বিশ্ববাজারের রেকর্ড কম দামের বিপরীতে তেলের দাম নাম মাত্র কমিয়ে গত সাত বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। সাত বছর ধরে গড়ে ২৩ শতাংশের বেশি লাভের বিপরীতে কমানো হয়েছিল মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ। অথচ তারাই পাঁচ মাসের লোকসান দেখিয়ে ডিজেল-কেরোসিনের দাম এক লাফে ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে দিল। যে আন্তর্জাতিক বাজারের কাঁধে পা রেখে এই সিদ্ধান্ত নিল সরকার, সেই বাজারেই আবার কমে গেছে জ্বালানি তেলের দাম।
ব্যারেল প্রতি জ্বালানি তেলের দর এখন ৮০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। গত ছয় সপ্তাহের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দর গতকাল ছিল সবচেয়ে কম। তাহলে বাংলাদেশে এখন কী হবে? এখানেও কি তাহলে ডিজেল-কেরোসিনের দাম কমবে? বাস ভাড়া কমবে? নাকি মগেল মুল্লুকের এই দেশে সাধারণ মানুষকে চিরস্থায়ী অর্থনৈতিক শোষণের আরও একটি নজির হয়ে থাকবে এই মূল্য বৃদ্ধি।
কেন দাম কমল?
গত ৭ অক্টোবর ব্যারেল প্রতি জ্বালানি তেলের দর ছিল ৭৯ দশমিক ২৮ ডলার। গতকাল একপর্যায়ে দর এর নিচে নেমে গিয়েছিল। তারপরে অবশ্য সামান্য একটু বেড়ে হয়েছে ৮০ ডলার ৫১ সেন্ট।
হঠাৎ করে কমার কারণ নিয়ে রয়টার্স জানাচ্ছে, এটি সম্ভব হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ চীন রেখেছে বলেই। বাইডেন প্রশাসন তার মিত্রদের কাছে অনুরোধ করেছিল যাতে দেশগুলো তাদের সংরক্ষিত (রিজার্ভ) তেল বাজারে ছেড়ে দেয়। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে চীন এ কাজটিই করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন অনেক দিন ধরেই বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত। কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ ও ট্রাম্পের পরাজয় সেই বাণিজ্যযুদ্ধ কিছুটা কমিয়ে রাখলেও একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু চীন যে যুক্তরাষ্ট্রের এই অনুরোধ রাখবে তা অনেকেই আশা করেননি। তবে চীনের এই সিদ্ধান্ত বাজারকে প্রভাবিত করেছে, কমেছে তেলের দর।
তেলের দাম গত অক্টোবর থেকে বাড়তে শুরু করেছিল মূলত তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের এক সিদ্ধান্তে। তারা আগের লোকসান তুলে আনতে জ্বালানি তেলের উত্তোলন কমিয়ে দেয়। যেহেতু বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে, ফলে বাড়ছিল তেলে চাহিদা।
আবার কোভিড সংক্রমণের সময় সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এমনিতেই বিভিন্ন ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চিন্তিত মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ে। এ রকম একসময় চাহিদা বৃদ্ধি ও জোগান কমে যাওয়ায় জ্বালানি তেলের দর ব্যারেলপ্রতি ৮৫ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ২০১৪ সালের পরে এটাই ছিল সর্বোচ্চ দর।
প্রতিটি দেশই আপাতকালীন সময়ের জন্য জ্বালানি তেলের একটি অংশ সংরক্ষিত অবস্থায় রাখে। মূলত এটি শুরু হয়েছিল ১৯৭০ সালে, যখন আরব দেশগুলো তেল বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এরপর এই ধরনের আরেকবার নিয়েছিল ২০১১ সালে, যখন ওপেক সদস্য লিবিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্র যে কেবল চীনকেই সংরক্ষিত রাখা তেলের ব্যবহার বাড়াতে বলেছে তাই নয়, একই অনুরোধ করা হয়েছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতের মতো বৃহৎ তেল ব্যবহারকারী দেশগুলোকে। এর মধ্যে শুরুতেই চীন অনুরোধ রক্ষা করায় তা ওপেককে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। কেননা, বিশ্বের শীর্ষ তেল ব্যবহারকারী দেশ চীন। যদিও এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ওপেক এ নিয়ে কিছু বলেনি। তবে তারা যে বিস্মিত তা জানিয়েছে রয়টার্স।
