এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন ও উত্তর কোরিয়ার হুমকি মোকাবিলায় মার্কিন যুদ্ধজাহাজের টহল বেড়েছে। মাঝেমধ্যেই মিত্রদের সঙ্গে সামরিক মহড়ায় অংশ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ছাড়াও বিতর্কিত দক্ষিণ চীন সাগরে এ বছর যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক অভিযান জোরদার করেছে বলে চীনের এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে।এদিকে চীন তার পরমাণু অস্ত্র নির্মাণ প্রকল্পকে শক্তিশালী করছে এবং আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটি এক হাজারেরও বেশি পারমাণবিক বোমা তৈরির লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। গতকাল বুধবার মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের এক প্রতিবেদনে এমনটি বলা হয়।
দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি
চীন–তাইওয়ান উত্তেজনার মধ্যেই দক্ষিণ চীন সাগরে বেড়েছে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি।
বেইজিং ভিত্তিক ‘সাউথ চায়না সি প্রবিং ইনিশিয়েটিভ’ বলছে, চলতি বছরের অক্টোবরে মার্কিন সামরিক বাহিনী দক্ষিণ চীন সাগরের আকাশসীমায় ৫২টি পরিদর্শন ফ্লাইট পরিচালনা করেছে।
তবে অক্টোবরে পরিচালিত ফ্লাইটের সংখ্যা সেপ্টেম্বরের ৬২টি ফ্লাইটের চেয়ে কম ছিল। বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ চীন সাগরে অন্যান্য মার্কিন সামরিক অভিযানও তীব্রতর হচ্ছে।
দক্ষিণ চীন সাগরের সিংহভাগ এলাকা চীন নিজের বলে দাবি করে। তবে ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ব্রুনেই ও তাইওয়ানেরও এ সাগরের ওপর দাবি রয়েছে। বিরোধপূর্ণ এ সাগরে প্রায়ই মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি নিয়ে চীন অভিযোগ করে আসছে।
মঙ্গলবার এক খবরে বলা হয়, মার্কিন নৌবহর ইউএসএস কার্ল ভিনসন ক্যারিয়ার ও ব্রিটিশ নৌবহর এইচএমএস কুইন এলিজাবেথ গত মাসে তাদের অনুশীলনের পর থেকে অভিযানের মাত্রা বেড়েছে। খবরে আরও বলা হয়, চলতি বছরে মার্কিন নৌবহর এই এলাকায় প্রবেশ করেছে নয় বার।
চীনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর সাউথ চায়না সি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট উ শিকুন বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ বছর দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর দিয়ে ৫০০টিরও বেশি পরিদর্শন ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। পীত সাগর ও পূর্ব চীন সাগরের কথা হিসাব করলে এই ফ্লাইটের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে অন্তত দুই হাজারে।
সাউথ চায়না সি প্রবিং ইনিশিয়েটিভের তথ্যমতে, গত বছর পরিচালিত মার্কিন পরিদর্শন ফ্লাইটের সংখ্যা ছিল মাত্র এক হাজার।
উ শিকুনের মতে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্বের ঝুঁকি বাড়ছে; তাই উভয় পক্ষকে আচরণবিধি সম্পর্কে দ্রুতই আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
সাউথ চায়না সি প্রবিং ইনিশিয়েটিভ বলছে, কার্ল ভিনসন ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ ছাড়াও এই বছর যুক্তরাষ্ট্র থিওডোর রুজভেল্ট, নিমিৎজ এবং রোনাল্ড রিগান নামে আরও তিনটি স্ট্রাইক গ্রুপ পাঠিয়েছে দক্ষিণ চীন সাগরে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউএসএস ম্যাকিন আইল্যান্ড ও ইউএসএস এসেক্স নামের দুটি উভচর অ্যাসল্ট ভেসেল সহ মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজগুলো এ বছর ১১ বার দক্ষিণ চীন সাগর অতিক্রম করেছে।
চীনা বিশেষজ্ঞ হু বো রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারক সিসিটিভিকে বলেন, দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন সেনা মোতায়েন ২০০৯ সাল থেকেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর সেনা মোতায়েন আরও তীব্র হয়েছে।
দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কয়েক বছর ধরেই চলছে দ্বন্দ্ব। এ অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ফলে দেশটি মিলিত হয়েছে ব্রিটেন, জার্মানি ও কানাডা সহ তার অন্যান্য মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে, যা সহ্য হয়নি চীনের। ফলস্বরূপ ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মাঝে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে।
ওয়াশিংটন বলছে, বিতর্কিত জলসীমায় নৌ চলাচলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এই অভিযানগুলোর প্রয়োজনীতা রয়েছে। অন্যদিকে, বেইজিংয়ের দাবি মার্কিন আচরণ চীনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে।
