কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্র সরবরাহের উদ্দেশ্যে পাহাড়ে গড়ে উঠেছিল অস্ত্র তৈরির কারখানা। সে কারখানার সন্ধান পেয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব-১৫) সদস্যরা।
সোমবার (০৮ নভেম্বর) ভোরে কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের এক্স-৪ ক্যাম্পের গহিন পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে ‘অস্ত্র কারখানা’ থেকে তিন জন অস্ত্রের কারিগরসহ ১০টি অস্ত্র ও বিপুল অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনায় আটক তিন জন রোহিঙ্গা অস্ত্র কারিগর বলে দাবি করেছে র্যাব। আটকরা হলেন কুতুপালং ক্যাম্প সি-১ জি ব্লকের মৃত আজিজুর রহমানের ছেলে বাইতুল্লাহ (১৯), তার ভাই হাবিব উল্লাহ (৩২) ও একই ক্যাম্পের জি ব্লকের জাহিদ হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ হাছুন (২৪)।
বিষয়টি নিশ্চিত করে র্যাব-১৫ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খায়েরুল ইসলাম। তিনি গণমাধ্যমিকে বলেন, একটি চক্র দীর্ঘ দিন ধরে এ কারখানা তৈরি করে অস্ত্র বানিয়ে আসছিল। এখান থেকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে বলে তথ্য পায় র্যাব। এমন তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে কারখানাটি শনাক্ত করা হয়।
তিনি জানান, শনাক্তের পর আজ ভোরে চার ঘণ্টার বেশি সময় গুলি বিনিময়ের পর কারখানাটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে পাঁচটি পিস্তল, পাঁচটি বন্দুক ও বিপুল অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
তিনি আরও জানান, ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসীদের তৎপরতা ঠেকাতে কাজ করছে র্যাবের সদস্যরা। তবে গোলাগুলির ফাঁকে বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যায়। আইনি ব্যবস্থা শেষে আটকদের উখিয়া থানায় হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা। এ বিষয়ে মামলার প্রস্তুতি চলছে।
অপরাধের অভয়ারণ্য
কক্সবাজারের অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে উখিয়া-টেকনাফে ৩২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, অস্ত্র ও মাদক পাচার, ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ। গত চার বছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে ১ হাজার ২৯৮টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি হয়েছে ২ হাজার ৮৫০ রোহিঙ্গা।
ক্যাম্পগুলোর ভেতরে গড়ে উঠেছে ১৫ থেকে ২০টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে মাদক ব্যবসাসহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড। অভিযোগ উঠেছে, এখানে প্রতিদিন প্রায় শতকোটি টাকার ইয়াবার লেনদেন হয়। শুধু তাই নয়, গোটা দেশ জুড়ে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা হয় এসব ক্যাম্প থেকেই।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও কর্মীদের দাবি, অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরেই অন্তত ১৫ থেকে ২০টি সক্রিয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। এর বাইরে ক্যাম্পকেন্দ্রিক রয়েছে আরও একাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী।
প্রত্যেক বাহিনীতে ৩০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত সদস্য রয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে ক্যাম্পগুলো হয়ে ওঠে অপরাধের অভয়ারণ্য। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি ও খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ে রোহিঙ্গারা।
মাস্টার মুন্না গ্রুপ, মৌলভী ইউসুফ গ্রুপ, রকি বাহিনী, শুক্কুর বাহিনী, আব্দুল হাকিম বাহিনী, সাদ্দাম গ্রুপ, জাকির বাহিনী, নবী হোসেন বাহিনী, পুতিয়া গ্রুপ, সালমান শাহ গ্রুপ, গিয়াস বাহিনী, শাহ আজম গ্রুপ ইত্যাদি ক্যাম্পে বেশ পরিচিতি পাওয়া সক্রিয় সন্ত্রাসী গ্রুপ।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্যমতে, চার বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে ১ হাজার ২৯৮টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি হয়েছে ২ হাজার ৮৫০ রোহিঙ্গা। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, অস্ত্র ও মাদক পাচার, মানব পাচার, পুলিশের ওপর হামলা ইত্যাদি।
সূত্র মতে, ৪ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৭০টি খুনের মামলা হয়েছে। এ সময় ৭৬২টি মাদক, ২৮টি মানব পাচার, ৮৭টি অস্ত্র, ৬৫টি ধর্ষণ ও ১০টি ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে। ৩৪টি মামলা হয়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের অপরাধে। অন্যান্য অপরাধে হয়েছে ৮৯টি মামলা।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৫৩
আপনার মতামত জানানঃ