরা কীভাবে সিরিয়ার মতো জায়গায় লোকজনকে তাদের কথামত কাজ করতে বাধ্য করে। আমি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আপনার লড়াইয়ে সাহায্য করতে পারব’।
তিনি আরও বলেন, ‘ব্রিটিশ সরকারের উচিৎ আমাকে হুমকি হিসেবে গণ্য না করে বরং সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা’।
গত বুধবার সিরিয়ার এক শরণার্থী শিবির থেকে বিবিসি, বিবিসি ফাইভ লাইভ এবং আইটিভিকে পৃথক সাক্ষাৎকার দেন শামীমা বেগম।
২২ বছর বয়সী শামীমা বেগম আইটিভির গুড মর্নিং ব্রিটেন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন একেবারে পশ্চিমা ধাঁচের খোলামেলা পোশাক পরে, যে ধরণের পোশাকে তাকে আগে কখনো দেয়া যায়নি। তার পরনে ছিল ধূসর রঙের স্লিভলেস ভি কাট ভেস্ট, মাথায় বেজ বল হ্যাট এবং আঙুলের নখে গোলাপি নেইল পলিশ।
পশ্চিমা পোশাক পরিহিত শামীমা লাইভে উপস্থিত হয়ে ব্রিটেনকে তাকে দেশটিতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার আকুতি জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে বলেন, তার কোনো ধারণা ছিল না আইএসআইএস কী ধরণের গোষ্ঠী।
তিনি নিজেই এই উগ্র সশস্ত্র গোষ্ঠীর ভিক্টিম দাবি করে তিনি বলেন, পুনরায় তাদের সাথে যোগদানের চেয়ে তিনি মৃত্যুকেই বেছে নেবেন। ম্যানচেস্টারের আত্মঘাতী বোমা হামলাকে যুক্তিযুক্ত বলার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন তিনি।
‘আমি বলতে চাই আপনি সন্ত্রাসবাদ দমনে নিশ্চয়ই হিমসিম খাচ্ছেন, আমি এ নিয়ে আপনাকে সাহায্য করতে চাই। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে আপনাকে বলতে পারবো এই জঙ্গিরা কীভাবে সিরিয়ার মতো জায়গায় লোকজনকে তাদের কথামত কাজ করতে বাধ্য করে। আমি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আপনার লড়াইয়ে সাহায্য করতে পারব’।
২০১৫ সালে ১৫ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে তার আরও দুই বন্ধুর সঙ্গে সিরিয়ায় যান তিনি। তার নাগরিকত্ব বাতিল করেছে ব্রিটিশ সরকার।
আইটিভি’কে এক লাইভ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি জানি ব্রিটিশদের জন্য আমাকে ক্ষমা করার চেষ্টা করা ও ক্ষমা করা অনেক কঠিন। তারা অনেকেই আইএসআইএসের হাতে প্রিয়জন হারিয়েছেন। কিন্তু, আমি নিজেও তাদের ভয়ে দিন কাটিয়েছি, প্রিয়জন হারিয়েছি। একারণে আমি তাদের দিকটা বুঝতে পারছি’।
তিনি দাবি করেন, তিনি শুধু বিয়ে করে মা হওয়া এবং ইসলামিক জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে সিরিয়ায় যান।
‘আমি জানতাম না তারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ছিল। আমি শুধুই একটি ইসলামিক দল ভেবেছিলাম’।
শামীমা বেগম বিবিসিকে জানান, আইএসে যোগ দেওয়ার কথা মনে পড়লে তিনি অসুস্থ বোধ করেন। নিজের প্রতি ঘৃণাবোধ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাকি জীবন এ জন্য দুঃখবোধ করবো। আপনি আমার মুখে তার ছাপ দেখতে পান বা না পান— এটা আমাকে ভেতর থেকে মেরে ফেলছে। এ জন্য আমি ঘুমাতে পারি না। আইএস মানুষের জীবন নষ্ট করেছে, আমার ও আমার পরিবারের জীবন নষ্ট করেছে।’
শামীমা বলেন, আইএস প্রসঙ্গে বহু দিন আগেই তার ধারণা পরিবর্তন হয়েছিল। তবে এখন তিনি তা প্রকাশ করতে পারার মত মানসিক অবস্থায় পৌঁছেছেন।