উ বলেন, যেহেতু চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই সাবমেরিন ও পানির নিচের ড্রোন ব্যবহার করেছে, তাই সমুদ্রে অপরিকল্পিত সংঘর্ষ এড়াতে ও অস্ত্রের ব্যবহার নির্দিষ্ট করতে আচরণবিধি তৈরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, আকাশ, ভূমি ও জলসীমায় প্রচলিত সাবমেরিন, পারমাণবিক সাবমেরিন ও মনুষ্যবিহীন সাবমেরিন পরিচালনায় নির্দিষ্ট নিয়মনীতি নির্ধারণ প্রয়োজন; অন্যথায় দক্ষিণ চীন সাগরে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কয়েক বছর ধরেই চলছে দ্বন্দ্ব। এ অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ফলে দেশটি মিলিত হয়েছে ব্রিটেন, জার্মানি ও কানাডা সহ তার অন্যান্য মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে, যা সহ্য হয়নি চীনের। ফলস্বরূপ ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মাঝে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে।
২০৩০ সালের মধ্যে হাজারেরও বেশি পারমাণবিক অস্ত্র বানাবে চীন
চীন তার পরমাণু অস্ত্র নির্মাণ প্রকল্পকে দ্রুত সম্প্রসারণ করছে। দেশটি আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে এক হাজারেরও বেশি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। গতকাল বুধবার মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের এক প্রতিবেদনে এমনটি বলা হয়।
‘মিলিটারি অ্যান্ড সিকিউরিটি ডেভেলপমেন্টস ইনভলভিং দ্য পিপল’স রিপাবলিক অব চায়না (পিআরসি) ২০২১’ নামের এই প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে পেন্টাগন। তাইওয়ান দ্বীপে চীনা দখলদারি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব যখন প্রায় চরম পর্যায়ে, সে সময় এই প্রতিবেদন প্রকাশ করল পেন্টাগন।
চীন তাইওয়ানকে নিজের এলাকা বলে দাবি করে। সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ চীন সাগরের তীরবর্তী তাইওয়ান–নিয়ন্ত্রিত প্রাটাস দ্বীপ এবং তাইওয়ানের দক্ষিণাঞ্চল ঘেঁষে সাগরের ওপর দিয়ে নিয়মিতই চীনের উড়োজাহাজ চলাচল করছে। তবে যে উড়োজাহাজগুলো তাইওয়ানের আকাশসীমায় ঢুকে পড়েছে, তা উদ্বেগ সৃষ্টিকারী বলে জানিয়েছে অঞ্চলটির কর্তৃপক্ষ। তারা বলেছে, চীনের বোমারু বিমানগুলো পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম।
পেন্টাগনের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, পারমাণবিক ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিসহ বোমা উৎক্ষেপণের জন্য জল, স্থল ও আকাশপথে প্ল্যাটফর্ম নির্মাণে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে চীন। প্রতিবছর দ্বিগুণ হারে চীন নানা পাল্লার পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে।
সেখানে বলা হয়, ২০২০ সাল থেকে পারমাণবিক প্রকল্প উন্নয়নে বড় মাত্রায় বিনিয়োগ শুরু করেছে চীন। ওই বছর দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট সরকার ২০২৭ সালের মধ্যে ৭০০ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে হাজারের বেশি পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর লক্ষ্য নিয়েছিল।
পেন্টাগনের বক্তব্য, আক্রমণের জন্য চীন এভাবে পরমাণু শক্তি বৃদ্ধি করছে না। তারা শক্তির পরীক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে টেক্কা দিতে চাইছে। ক্ষমতার ভারসাম্যে নিজেদের ওজন অনেকটা বাড়িয়ে নিতে চাইছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ তৈরি করে রাখতে চাইছে। চাইলে তারাও যে সমান শক্তি নিয়ে আক্রমণ চালাতে পারে, সেই বার্তা দিয়ে রাখছে।
চীন বরাবরই তাইওয়ানকে নিজেদের সীমানাভূক্ত অঞ্চল বলে দাবি করে আসছে। অন্যদিকে, তাইওয়ানের স্বাধীনতাকামী সরকারকে নিয়মিত আর্থিক, সামরিকসহ বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, চীন যদি তাইওয়ানে সামরিক অভিযান শুরু করে, সেক্ষেত্রে তাইওয়ানকে সহায়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্য প্রচারিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জো বাইডেনের উদ্দেশে সতর্কবার্তা দিয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নিজেদের অভ্যন্তরীণ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো ইস্যুতে চীন কোনো প্রকার ছাড় দেবে না।
এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন গত কয়েক বছর ধরেই শক্তি বৃদ্ধি করছে। একদিকে চীনের নৌবহরকে যেমন ঢেলে সাজানো হচ্ছে, তেমনি ওই অঞ্চলে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করছে চীন। এ নিয়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। বাইডেন আসার পরেও এ বিষয়ে সম্পর্কের উন্নতি হয়নি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৯
আপনার মতামত জানানঃ