ইউরোপের দেশগুলোয় করোনাভাইরাসে নতুন আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। জার্মানি, গ্রিস, ক্রোয়েশিয়া, অস্ট্রিয়াসহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশে করোনার সংক্রমণ বেড়ে এযাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ হারে পৌঁছেছে। ইউরোপে করোনা ভাইরাসের বাড়বাড়ন্ত চিকিৎসক ও বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে এতটাই উদ্বেগ বাড়িয়েছে যে, ক্রিসমাস ও নিউ ইয়ার্সের উৎসবের আগেই করোনা নিয়ন্ত্রণে লকডাউন কার্যকর হতে চলেছে।
সংক্রমণ হার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় পূর্ণ লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে অস্ট্রিয়া। এর সাথে টিকা নেওয়াকে বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেছে মধ্য ইউরোপের দেশটি।
দেশজুড়ে লকডাউন কার্যকর হবে আগামী সোমবার থেকে। গত ২৪ ঘণ্টায় এই দেশে ১৫,৬০৯টি নতুন সংক্রমণ দেখা দিয়েছে, যা মহামারি শুরুর পর থেকে সর্বোচ্চ।
শুক্রবার দেওয়া এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে অস্ট্রিয়ান চ্যান্সেলর আলেকজান্ডার শ্যালেনবার্গ জানান, এই লকডাউন সর্বোচ্চ ২০ দিন স্থায়ী হবে। এছাড়া ১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে টিকা নেওয়া দেশের সব নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক করা হবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি।
অস্ট্রিয়ান চ্যান্সেলর আলেকজান্ডার শ্যালেনবার্গ বলেছেন, ‘মানুষকে টিকাকরণের জন্য আমরা যথেষ্টভাবে রাজি করাতে পারছি না। কিন্তু এখন এটা নিয়ে কড়া বন্দোবস্ত করতে হবে। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা পারস্পরিক সহযোগিতা দেখাননি। এই দুষ্ট চক্র ভাঙ্গার একমাত্র উপায় টিকাদানের হার বাড়ানো।’
অস্ট্রিয়ার বর্তমান এই কোভিড সংকটের জন্য টিকা-বিরোধীদের দায়ী করেন চ্যান্সেলর। তিনি বলেন, “টিকা-বিরোধীদের অপপ্রচারের জন্যই আমাদের মধ্যে অনেকে টিকা নিচ্ছে না। যে কারণে হাসপাতালগুলো এখন সব ভরে গেছে, এবং মানুষকে ভুগতে হচ্ছে।”
অস্ট্রিয়ার ৬৬ শতাংশ জনসংখ্যা সম্পূর্ণরূপে টিকাপ্রাপ্ত, যা ইউরোপের সর্বনিম্ন হারগুলোর মধ্যে একটি। এদিকে জনসংখ্যার অনুপাতে অস্ট্রিয়ায় সংক্রমণের হার এ মুহূর্তে ইউরোপে সর্বোচ্চ।
যে কারণে ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে সবার জন্যই টিকা বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া।
এদিকে, গ্রিস ও স্লোভাকিয়ায় গত সোমবার থেকে টিকা না নেওয়া ব্যক্তিদের উপর লকডাউন জারি করা হয়েছে। জার্মানি ও চেক প্রজাতন্ত্রও একই পথে হাঁটার কথা ভাবছে।
বেলজিয়াম ও আয়ারল্যান্ড দেশের জনগণকে বাসায় থেকে অফিস করার নির্দেশনা দিয়েছে ।
ঠান্ডা আবহাওয়া ভাইরাসের বিস্তারকে প্রভাবিত করেছে বলে ইউরোপের বিভিন্ন অংশে করোনার সংক্রমণ আবার বাড়ছে। জার্মানের ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল নাগরিকদের টিকা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে দেশের সর্বোচ্চ করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
মার্কেল বলেন, ‘পরিস্থিতি এখন চূড়ান্ত নাটকীয়তায় চলে গিয়েছে।’ জার্মানের স্বাস্থ্য মন্ত্রী জেনস স্পান জানিয়েছেন যে জার্মানি হয়তো করোনা রোগীদের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে বা এমনকী প্রতিবেশী দেশেও চিকিৎসার জন্য পাঠাতে পারে। স্পান বলেন, ‘আমরা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে আমাদের করোনা রোগীদের শুধু একই অঞ্চলে নয়, জার্মানির অন্যান্য অঞ্চলে স্থানান্তর করতে হবে।’
শুক্রবারও জার্মানিতে দৈনিক করোনা সংক্রমণ রেকর্ড হয়েছে ৫২,৯৭০টি। জার্মানের বাভারিয়া, করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে তাদের জনপ্রিয় বড়দিনের বাজার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইউরোপে করোনা ভাইরাসের বাড়বাড়ন্ত চিকিৎসক ও বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে এতটাই উদ্বেগ বাড়িয়েছে যে, ক্রিসমাস ও নিউ ইয়ার্সের উৎসবের আগেই করোনা নিয়ন্ত্রণে লকডাউন কার্যকর হতে চলেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্তের তালিকায় পাঁচটি দেশের একটি হল রাশিয়া। টিকা প্রয়োগের পর কয়েক মাস আক্রান্ত ও মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণে থাকলেও গত সপ্তাহ থেকেই তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে কর্মক্ষেত্র, রেস্তোরাঁ কিংবা শপিংমলে গেলে টিকা সনদ সঙ্গে রাখার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
