রাশিয়া ঘোষণা না দিয়ে নীরবে ভূপৃষ্ঠ থেকে মহাকাশে শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। গত সোমবার পরপর চারটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। সেই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর আঘাতে কয়েক মিনিটের মধ্যে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা একটি কৃত্রিম উপগ্রহ। ভেঙে পড়া প্রায় ৪০ বছর বয়সী উপগ্রহ থেকে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে ছিটকে বেরনো বড় ও মাঝারি রাশি রাশি টুকরো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে মহাকাশে। রাশি রাশি টুকরো কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে দেয় ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি গতিবেগে।
ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। একটু হলেই পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে আঘাত লাগত।
হিউস্টনে নাসার মিশন কন্ট্রোল রুম থেকে খবর পেয়ে মহাকাশচারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। প্রাণ বাঁচাতে মহাকাশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে সাতজন মহাকাশচারীই চেপে বসেন পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য অপেক্ষারত মহাকাশযানে। সেখানেই আশ্রয় নিতে বাধ্য হন মহাকাশচারীরা। যাদের মধ্যে রয়েছেন আমেরিকা, জাপান ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (এসা)-র মহাকাশচারীরা।
এক সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেন, ‘রাশিয়া বেপরোয়াভাবে ধ্বংসাত্মক স্যাটেলাইট পরীক্ষা চালিয়েছে। স্যাটেলাইটবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে নিজেদেরই একটি স্যাটেলাইট ধ্বংস করে দিয়েছে দেশটি।
‘এই পরীক্ষার ফলে বিধ্বস্ত স্যাটেলাইটটির কমপক্ষে দেড় হাজার বড় বড় টুকরো কক্ষপথে ঘুরছে, যেগুলো আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি। আর কয়েক লাখ ছোট ছোট যেসব খণ্ড কক্ষপথে যুক্ত হয়েছে ধ্বংসস্তুপের কারণে, সেগুলোর তো কোনো হিসাবই নেই।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার এই বেপরোয়া পরীক্ষার ফলে মহাকাশে দুই টন জঞ্জাল তৈরি হয়েছে। এগুলো ৫০০ কিলোমিটার উচ্চতায় প্রদক্ষিণ করছে। এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০টির বেশি গতিবিধি অনুসরণযোগ্য ধ্বংসাবশেষ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক হাজার ধ্বংসাবশেষ তৈরি হয়েছে। এই ধ্বংসাবশেষগুলো সবার জন্যই হুমকিস্বরূপ।
ইকোনমিস্ট তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, আমেরিকা যে সত্য বলছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উপগ্রহ এবং মহাকাশের ধ্বংসাবশেষ নজরদারি করতে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির স্টার্টআপ লিওল্যাবস। তারা রাশিয়ার কৃত্রিম উপগ্রহ ধ্বংস হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে, উপগ্রহ ধ্বংসকারী ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার আগে তাদের জানায়নি মস্কো। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এক বিবৃতিতে বলেছেন, বিপদ শেষ হয়নি এবং এসব ধ্বংসাবশেষ মহাকাশে কর্মকাণ্ডের জন্য হুমকি হিসেবে থাকবে।
তবে রাশিয়া ১৫ নভেম্বর ভোরে সতর্ক করে বলেছিল, মস্কো থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরে প্লেসেটস্ক থেকে তারা একটি রকেট উৎক্ষেপণ করবে। এর আগে ওই স্থান থেকে কৃত্রিম উপগ্রহ–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র নুডলের পরীক্ষা চালিয়েছিল দেশটি।
রাশিয়ার এই তৎপরতার নিন্দা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পৃথিবী নিম্ন কক্ষপথে মহাকাশের এসব জঞ্জাল কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে। উপগ্রহ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে মহাকাশচারীদের হুমকির মধ্যে ফেলার জন্য মস্কোকে অভিযুক্ত করেছে ওয়াশিংটন। এ ঘটনায় নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যও নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস এ বিষয়ে বলেন, রাশিয়া যে পরীক্ষা চালিয়েছে, তা বিপজ্জনক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। নেড প্রাইস বলেন, রাশিয়ার এ আচরণ মহাকাশের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে তুলেছে। এর জবাব দিতে যুক্তরাষ্ট্র তার অংশীদার ও মিত্রদের সঙ্গে কাজ করবে।
