বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশ বেড়েছে৷ নারী এগোচ্ছে৷ বিভিন্ন পেশা, ব্যবসা, রাজনীতি সবখানেই অংশগ্রহণ বাড়ছে৷ দেশে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসাবেও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে নারী ইউএনওকে কোন দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে৷ তার কাজের পরিবেশ এবং নিরাপত্তাই বা কেমন? ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানিয়েছে, দেশে নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) প্রতি এখনো নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। উন্নয়নকাজ তদারকিসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের সময় ৫ দশমকি ৭ শতাংশ ইউএনও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) ‘স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উপজেলা নারী নির্বাহী কর্মকর্তার চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে এ তথ্য জানানো হয়। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সংবাদ সম্মেলনে গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করা হয়।
এসময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি (পরিচালক) মোহাম্মাদ রফিকুল হাসান, সিনিয়র ফেলো-রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি শাহজাদা এম আকরাম, প্রাক্তন সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি) আবু সাঈদ মো. জুয়েল মিয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘ইউএনও একটি উপজেলার প্রধান নির্বাহী হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ইউএনও বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসের পদমর্যাদা ক্রমানুসারে সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার একটি। স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নারী ইউএনও কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে, তা বিশ্লেষণ করাই ছিল এ গবেষণার উদ্দেশ্য। এ গবেষণায় উপজেলা পরিষদে সাচিবিক সহায়তা প্রদান, উপজেলা চেয়ারম্যানকে সহায়তা প্রদান, উপজেলা পরিষদসহ অন্যান্য বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় সাধন এবং উপজেলা প্রশাসনের সরকারি নির্দেশনাবলী পালন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জসমূহ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।’
টিআইবির গবষেণা অনুযায়ী উপজেলা পরিষদে সাচিবিক সহায়তা প্রদান সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী ইউএনও অবৈধ আর্থিক সুবিধা অনুমোদন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। এ ধরনের অবৈধ আর্থিক সুবিধা অনুমোদন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ প্রধানত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে আসে।
নারী ইউএনওর নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, জেন্ডার চাহিদা বিবেচনায় রেখে মাঠপর্যায়ে উন্নয়নকাজ পরিদর্শন ও আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নের মতো বিশেষ পরিস্থিতিতে নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিশেষ কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই।
এতে বলা হয়, জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ ইউএনও জানিয়েছেন- ত্রাণসামগ্রী বিতরণে অনিয়ম করার জন্য তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। এ ধরনের চাপ প্রয়োগের ফলে অতিরিক্ত ত্রাণসামগ্রীর জন্য সুপারিশ করতে বাধ্য হতে হয় বলেছেন ২০ শতাংশ ইউএনও।
‘এছাড়া ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ ইউএনও জানিয়েছেন, ব্যয়ের যথার্থতা যাচাই না করার জন্য তাদেরকে বিভিন্ন মহল থেকে চাপ প্রয়োগ করা হয়। ভুয়া ব্যয়ের বিল অনুমোদন দিতে বাধ্য করা হয় বলে উল্লেখ করেছেন ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ ইউএনও। উপজেলা পরিষদের ক্রয় সংক্রান্ত কাজে অনিয়ম করার জন্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় বলেছেন ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ ইউএনও। ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ ইউএনও বলেছেন— কাজ সম্পাদন করার ক্ষেত্রে তারা সহকর্মীদের থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পান না।’
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, উপজেলা চেয়ারম্যানকে সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে নারী ইউএনও যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন, তার মধ্যে চেয়ারম্যানের কাছ থেকে যথাযথ সহযোগিতা না পাওয়া (৪০ দশমিক ৫ শতাংশ) অন্যতম। ৩১ দশমকি ৪ শতাংশ ইউএনও জানিয়েছেন, উপজেলায় দুর্নীতিবিরোধী কাজের ক্ষেত্রে তারা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন। এছাড়া প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ইউএনও (৩১ দশমিক ৪ শতাংশ) জানিয়েছেন, তাদেরকে বিভিন্ন মহল থেকে অনৈতিক কাজের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। উপজেলার কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে ইউএনওরা (৩১ শতাংশ) রাজনৈতিক প্রভাবের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন।
টিআইবির গবেষণা অনুযায়ী, উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন জনসেবামূলক কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ ইউএনও বাধার সম্মুখীন হন। এছাড়া উন্নয়ন কার্যাবলী তদারকিসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের সময় ৫ দশমিক ৭ শতাংশ ইউএনও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এসব দায়িত্ব ইউএনও পালন করেন চেয়ারম্যানের কার্যক্রমকে সহজতর করার জন্য। এছাড়াও রয়েছে সমন্বয় সাধন, সরকারি নির্দেশ পালন, দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ।