অর্থনৈতিক শোষণ এবং বাংলাদেশ
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়চহে মূলত অক্টোবর থেকে। এর আগের সাত বছর তেলের দাম ছিল অনেক কম। তখন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) কম দামে তেল কিনে দেশের ভোক্তাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই সাত বছরে সরকার মাত্র একবার দাম কমায়, তাও অতি সামান্য, মাত্র ৩ টাকা প্রতি লিটারে।
কিন্তু দাম বাড়তে শুরু করার এক মাসের মধ্যেই বিপিসির দেওয়া প্রস্তাব মেনে ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম বাড়িয়ে দেয় লিটারে ১৫ টাকা। অর্থাৎ এক লাফে বাড়ে ২৩ শতাংশ। এর প্রতিক্রিয়ায় পরিবহন খাতের ভাড়া সরকার বাড়িয়ে দিয়েছে ২৭ শতাংশ।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি মানেই জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া। বিশেষ করে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের সময়ে তেলের দাম বাড়ানোর সমর্থন নেই কারোরই। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা না করে ভেবেছে কেবল বিপিসির কথা, পরিবহন খাতের প্রভাবশালী মালিকদের কথা।
দেশে মোট জ্বালানির মধ্যে ডিজেলই ব্যবহার হয় ৭৩ শতাংশ। সেই ডিজেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে পণ্য উৎপাদন, পরিবহণ এবং গণপরিবহণ ব্যয় বাড়বে। একই কারণে আমদানি করা জিনিসপত্রের দামও বাড়বে। এছাড়া কৃষিতে সেচ, সার, বেসরকারি খাতে উৎপাদিত বিদ্যুতের খরচও বৃদ্ধি পাবে। কমবে টাকার মান, বাড়বে মূল্যস্ফীতির হার। যার প্রভাবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত চাপের মুখে পড়বে। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
কৃষিতে পানি সেচ দিতে ডিজেল ব্যবহার করা হয়। তাই ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধিতে এবার কৃষিপণ্য উৎপাদনে খরচ বাড়বে। স্বাভাবিকভাবে পণ্য বিক্রি করতে হবে বেশি দরে। পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল যন্ত্রাংশ চালনায় বাড়তি দরে ডিজেল ব্যবহারে প্রসেসিং ফুড তৈরিতে খরচ বৃদ্ধি পাবে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে যেহেতু সারা বিশ্বই চিন্তিত, সেহেতু সবাই একটি পথ খুঁজছিল। তারই অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ। কিন্তু তর সয়নি সরকারের। ফলে এক লাফে ১৫ টাকা দর বৃদ্ধি। কিন্তু এখন তো দাম কমল? প্রশ্ন হচ্ছে, দাম কতটা কমলে সরকারও সিদ্ধান্ত নেবে নাকি লাভই করতে থাকবে?
এখানে প্রশ্ন উঠছে, একলাফে ১৫ টাকার মূল্যবৃদ্ধি কি পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর জন্য পাতানো খেলা? এই প্রশ্ন এ জন্য যে সরকারি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। ধর্মঘটে চলে যায় সব ধরনের পরিবহন মালিকেরা। তবে পরিবহন খাতের বড় নেতা, সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান অবশ্য সাফাই গেয়ে বলেন, এটা ধর্মঘট নয়, লোকসান হবে বলে পরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছে।
এবার জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের না বোঝার কথা না যে একলাফে ১৫ টাকা বাড়ালে পরিবহন খাতে কী প্রতিক্রিয়া হবে। বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান বা লঞ্চমালিকেরা এই সুযোগ নিতে এক বিন্দু সময় নেননি। তা ছাড়া পরিবহন মালিকেরা অনেক দিন ধরেই ভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা করছিলেন। সুতরাং, সরকারও সময়মতো সুযোগটা করে দিল। জনগণ চুলোয় যাক। পরিবহন মালিকেরা সফল। ভাড়া বেড়ছে সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ। সরকার খুশি। আর সরকার খুশি তো সব খুশি।
