বিশ্বে প্রতিবছর নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে শিশুরা। শুধুমাত্র গ্রুপ বি স্ট্রেপটোকোককাস ইনফেকশন (জিবিএস) নামের একটি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে প্রায় দেড় লাখ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। তাদের মধ্যে রয়েছে গর্ভে থাকা শিশু ও নবজাতকেরা। জিবিএস ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ নবজাতকের মৃত্যু হয়। যার ফলে ব্যাকটেরিয়াটির সংক্রমণ ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে টিকা তৈরির আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। গতকাল বুধবার প্রকাশিত একটি যৌথ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে, জিবিএস ব্যাকটেরিয়া নিয়ে নতুন প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে ডব্লিউএইচও ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন। সেখানে বলা হয়, বিশ্বের তিন-চতুর্থাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের শরীরে ব্যাকটেরিয়াটি কোনো রকম ঝুঁকি ছাড়াই অবস্থান করে। তবে সময়ের আগে শিশুদের জন্ম ও বিকলাঙ্গতার ক্ষেত্রে এটি বড় ভূমিকা রাখে।
এর আগের তথ্য সূত্র বলছে, জিবিএস ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ নবজাতকের মৃত্যু হয়। একইভাবে ৫০ হাজারের মতো মৃত শিশু প্রসবের ঘটনা ঘটছে। এবারের প্রতিবেদনে আগের ওই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে বলা হচ্ছে,শিশুমৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
প্রতিবেদন বলছে, প্রতিবছর পাঁচ লাখের বেশি শিশু সময়ের আগে জন্ম নিচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে জিবিএস ব্যাকটেরিয়া। ফলে ওইসব শিশুদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি বিকলাঙ্গতা দেখা দিচ্ছে। সবকিছুর পরও ব্যাকটেরিয়াটি রুখতে টিকা তৈরিতে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এ নিয়ে ডব্লিউএইচও টিকাসংক্রান্ত বিভাগের কর্মকর্তা ফিলিপ ল্যামবাহ জানান, মায়েদের জন্য জিবিএসের টিকা জরুরি ভিত্তিতে তৈরি করার আহ্বান জানাচ্ছে ডব্লিউএইচও। ফলে বিশ্বের দেশগুলো অনেক সুবিধা পাবে।
একই মত দিয়েছেন লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক জয় লন। তিনি জানান, জিবিএসের টিকা তৈরির বিষয়টি তিন দশক আগে আমলে নেওয়া হয়েছিল। তবে পরে বিষয়টির তেমন অগ্রগতি হয়নি। মায়েদের এ টিকা দেওয়া হলে আগামী বছরগুলোতে লাখ লাখ শিশুর জীবন বাঁচবে।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা গেছে, প্রতিবছর বিশ্বের ১৫ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা নারী তাদের জননাঙ্গে জিবিএস ব্যাকটেরিয়া বহন করেন। সাধারণত মায়েদের শরীরে এ ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কোনো উপসর্গের দেখা মেলে না। তবে তাদের শরীর থেকে ব্যাকটেরিয়াটি গর্ভের শিশুর মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। পাশাপাশি সন্তান জন্মের সময় এটি তাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
মায়েদের শরীরে জিবিএসে সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে আফ্রিকা মহাদেশের সাহারা মরুভূমির দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলোতে। এ ছাড়া পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ব্যাকটেরিয়াটির ব্যাপকতা দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো বয়সী শিশু-কিশোর বা নারী-পুরুষের এ রোগ হতে পারে। এতে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে শুরু করে সারা শরীরে দুর্বলতা দেখা দিতে পারে এবং একপর্যায়ে নড়াচড়ার সামর্থ্যও হারিয়ে যেতে পারে।
প্রতিবছর বিশ্বের ১৫ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা নারী তাদের জননাঙ্গে জিবিএস ব্যাকটেরিয়া বহন করেন। সাধারণত মায়েদের শরীরে এ ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কোনো উপসর্গের দেখা মেলে না। তবে তাদের শরীর থেকে ব্যাকটেরিয়াটি গর্ভের শিশুর মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। পাশাপাশি সন্তান জন্মের সময় এটি তাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
জিবিএসের মূল কারণ জীবাণু হলেও জীবাণু-প্রতিরোধী ইমিউন সিস্টেমের অস্বাভাবিক আচরণে এ রোগের উৎপত্তি হয়। ‘ক্যাম্পাইলো ব্যাকটর জেজুনি’ জীবাণুতে আক্রান্ত ডায়রিয়া রোগী বা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে আক্রান্ত সর্দি-জ্বরের রোগীরা পরবর্তী পর্যায়ে জিবিএসে আক্রান্ত হয়।
ডায়রিয়া বা ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার প্রায় দুসপ্তাহ পরে রোগী হঠাৎ করে প্রথমে দুপায়ে দুর্বলতা বোধ করে। ক্রমে তা বাড়তে থাকে এবং উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ক্রমে এ দুর্বলতা মেরুদণ্ড, দুই হাত, বুক ও মুখের মাংসপেশিতে ছড়িয়ে পড়ে। কখনো কখনো দুর্বলতা এত বেশি হয় যে, রোগী হাত-পায়ের আঙুল একটুও নাড়াতে পারে না। বুকের মাংসপেশির দুর্বলতার কারণে শ্বাসকষ্ট হলে রোগীকে আইসিইউতে স্থানান্তর করতে হয়। নইলে রোগী মারাও যেতে পারে। তবে জিবিএস রোগীর স্নায়ুর সমস্যা ও পেশির দুর্বলতা থাকলেও সাধারণ অনুভূতি, স্মৃতিশক্তি, পায়খানা-প্রস্রাবের তেমন সমস্যা হয় না। রোগী কখনো অজ্ঞান হয়েও যায় না।
তারা বলেন, রোগের ইতিহাস, উপসর্গ ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী স্নায়ু পরীক্ষা বা মেরুদণ্ডের রস পরীক্ষা করে এ রোগ নির্ণয় করা হয়। জিবিএস রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া উচিত। এ রোগের নির্দিষ্ট চিকিৎসা হলো- প্লাজমাফেরোসিস বা শিরায় ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইনজেকশন। উপসর্গ দেখা দেওয়ার দুসপ্তাহের মধ্যে এ চিকিৎসা দিতে হয়। নয়তো ইমিউনোগ্লোবিউলিনের কার্যকারিতা থাকে না। নিয়মিত হাত-পায়ের ব্যায়াম করা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখলে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। কোনো কোনো রোগীর পুরোপুরি আরোগ্য পেতে প্রায় এক বছর লেগে যেতে পারে। জিবিএসের ক্ষেত্রে সাধারণত প্রায় ৮০ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ সেরে ওঠে, ৫ থেকে ১০ শতাংশ রোগীর কিছু না কিছু শারীরিক দুর্বলতা স্থায়ীভাবে থেকে যায় এবং প্রায় ৫ থেকে ৬ শতাংশ রোগী মারা যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৮
আপনার মতামত জানানঃ