নারী ইউএনওর নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, জেন্ডার চাহিদা বিবেচনায় রেখে মাঠপর্যায়ে উন্নয়নকাজ পরিদর্শন ও আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নের মতো বিশেষ পরিস্থিতিতে নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিশেষ কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই।
দুর্নীতির শিকার হলে অভিযোগ করার জন্য উৎসাহ প্রদান করেছেন ৫৭.৮% ইউএনও। ৩৫.৬% ইউএনও জানিয়েছেন, উপজেলা প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য তারা প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। কারও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে শাস্তি প্রদান করা হয় বলে জানিয়েছেন ২৮.৯% ইউএনও।
উপজেলায় দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করেন ২৮.৯% ইউএনও। এছাড়া উপজেলায় দুর্নীতির প্রবণতা কমিয়ে নিয়ে আসার জন্য নৈতিকতা কমিটি গঠন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির বিরদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন যথাক্রমে ২২.২% ও ৪.৫% নারী ইউএনও।
এছাড়া কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে ইউএনও’রা রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে পুরষতান্ত্রিক/পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবের মুখোমুখি হন। ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ ও বিভিন্ন প্রকল্পের কাজের পরিকল্পনা ও সম্পাদনকালীন স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের থেকে অনিয়ম করার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। এছাড়া ইউএন’রা দুর্নীতিবিরোধী কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন এবং অনেক সময় তাদেরকে অনৈতিক কাজ করতে চাপ প্রয়োগ করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন নারী প্রশাসনে আছেন না শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন সেটা বিষয় না৷ বিষয়টি হলো তিনি নারী৷ নারী যে অবস্থানেই থাকুন না কেন সেই অবস্থান থেকেই তিনি যৌন হয়রানি থেকে নানা ধরনের হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন৷ শ্রম আইনে শ্রমজীবী নারীদের জন্য তবু কিছু বলা আছে৷ কিন্তু অন্যপদে যে নারীরা কাজ করেন তাদের হয়রানি প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট কোনো আইনও নেই৷
তারা বলেন, শুধু বৈষম্য নয়, এখন সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো নারী কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে৷ সেটা মাটিকাটা শ্রমিক যেমন হচ্ছে কর্পোরেট হাউজেও হচ্ছে৷ সংবাদমাধ্যমে হচ্ছে, পুলিশ ও প্রশাসনে হচ্ছে৷ সবখানেই হচ্ছে৷
আরও বলেন, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নারীদের কাছে নতুন কিছু নয়। নিজের কর্মস্থলে এর থেকে তিক্ত অভিজ্ঞতা কি আর হওয়া সম্ভব? বসের ফণা তুলে ফোঁসফোঁস করা, শিক্ষকের ভক্ষকের মতো আচরণ যে নারী একবার দেখেছেন, তিনিই জানেন কত কুৎসিত তাদের দৃষ্টি, কত জঘন্য তাদের ভাষা, কতটা হিংস্র তাদের স্পর্শ। চক্ষুলজ্জা ও চাকরি হারানোর ভয়ে অনেকে এ বিষয়ে রিপোর্ট করেন না। তার মানে এই নয় কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি হচ্ছে না। যৌন হয়রানি হতে পারে মৌখিক, লিখিত আবার হতে পারে শারীরিক। অশ্লীল কৌতুক, ফোনে বা ইমেইলে কু ইঙ্গিত, অপ্রীতিকর স্পর্শ, কাজের ছুতোয় শারীরিকভাবে হেনস্তা করা— আরো অনেক কিছুই এর মধ্যে পড়ে।
এসব দূর করার জন্য ৮টি সুপারিশ করেছে টিআইবি। এগুলো হলো:
১. নারী ইউএনওদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দূর করার জন্য উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা পরিষদের অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে নারীর প্রতি সংবেদনশীল আচরণের উপর প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের এসিআর এ জেন্ডার সংবেদশীলতাকে একটি সূচক হিসেবে রাখা যেতে পারে।
২. উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাচিবিক সহায়তা প্রদান সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ইউএনও এবং চেয়ারম্যানগণকে নিয়ে ওরিয়েন্টেশনের আয়োজন করা, যার মূল লক্ষ্য হবে একে অন্যের প্রতিপক্ষ নয় বরং সহযোগী এটা অনুধাবন করানো।
৩. দুর্নীতি প্রতিরোধে নারী ইউএনও’র পদক্ষেপের জন্য জেলা পর্যায়ে তাকে সম্মানিত করা এবং পুরস্কারের ব্যাবস্থা রাখতে হবে।
৪. উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে কোন নারী ইউএনও সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর আক্রমণ ও ষড়যন্ত্রের শিকার হলে তাকে আইনগত সহায়তা দেওয়া ও নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে।
৫. সংবাদমাধ্যমগুলো স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যথাসাধ্য সঠিক সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে ইউএনও’র কার্যক্রম সম্পাদনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদান করবে।
৬. মন্ত্রণালয়ের নীতিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের স্থানীয় উন্নয়নমূলক কাজে চাপ প্রয়োগ বন্ধ করার জন্য পরিপত্র জারি করতে হবে।
৭. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নারী ইউএনও’র সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার উপর নারী ইউএনওদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. নারী ইউএনওকে নিরাপত্তা ও সহযোগিতা প্রদান করার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর হতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০৮
আপনার মতামত জানানঃ