নর্ডিক উপাখ্যান গুলির মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম অত্যাচার পদ্ধতি ছিল ব্লাড ঈগল। এই পদ্ধতিতে অপরাধীকে বেঁধে পিছন দিকটা ছুরি দিয়ে চিঁরে ফেলা হত, এরপর পিছন দিকের পাঁজরের হাড়গুলোকে টেনে বের করে দুইপাশে ছড়িয়ে দেয়া হত। দেখলে মনে হত ঈগলপাখি পাখা মেলে আছে।
শরীরের সেই ফাকা অংশ দিয়ে অপরাধীর ভিতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখা যেত। গা শিউড়ে ওঠা এই পদ্ধতির এখানেই শেষ নয়, এরপর খুব সাবধানে অক্ষত অবস্থায় ভিতরের ফুসফুস আর লিভার বের করে আনা হত যাতে অপরাধী আরো কিছুক্ষন যন্ত্রনা নিয়ে বেচে থাকে, যন্ত্রনা আরো বাড়িয়ে দেয়ার জন্য সেখানে লবনও ছিটিয়ে দেয়া হত। এই নারকীয় শাস্তির প্রবর্তন ভাইকিংদের হাত ধরে।
ভাইকিং বলতে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার (বর্তমান ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন) সমুদ্রচারী ব্যবসায়ী, যোদ্ধা ও জলদস্যুদের একটি দলকে বোঝায়। এরা ৮ম শতক থেকে ১১শ শতক পর্যন্ত ইউরোপের এক বিরাট এলাকা জুড়ে লুটতরাজ চালিয়েছিল। এমনকি বসতিও স্থাপন করেছিল। এদেরকে নর্সম্যান বা নর্থম্যানও বলা হয়।
ইতিহাসবিদদের মতে ভাইকিংরা পূর্ব দিকে রাশিয়া ও কনস্টান্টিনোপল পর্যন্ত পৌঁছেছিল। অন্যদিকে পশ্চিমদিকে গ্রিনল্যান্ডে ভাইকিংরা ৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ইউরোপীয় বসতি স্থাপন করে এবং সম্ভবত প্রথম ইউরোপীয় জাতি হিসেবে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করে। আইসল্যান্ড ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অনেক গাথায় ভাইকিংদের শৌর্য-বীর্যের কথা বলা হয়েছে। সেই সাথে উল্লেখ আছে তাদের নৃশংসতার কথা।
নবম শতকের ইংল্যান্ডে দুর্ধর্ষ লুটেরা জলদস্যু ভাইকিংদের উৎপাতে অতিষ্ঠ অ্যাংলো স্যাক্সনরা। প্রতি গ্রীষ্মে নর্দার্ন ইংল্যান্ডের উপকূলে নোঙর করে ভাইকিংরা। হত্যা ধর্ষণ লুটপাট করে প্রচুর সম্পদ নিয়ে শীতের শুরুতে ফিরে যায় তারা। ধনসম্পদে পূর্ণ ইংরেজ চার্চ আর প্রাসাদ লুটে ভাংকিংরা ততদিনে এক জীবন্ত যমদূত যেন।
দাসপ্রথার শুরু না করলেও ভাইকিংরা একে নতুন একটি স্তরে নিয়ে গিয়েছিল। ইতিহাসবিদ জন হ্যায়উড এর মতে ডাবলিন এবং লিমেরিকসহ আয়ারল্যান্ডের অন্যান্য বড় শহরগুলো ভাইকিং দের দাসপ্রথার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। ভাইকিং জাতি শত শত বছর ধরে সেখানে থেকে তীরবর্তী আয়ারল্যান্ড, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের বিভিন্ন জায়গায় লুটতরাজ করতো।
তারা সন্ন্যাসীদের আশ্রমগুলোতেই বেশিরভাগ আক্রমণ করতো, ধন-সম্পদ কিংবা খ্রিস্টধর্মকে ঘৃণা করার জন্য নয় বরং শিক্ষিত লোকদের অপহরণ করতে যাদেরকে পরবর্তীতে নপুংসক করে বিক্রি করার মাধ্যমে লাভবান হওয়া যেতো। সে সময় মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য অঞ্চলে মহিলাদের দ্বাররক্ষক, শিক্ষক, হারেমঘর রক্ষক এবং দাস হিসেবে নপুংসকদের চাহিদা ছিলো সবচেয়ে বেশি। এভাবেই ভূমধ্যসাগরীয় দাসপ্রথার ভিত গড়ে ওঠে ভাইকিংদের হাত ধরে।
স্যাক্সন রাজারা এর প্রতিকার করার চেষ্টায় রত ছিল। এরপর নর্দাম্বিয়ার রাজা অ্যায়লা ভাইকিংদের রাজাকে বন্দী করেন এবং মৃত্যুদণ্ড দেন। তাকে সাপের গর্তে ফেলে দেওয়া হয়। যদিও পরে এক যুদ্ধে কিং অ্যায়লা ধরা পড়েন ভাইকিংদের হাতে। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হন। পিঠে ব্লাড ঈগল তৈরি করে সেই মৃত্যু কার্যকর করা হয়। তৈরি হয় ইতিহাস।