শুক্রবারও এই দেশে সর্বোচ্চ ১,২৫৪টি দৈনিক নতুন মৃত্যু সহ ৩৭,১৫৬টি নতুন করোনা কেস সনাক্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার এই দেশে ১,২৫১ জন ও বুধবার ১,২৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনায়। দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, রাশিয়ার মাত্র ৪০ শতাংশ মানুষ করোনার দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন।
গ্রীস বৃহস্পতিবার করোনভাইরাস-সম্পর্কিত নতুন বিধিনিষেধ ঘোষণা করেছে। যাদের এখনও টিকা দেওয়া হয়নি তাদের টিকা দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত চাপ দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিৎসোটাকিস বলেছেন যে, তিনি বিশ্বাস করেন করোনার পদক্ষেপগুলো ‘যারা এখনও দ্বিধাগ্রস্ত’ তাদের মন পরিবর্তন করতে এবং টিকা নিতে সাহায্য করবে।
এদিকে স্পেনে চালু করা হয়েছে ভ্রাম্যমাণ টিকাকেন্দ্র। প্রশাসন বলছে, পর্যটন মৌসুম শুরু হওয়ার পর করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত এক সপ্তাহে সংক্রমণের হার ৫২ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ।
গত সপ্তাহে পুরো বিশ্বের মোট সংক্রমণের অর্ধেকের বেশি ঘটেছে ইউরোপে। জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, অস্ট্রিয়া, রোমানিয়ায় নতুন করে সংক্রমণ ঢেউ আছড়ে পড়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট। ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, ইউরোপে করোনায় মৃত্যু গত সপ্তাহে ১০ শতাংশ বেড়ে গেছে। সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি ঘটছে নেদারল্যান্ডসে। অথচ এ দেশে ৮৫ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে।
করোনার প্রকোপ আবার বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপে নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের যে চেষ্টা চলছে, তা আবার বাধাগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, চেক প্রজাতন্ত্র ও ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশে নানা বিধিনিষেধ চালু হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপের আঞ্চলিক প্রধান হানস ক্লুগ বলেন, “ইউরোপের ৫৩টি দেশে সংক্রমণের চলতি অবস্থা ভয়াবহ উদ্বেগজনক। অধিক সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে এ সংক্রমণ আরও বেড়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
শীতের সময় যখন বাসা-বাড়িতে মানুষের জমায়েত বেড়ে যায়, ভাইরাসটি আরও অধিক হারে সংক্রমিত হয়।সংক্রমণ ঠেকাতে ইউরোপ যদি বর্তমান পন্থাই অনুসরণ করে, তাহলে সামনের বছরের ফেব্রুয়ারি নাগাদ এ অঞ্চলে আরও পাঁচ লাখ কোভিডজনিত মৃত্যু হতে পারে বলে সতর্ক করেন ক্লুগ।
ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এক সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছে, ‘মহামারির সামগ্রিক পরিস্থিতি… উচ্চ ও দ্রুত ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ হার এবং ধীর ও ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর হার চিহ্নিত হয়েছে। সংক্রমণ হার, মৃত্যুর হার এবং হাসপাতাল ও আইসিইউ ভর্তি সবই আগামী দুই সপ্তাহে বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।’
সাপ্তাহিক ঝুঁকি পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, সবচেয়ে উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, ইস্তোনিয়া, গ্রিস, হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড ও স্লোভেনিয়া। আগামী কয়েক সপ্তাহে এসব দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ বাড়তে পারে।
ফাইজার–বায়োএনটেকের করোনার টিকার অন্যতম আবিষ্কারক উগুর সাহিন ফ্রাঙ্কফুর্ট রন্ডসুউ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, টিকা দেওয়ার পর সপ্তম, অষ্টম বা নবম মাসে অ্যান্টিবডির মাত্রা কমতে শুরু করে এবং এতে করে করোনার সংক্রমণ ঘটতে পারে। তবে টিকার বুস্টার ডোজ ভাইরাস প্রতিরোধক্ষমতা পুনরুদ্ধার করে, যা করোনার ডেলটা ধরনের ক্ষেত্রেও কাজ করে। বুস্টার টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রোগের ভয়াবহতা সাধারণত মাঝারি হয় এবং খুব কম ক্ষেত্রেই গুরুতর অসুস্থতা লক্ষ করা যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৭
আপনার মতামত জানানঃ