সরকারের শুভঙ্করের ফাঁকি
আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্য বাড়াকে কেন্দ্র করে দেশে তেলের দাম যখন মানুষের ভোগান্তিতে নতুন এক উপদ্রব হিসেবে আবির্ভূত হল, তখন গত ৫ মাসে বিপিসির কত লোকসান হয়েছে তা প্রতিষ্ঠানটি বেশ ঘটা করেই জানায়।
বিপিসি জানায়, প্রতি লিটার ডিজেলে জুন মাসে ২.৯৭ টাকা, জুলাইয়ে ৩.৭০ টাকা, আগস্টে ১.৫৮ টাকা, সেপ্টেম্বরে ৫.৬২ টাকা এবং অক্টোবরে মাসে ১৩.০১ টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এ কারণে জুন থেকে অক্টোবর ৫ মাসে বিপিসির লোকসান হয়েছে ১১৪৭.৫০ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বাড়া-কমা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে এ বছরের অক্টোবর মাসে এক ব্যারেল তেলের দাম ছিল ৮৩.৫৪ ডলার। ধারণা করা হচ্ছে সামনে তেলের মূল্য আরও বাড়বে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় দৃষ্টিকটুভাবে কিছু তথ্য প্রকাশ করা হয়নি বা গোপন করা হয়েছে। জ্বালানি মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছে, ২০১৬ সালে ডিজেলের দাম লিটারে ৩ টাকা কমিয়ে ৬৫ টাকা করা হয়। গর্ব করে আরও জানিয়েছে, পরের ৫ বছর অর্থাৎ ২০২০ সাল পর্যন্ত আর মূল্য বাড়ানো হয়নি।
কিন্তু প্রশ্ন এই ৫ বছর দাম বাড়াননি কেন! এই প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে শুভঙ্করের ফাঁকি। বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত নীতি দাম বাড়ানো বা কমানো নয়, সমন্বয় করা। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশে দাম বাড়ানো হবে, কমলে দেশেও কমানো হবে।
২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে এক ব্যারেল তেলের গড় মূল্য ছিল ৪৩.২৯ ডলার। সে বছর তেলের সর্বনিম্ন মূল্য ২৬.১৯ ডলারও হয়েছিল। ২০১৭ সালে গড় মূল্য ছিল ৫০.৮০ ডলার, ২০১৮ সালে ছিল ৬৫.২৩ ডলার, ২০১৯ সালে ছিল ৫৫.৯৯ ডলার এবং ২০২০ সালে ছিল ৩৯.৬৮ ডলার। ২০২০ সালে একপর্যায়ে এক ব্যারেল তেলের দাম কমে সর্বনিম্ন ১১ ডলার হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশে দাম সমন্বয়ের নীতি অনুসরণ করলে, দেশে তেলের দাম আরও অনেক কমার কথা ছিল। ঘোষিত নীতি অনুযায়ী দাম না কমিয়ে, এখন বলা হচ্ছে বাড়ানো হয়নি!
২০২১ সালের অক্টোবর মাসে এক ব্যারেল তেলের দাম ৮৩.৫৪ ডলার হওয়ায় বিপিসির লোকসান যদি প্রতি লিটারে ১৩.০১ টাকা হয়, তবে ২০২০ সালে এক ব্যারেল তেলের দাম যখন ৩৯.৬৮ ডলার ও সর্বনিম্ন ১১ ডলার হয়েছিল, বিপিসি তখন প্রতি লিটারে কত টাকা লাভ করেছিল? সেই হিসাব জ্বালানি মন্ত্রণালয় প্রকাশ করেনি।
এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে অকটেনের দাম বাড়েনি, কিন্তু দেশে বিক্রি হচ্ছে ৮৯ টাকা লিটার। এই তেলের আমদানি মূল্য হয়তো ৪০-৪৫ টাকা। এর সঙ্গে নির্ধারিত ভ্যাট, ডিউটি, ট্যাক্স ও সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি প্রায় ৩০ টাকা। সরকার চাইলে ৭০-৭৫ টাকায় বিক্রি করতে পারে। কিন্তু এখানে সরকার উল্টো আরও লাভ করছে।
সরকার জ্বালানি তেলে ভর্তুকি বা লোকসানের কথা বললেও, এখনও প্রতি লিটার অকটেনে লাভ করছে ১৫-২০ টাকা। ২০১৪ সাল থেকে গত ৭ বছরে বিপিসি তেল বিক্রি করে মোট লাভ করেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর বাইরে প্রতি লিটার অপরিশোধিত তেলে ২৮ শতাংশ ট্যাক্স-ভ্যাট পায় সরকার। ২৮ শতাংশ ট্যাক্স-ভ্যাট মানে লিটার প্রতি ১৯ টাকা পায় সরকার। এরপরও তাদের লোকসান হচ্ছে। এখানে আর একটি প্রশ্ন দাঁড়ায়, এই যে হিসাবের মধ্যে শুভঙ্কর বসে আছে, এই গরমিল, এই মানুষ ঠকানো হিসাব, এই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কারণ কী? এতো বিশাল অঙ্কের টাকা কোথায় যাচ্ছে?
এসডব্লিউ/এসএস/১২২৫
আপনার মতামত জানানঃ