গত সপ্তাহ থেকে রাশিয়া যেভাবে ইউক্রেন সীমান্তে সেনা জড়ো করছে, তার সঙ্গে এ পরীক্ষার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ার এ পদক্ষেপ মহাকাশে ক্রমবর্ধমান অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিষয়ে উদ্বেগ পুনরুজ্জীবিত করবে। লেজার অস্ত্র থেকে শুরু করে অন্যদের কক্ষপথ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে সক্ষম স্যাটেলাইট পর্যন্ত সবকিছুতেই প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করবে।
জানা যায়, ওই ঘটনা ঘটেছে রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘রসকসমস’-এর উপগ্রহ বিধ্বংসী পরীক্ষা (‘ডাইরেক্ট অ্যাসেন্ট অ্যান্টি-স্যাটেলাইট টেস্ট (ডিএ-এস্যাট)’-র জন্য। চার দশক আগে পৃথিবীর কক্ষপথে একটি উপগ্রহ পাঠিয়েছিল রসকসমস। সেই উপগ্রহটির নাম ছিল ‘কসমস ১৪০৮’। সাবেক সোভিয়েত জামানায় উপগ্রহটিকে পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠানো হয় বিভিন্ন দেশের ওপর গোয়েন্দাগিরির জন্য। যদিও কয়েক দশক আগেই কার্যকালের মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়ে অচল হয়ে যায় উপগ্রহটি।
আমেরিকার বিদেশ দপ্তর ও নাসার অভিযোগ, উপগ্রহটিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে উড়িয়ে দেওয়ার আগে সেই কর্মসূচির কথা আমেরিকা, ভারত, জাপান, চীন বা ইউরোপের কোনো দেশের মহাকাশ সংস্থাকেই জানায়নি রুশ মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রসকসমস। এই ঘটনা আগামী দিনে মহাকাশে বিভিন্ন দেশের পেশী প্রদর্শন ও সমরসম্ভার পাঠানোর গোপন প্রস্তুতিতে আরও উৎসাহিত করবে। উৎসাহিত করবে উপগ্রহ বিধ্বংসী উপগ্রহ ও মহাকাশ যুদ্ধে খুব প্রয়োজনীয় লেসার রশ্মির অস্ত্রশস্ত্র বানাতে। তাই এ ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ ও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে নাসা। তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে আমেরিকার বিদেশ দপ্তরও।
আমেরিকার বিদেশসচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়ে এই পরীক্ষা করেছে রাশিয়া। ওই ঘটনায় এখনই কক্ষপথে দেড় হাজারেরও বেশি মহাকাশ আবর্জনা বা স্পেস ডেব্রি তৈরি হয়েছে। সেগুলো বেশ বড় ও মাঝারি আকারের। আগামী দিনে সেগুলোর ধাক্কাধাক্কিতে টুকরোগুলোর সংখ্যা আরও বাড়বে। তা বিভিন্ন মহাকাশযানের যাতায়াত ও আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠল। তার ফলে অন্যান্য দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও বিজ্ঞান গবেষণা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা জোরদার হলো।’
রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রোজকসমস অবশ্য ঘটনাটিকে এত বড় করে দেখতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
সংস্থাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে জানায়, ‘কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান বস্তুগুলোর কারণে আইএসএসের নভোচারীরা মহাকাশযানের ভেতরে অবস্থান নিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু পরে সেগুলো আইএসএসের কক্ষপথ থেকে সরে গেছে। এখন আইএসএস সম্পূর্ণ নিরাপদ।’
তবে গত সপ্তাহ থেকে রাশিয়া যেভাবে ইউক্রেন সীমান্তে সেনা জড়ো করছে, তার সঙ্গে এ পরীক্ষার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
নাসার প্রধান বিল নেলসন এক বিবৃতিতে বলেছেন, নাসা কক্ষপথে আমাদের ক্রুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগামী দিনে এবং তার পরেও ধ্বংসাবশেষের ওপর নজরদারি চালিয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষার পর যে ধ্বংসাবশেষ তৈরি হয়েছে তা কক্ষপথে অন্যান্য উপগ্রহের সঙ্গে সংঘর্ষ তৈরি করতে পারে। পৃথিবীর কক্ষপথের মাধ্যমে প্রজেক্টাইলগুলোর একটি চেইন প্রতিক্রিয়া স্থাপন করে।
নাসার উদ্বেগের জবাবে তাৎক্ষণিকভাবে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী কিংবা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কোনো মন্তব্য করেনি। ইউএস স্পেস কমান্ড জানিয়েছে, রাশিয়ার উপগ্রহ ক্ষেপণাস্ত্রটি ১৫০০টিরও বেশি অরবিটাল ধ্বংসাবশেষ তৈরি করেছে। এগুলোর সংখ্যা সম্ভবত কয়েক হাজার হতে পারে।
স্পেস কমান্ডের প্রধান মার্কিন সেনা জেনারেল জেমস ডিকিনসন বলেছেন, রাশিয়া বিশ্ববাসীর জন্য মহাকাশ ডোমেনের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতার ব্যাপারে ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলা প্রদর্শন করেছে। ধ্বংসাবশেষগুলো একবছর ধরে মহাকাশে হুমকি হয়ে থাকবে। স্যাটেলাইট এবং মহাকাশ মিশনও ঝুঁকির মধ্যে রাখবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৩
আপনার মতামত জানানঃ