অভিযোগ আছে, শামীমা ক্যাম্পে অসুস্থ জিহাদীদের সেবা-শুশ্রুষা করেছেন। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে শামীমা জানিয়েছেন, তিনি সেখানে একজনের স্ত্রী হিসেবে থাকা ও মা হওয়া ছাড়া আর কিছুই করেননি।
এসব অভিযোগ ভুল প্রমাণিত করতে তিনি আদালতে লড়তে প্রস্তুত বলেও জানান।
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কোনো প্রমাণ নেই কারণ আমি এমন কিছু করিইনি। আমি আইএসের কাছে ফিরে যাওয়ার চেয়ে বরং মারা যাবো’।
তিনি বলেন, ‘আমি এখন অন্য ক্যাম্পে থাকছি। আমার সন্তানরা বেঁচে না থাকায় শুধু নিজের নিরাপত্তা নিয়েই চিন্তিত আমি। হিজাব ছেড়ে দেওয়ার জন্য আক্রমণের শিকার হলে তার দায়িত্বও আমার। আমি প্রতিনিয়ত নিজেকে পরিবর্তনের কাজ করছি’।
‘তাদের কোনো কাজের প্রতিই আমার সমর্থন নেই। ধর্মের নামে নিরীহ মানুষ হত্যা যুক্তিযুক্ত নয়’।
সিরিয়ায় যাওয়ার সময় তিনি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন, আইএসের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কিছু জানতেন না, এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে তাকে যুক্তরাজ্যে ফিরতে দেওয়ার অনুরোধ করেন।
শামীমা বেগম পূর্ব লন্ডনের সেই তিন কিশোরীর একজন, যারা ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়ায় পাড়ি জমান ইসলামিক স্টেটে যোগ দেয়ার জন্য। তার জন্ম লন্ডনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বাবা-মার ঘরে। যখন তিনি লন্ডন ছেড়ে যান তখন তার বয়স ছিল ১৫ বছর।
তিনি তুরস্ক হয়ে সিরিয়ার রাকায় পৌঁছান এবং সেখানে ইসলামিক স্টেটে যোগ দেয়া নেদারল্যান্ডসের এক যোদ্ধাকে বিয়ে করেন। এই ব্যক্তিই তার তিন সন্তানের পিতা। ২০১৯ সালে তাকে সিরিয়ার এক শরণার্থী শিবিরে নয় মাসের গর্ভবতী অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে জন্ম নেওয়া তার সন্তান পরে নিউমোনিয়ায় মারা যায়। এর আগেও তিনি তার আরও দুটি সন্তান হারিয়েছেন।
শামীমা বেগমকে খুঁজে পাওয়ার পর তৎকালীন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (এখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী) সাজিদ জাভিদ তার নাগরিকত্ব বাতিল করেন।
নিজ নাগরিককে ‘নাগরিকত্বহীন’ করে ব্রিটিশ সরকার তখন যুক্তি দেখিয়েছিল যে শামীমা বেগমের বাবা বাংলাদেশি। তাই শামীমা বাংলাদেশে ফিরতে পারেন। বাংলাদেশ সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল, শামীমা বাংলাদেশের নাগরিক নন। তাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়ার কোনো কারণ নেই।
বিবিসি জানায়, শামীমা বেগমকে সাক্ষাত্কারে জিজ্ঞাসা করা হয় যে তিনি বংশগতভাবে বাংলাদেশের নাগরিক, কাজেই তিনি কেন বাংলাদেশে যাচ্ছেন না?
জবাবে শামীমা বেগম বলেন, তিনি জীবনে কখনো বাংলাদেশে আসেননি, বাংলাদেশি নাগরিকত্বের কোনো অধিকার তার নেই। আর বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, তাকে সেখানে যেতে দেওয়া হবে না এবং গেলে তাকে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে হবে।
তিনি প্রশ্ন করেন, ব্রিটেনের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশ, যারা মৃত্যুদণ্ডে বিশ্বাস করে না, তারা কিভাবে আশা করে যে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হওয়ার জন্য তিনি বাংলাদেশে যাবেন?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৬
আপনার মতামত জানানঃ