পাকিস্তানের রক্ষণশীল সমাজে এখনও পুত্র সন্তান হওয়াকে আশীর্বাদ হিসেবে মনে করা হয়৷ কেবল কন্যাসন্তান আছে এমন পরিবারকে সামাজিক নানা চাপের মুখেও পড়তে হয়৷ এদিকে লিঙ্গ বৈষম্যেও পাকিস্তান বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। এসবের মাঝেও পাকিস্তানে বেড়েছে লিঙ্গ পরিবর্তন করার আবেদন। লিঙ্গ পরিবর্তন করতে অর্থাৎ পুরুষ থেকে নারী বা নারী থেকে পুরুষ হতে আবেদন করেছেন প্রায় ২৯ হাজার মানুষ। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই আবেদন করেন দেশটির নাগরিকরা।
পাকিস্তান পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটে লিঙ্গ পুনর্নির্ধারণ করতে চাওয়া লোকদের কাছ থেকে পাওয়া আবেদনের যে বিবরণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জমা দিয়েছে তা থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে জমা দেওয়া নথির বরাতে পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন জানায়, বর্তমান সরকারের আমলে লিঙ্গ পরিবর্তনের অস্ত্রোপচারের জন্য ২৮,৭২৩ জন মানুষ আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, নাগরিকরা চিকিৎসার কারণেই লিঙ্গ পুনর্নির্ধারণের জন্য আবেদন করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ থেকে ২০২১ পর্যন্ত, মোট ১৬ হাজার ৫৩০ জন পুরুষ- পুরুষদের থেকে নারীদের লিঙ্গ পুনর্নির্ধারণের জন্য আবেদন করেছিলেন এবং ১২ হাজার ১৫৪ জন নারী পুরুষদের লিঙ্গ পুনঃনির্ধারণ করতে আবেদন করেছেন।
এতে আরও বলা হয়, একইভাবে, ৯ জন পুরুষ, পুরুষ থেকে ট্রান্সজেন্ডারে লিঙ্গ পুনর্নির্ধারণের জন্য আবেদন করেছিলেন। ২১ জন ট্রান্সজেন্ডার থেকে পুরুষে রূপান্তরিত হয়েছে এবং ৯ জন ট্রান্সজেন্ডার থেকে নারীদের লিঙ্গ পুনর্নির্ধারণে করতে আবেদন করেন।
এর আগে গত বছর পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের একটি জমিদার পরিবারের দুই বোন লিঙ্গ পরিবর্তন করে আলোচনায় আসেন।
ইসলামাবাদে তাদের অপারেশন হয়। পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স এর ১২ জন ডাক্তার মিলে এই জটিল অস্ত্রোপচার করেছেন। দুবছর ধরে সিনিয়র ডাক্তার আমজাদ চৌধুরির কাছে চিকিৎসাধীন ছিলেন দুজন।
দুজনেই ছোট থেকে ছেলে হতে চাইতেন। তারা যদি পরস্পরের ভাই হতে পারেন, তাহলে ভাল হয়। এমন ইচ্ছা পুষে রেখেছিলেন মনে। সেই ইচ্ছা পূরণ হওয়ায় দুজনেক খুশির অন্ত নেই। দুজনেই ছোট থেকে ছেলেদের পোশাক পরতে ভালবাসতেন। তাদের স্বভাবও ছিল অনেকটাই ছেলেদের মতো। তাদের আরও সাতটি বোন রয়েছে। সেই বোনেরা দুই ভাইকে পেয়ে খুব খুশি।
লিঙ্গ পরিবর্তনের স্বাধীনতা ও তাদের মৌলিক নাগরিক অধিকারের জন্য বিশ্ব জুড়ে আন্দোলন হয়ে আসছে। বিশ্বে মাত্র ২০ টি দেশে আইনগতভাবে তাদের কিছু অধিকারের বৈধতা দিয়েছে বলে জানিয়েছে তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘গ্লোবাল কমিশন অন এইচআইভি অ্যান্ড দি ল’।
