দিন দিন পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হচ্ছে আফগানিস্তানে। ভেঙে পড়া অর্থনীতি, অদক্ষ প্রশাসন আর উপর্যুপরি হামলায় গৃহযুদ্ধের যুগে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে দেশটি। মানুষের মুখে খাবার নেই, কর্মসংস্থান নেই, আছে শুধু মৃত্যু আর ধর্ম। এসবের মধ্যেই প্রায় প্রতি শুক্রবার জুমার দিনে আফগানিস্তানের বিভিন্ন মসজিদে বোমা হামলা চালিয়ে আসছে জঙ্গিরা। এরই ধারাহিকতায় অশান্ত নানগারহার প্রদেশের একটি মসজিদে জুমার নামাজ চলাকালে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। এতে অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। আগের হামলাগুলো শিয়াদের মসজিদে হলেও এবারের হামলার শিকার মসজিদটিতে মূলত সুন্নি মুসলিমরা নামাজ পড়তেন বলে জানা গেছে।
শুক্রবার দুপুর দেড়টায় প্রদেশের স্পিনঘার এলাকার একটি মসজিদে এ বিস্ফোরণ হয় বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন তালিবান কর্মকর্তারা।
নানগাহার প্রদেশের সরকারি মুখপাত্র কারি হানিফ মার্কিন সংবাদ সংস্থা এপিকে বলেছেন, ধারণা করা হচ্ছে দুষ্কৃতিকারীরা আগে থেকেই মসজিদে বোমাটি লাগিয়ে রেখেছিল।
আতাল শিনওয়ারি নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা রয়টার্সকে বলেন, মুসুল্লিরা তখন নামাজের জন্য মসজিদে জড়ো হয়েছিলেন। এসময় হঠাৎ একটি বোমা বিস্ফোরণ হয়। তবে, বোমাটি তেমন শক্তিশালী ছিল না।
স্থানীয় এক চিকিৎসক ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, অন্তত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
আন্তর্জাতিক জঙ্গিসংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আফগানিস্তান শাখা আইএস খোরাসান বা আইএস-কে ইতোমধ্যে হামলার দায় স্বীকার করেছে।
গত আগস্টে তালিবান ক্ষমতা গ্রহণের পর মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের আফগান শাখা ইসলামিক স্টেট অব খোরাসান তথা আইএসকে প্রায়ই আফগানিস্তানজুড়ে বোমা হামলা চালাচ্ছে। নভেম্বরের শুরুতে কাবুলের সবচেয়ে বড় সামরিক হাসপাতালে হামলা চালিয়ে ১৯ জনকে হত্যা করে আইএসকে। ওই ঘটনায় অন্তত ৫০ জন আহত হন। তার কিছুদিন আগেই নৃতাত্ত্বিক হাজারা সম্প্রদায়ের দুটি মসজিদে বোমা হামলা চালিয়ে ১২০ জনকে হত্যা করে আইএসকে।
আইএস-কে গোষ্ঠীর সুন্নি যোদ্ধারা অতীতে বারবারই শিয়া সংখ্যালঘুদের নিশানা করে হামলা চালিয়েছে। আত্মঘাতী হামলা চলেছে মসজিদে, স্পোর্টস ক্লাবে এবং স্কুলেও। সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে আইএস তালিবানের বিরুদ্ধে হামলা জোরদার করেছে।
কাবুলে তালিবান নেতাদের একটি শেষকৃত্যানুষ্ঠানে আইএস হামলা চালিয়েছে কিছুদিন আগেই। পূর্বাঞ্চলীয় নানগহর এবং কুনার প্রদেশেও বেশকিছু ছোটখাট হামলা হয়েছে। এই প্রদেশগুলো আগে আইএস এর ঘাঁটি ছিল।
বহু আফগান আশা করেছিল তালিবান ক্ষমতা হাতে নেবার পর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা এলেও একটা অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু সিকান্দার কিরমানি জানাচ্ছেন তালিবান নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করার যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, আইএস তাতে বড়ধরনের হুমকি হয়ে উঠছে। গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধাহত দেশটি।
অবশ্য তালিবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করে বলেন, আফগানিস্তানে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) কমবেশি নিয়ন্ত্রণে আছে।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আইএস বড় কোনো হুমকি নয়।
গত মধ্য আগস্টে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালিবান। পরের মাসে তারা সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়। তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ আইএস সদস্য বা সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ।
আইএসের যেসব সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে নারীও রয়েছেন বলে জানান তালিবানের মুখপাত্র। তবে তিনি বলেন, আইএসের গ্রেপ্তার হওয়া নারী সদস্যদের সংখ্যা কম।
জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ দাবি করেন, আফগানিস্তানে আইএসের সদস্য সংখ্যা বেশি নয়। কারণ, তাদের জনগণের সমর্থন নেই।
আফগানিস্তানে আইএসের বিরুদ্ধে তালিবানের অভিযান অব্যাহত আছে বলে জানান জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ। এরমধ্যেই আজ এই ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণ ঘটলো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব হামলা তালিবান সরকারের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। বিদেশি বাহিনী চলে যাওয়ার পর গত আগস্টেই তারা ক্ষমতা বুঝে নেয়। এর মধ্যেই বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। তালিবান সরকার-সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বেশ কয়েকজন আইএস নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরো অনেক সন্দেহভাজনকে হত্যা করা হয়েছে। তার প্রতিশোধ হিসেবে এ হামলার ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এখনো প্রকাশ্যে কোনো অভিযোগ করা হচ্ছে না।
তালিবানরা এবার ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি আগের চেয়ে শান্ত হবে বলে প্রত্যাশা করেছিলেন অনেক আফগান নাগরিক। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে তালিবান সরকারের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইসলামিক স্টেট অব খোরাসান বা আইএস-কে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৩
আপনার মতামত জানানঃ