এই কাহিনীটা স্যাক্সো গ্রামাটিকাস নামধারী ত্রয়োদশ শতকের এক ভাইকিং কবির সাগা (ভাইকিং গাথাকাব্য) থেকে নেওয়া। ঘটনার সময়কাল থেকে প্রায় চারশ বছর পরের রচনা বলে অনেকেই ব্লাড ঈগলকে ভাইকিং প্রোপাগান্ডা বলে মনে করেন, তবে আধুনিক ইতিহাসবেত্তারা অনেকাংশেই একমত যে, ব্লাড ঈগল নামের এই ভয়ংকর মৃত্যুদণ্ড নিছক প্রোপাগান্ডা নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এর সত্যতা মিলেছে।
মধ্যযুগে মৃত্যুদণ্ড ছিলো অতি স্বাভাবিক ঘটনা। রাজারা কথায় কথায় গর্দান নিয়ে নিতেন। তখন আসলে শাস্তির মাত্রা নির্ভর করতো মৃত্যুদণ্ডের ধরনের উপর। বড় মাত্রার অপরাধের শাস্তি ছিলো যন্ত্রণাদায়ক কোনো মৃত্যু, যা একইসাথে দর্শকদের জন্য হতো উপভোগ্য। মৃত্যুদণ্ড ছিলো রীতিমতো বিনোদনের একটা উপায়।।ব্লাড ঈগল সেরকমই এক ভাইকিং প্রথা। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে, ভিকটিমকে অসম্মান করতে বা বড় ধরনের ভীতি ছড়িয়ে দিতে এই প্রক্রিয়ায় হত্যা করা হতো।
ব্লাড ঈগল করার জন্য ভিকটিমকে হাঁটু গেড়ে বসানো হতো, দুই হাত থাকতো দুদিকে ছড়ানো। জল্লাদ ধারালো কুঠার বা বড় আকারের ছুড়ি দিয়ে টেইল বোন থেকে কাঁধ পর্যন্ত উন্মুক্ত করে নিতো। এরপর কুঠার দিয়ে পাঁজরের প্রতিটা হাড় মেরুদন্ড থেকে আলাদা করে দুপাশে টেনে ছড়িয়ে দেওয়া হতো, রিবগুলোর সাথে চামড়া লেগে থাকায় সামনে থেকে দেখে মনে হতো পাখির ডানা।
কিছু কিছু সাগা অনুযায়ী, অধিক যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য ক্ষতস্থানে লবণ মাখিয়ে দেওয়া হতো। শেষে দুই ফুসফুস দুদিকে টেনে বের করে আনা হতো। সামনে থেকে দেখে মনে হতো যেনো এক রক্তাক্ত ঈগল ডানা মেলে আছে। পুরো প্রক্রিয়াটি করা হতো ভিকটিমকে জ্যান্ত রেখে। প্রচন্ড যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বেচারা মৃত্যুকে বরণ করতো।
ব্লাড ঈগল কেবল এক ধরনের মৃত্যুদণ্ডের পদ্ধতিই নয়, বরং দেবতা অডিনের কাছে ভিকটিমকে উৎসর্গ করা হতো এভাবে। অর্থাৎ একে একপ্রকার ধর্মীয় রিচুয়ালও বলা চলে। শুধু কিং অ্যায়লা নয়, আরো বেশ কজন সম্ভ্রান্ত অভিজাত ব্যক্তিকে ব্লাড ঈগলের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছেন হাফডান লং লেগ। ভাইকিং আর্ল আইনার হাফডানের আর্লডম দখল করে নেন এবং হাফডানের ব্লাড ঈগল ঘটান। কিং ম্যালগুলাই অব মুনস্টার, আর্চবিশপ অ্যায়লিয়াহ কিংবা অ্যাংলো স্যাক্সন কিং এডমুন্ড অব ইংল্যান্ড, প্রত্যেকেই ব্লাড ঈগলের শিকার হয়েছিলেন বলে নর্ডিক সাগাগুলোয় বলা হয়।
ব্লাড ঈগল করা হতো দুটো কারণে। প্রথমত, দেবতা অডিনের প্রতি উৎসর্গ করা। দ্বিতীয়ত, বিজিত অঞ্চলের মানুষের মাঝে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়া। ব্লাড ঈগল এতটাই ভীতিকর ছিলো, কোনো গ্রামে ব্লাড ঈগলের গুজব উঠলে সে গ্রাম মুহূর্তেই খালি হয়ে যেতো। ইউরোপজুড়ে ভাইকিংদের যে অপরাজেয় ও ভয়ংকর ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিলো, তার পিছনে ব্লাড ঈগলের বিশাল অবদান ছিলো। ব্লাড ঈগলের সত্যতা নিয়ে এখনো নিসন্দেহ হওয়া যায়নি। এতোটা ভয়ংকর বিষয় মানতে এখনো ঐতিহাসিকদের কষ্ট হয়। একে নর্ডিক প্রোপাগান্ডা হিসেবেও অনেকে বর্ননা করেছেন। তবে রিউমার হোক আর রিচুয়াল, ব্লাড ঈগল মধ্যযুগীয় ইউরোপের এক ভয়াবহ আতংকের নাম।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯১৫
আপনার মতামত জানানঃ