লিঙ্গ পরিবর্তন অধিকার ও লিঙ্গ পরিচয়ের স্বীকৃতি প্রদানে শীর্ষে রয়েছে আর্জেন্টিনা এবং ডেনমার্ক। ২০১২ সালে আর্জেন্টিনার সিনেট সদস্যরা সার্জারির মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন অধিকারের আইন পাশে সর্বসম্মতিক্রমে সম্মত হন। এমনকি লিঙ্গ পরিবর্তনের পদ্ধতিটি সরকারি এবং বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্রের পরিকল্পনার অর্ন্তভুক্তি করা হয়।
ইউরোপের একমাত্র দেশ ডেনমার্ক লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য কোন ধরনের সাইকিয়াট্রিক ডায়াগোনিসেস অথবা মেডিকেল সার্টিফিকেট ছাড়াই লিঙ্গ পরিবর্তন করা সম্ভব বলে জানিয়েছে লিঙ্গ পরিবর্তনকারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ট্রান্সজেন্ডার ইউরোপ। তবে এই সংগঠনের দাবি ইউরোপের ৩৪ টি দেশ এখনো লিঙ্গ পরিবর্তনের করার মাধ্যমে তার নাম, লিঙ্গ পরিবর্তনকে স্বীকৃতি দেয়নি।
২০১৫ সালে মাল্টায় সরকার লিঙ্গ পরিচয়, জেন্ডার অনুভূতি, সেক্সের ধরন ইত্যাদি নির্ণয়ে আইন প্রণয়ন করেন। এই আইনুসারে স্বেচ্ছায় কাগজে কলমে ও শারীরিক হরমোনগতভাবে লিঙ্গ পরিবর্তনে ব্যক্তি অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়।
১৯৮৭ সালে ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা্হ খোমেনি লিঙ্গ পুনস্থাপন সার্জারি বৈধতা দিয়ে এক ফতোয়া জারি করেন। যার ফলে ইরানে লিঙ্গ পরিবর্তনের অধিকার সরকারিভাবে স্বীকৃতি পায়। তবে সরকার বিরোধীরা সরকারের এই নীতিকে সমালোচনা করে ট্রান্সজেন্ডার মানুষের জন্য দ্বি-ধারালো তলোয়ার নীতি হিসাবে উল্লেখ্য করে।
২০১৪ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট লিঙ্গ পরিবর্তনকারীদের ‘হিজড়া’ নামে তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। তবে তাদের কোনো ধরনের লিঙ্গ পুনস্থাপনের দরকার হয়নি। এই অধিকার পাওয়ার পর লিঙ্গ পরিবর্তনকারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকুরীসহ লিঙ্গ বৈষম্য রক্ষায় তারা সমান অধিকার পায়।
তবে বিভিন্ন দেশে তারা আইনগত স্বীকৃতি পেলেও তাদের সামাজিক প্রতিহিংসা শিকার হতে হয়। ট্রান্সজেন্ডার ইউরোপের তথ্য অনুসারে, ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত মোট ২,২৬৪ জন লিঙ্গ পরিবর্তনকারীকে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালের ২৭ জন লিঙ্গ পরিবর্তনকারীকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের মতো ধর্মীয় কট্টর দেশে লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য এত পরিমাণে আবেদন অভূতপূর্ব বিষয়। দেশটিতে এমনিতেই নারীরা নানা রকমের বৈষম্য, নির্যাতন ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করে। তার মধ্যে ট্রান্সজেন্ডার প্রতি দেশটিতে রয়েছে বিরূপ মনোভাব। এমন অবস্থায় লিঙ্গ পরিবর্তন করে দেশটিতে তারা কতোটা নিরাপদ থাকতে পারেন তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩৪
আপনার মতামত জানানঃ