মানুষের পৃথিবীতে মহামারী আগেও এসেছে; যেমন, প্লেগ, ম্যালেরিয়া, কলেরা, যক্ষা, স্প্যানিশ ফ্লু ইত্যাদি এবং এসব মহামারীতে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুও হয়েছে। তবে করোনাভাইরাস এবং একবিংশ শতাব্দীর ভাইরাসগুলো এসেছে প্রাণীদের কাছ থেকে।
আর এটি নিয়েই আতঙ্কিত হওয়ার যেমন কারণ আছে; তেমনি ভাবনা-চিন্তার বিস্তর অবকাশ আছে। কেননা, প্রামাণিক তথ্য উপাত্ত বলছে যে, নগরায়ন, শিল্পায়ন ও হাই-টেক সভ্যতার ভয়াবহ দূষণ প্রকৃতিতে বিরাজমান বাস্তুতন্ত্র এবং হাজার বছর ধরে চলমান বাস্তুসংস্থানকে নষ্ট করে দিচ্ছে। ক্লাইমেট চেঞ্জ বা আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় সেটি মানুষের জীবনযাপন, ফসল উৎপাদন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রোগ-ব্যাধির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাদের হাতে আর মাত্র ১০ বছর সময় আছে। ২০৩০ সালের মধ্যে আবহাওয়া পরিবর্তনের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে কমানো না গেলে, গরম এতটাই বেড়ে যাবে যে, অনেক প্রজাতির প্রাণী এই গরম সহ্য করতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এতে ওই প্রাণীসমূহ ও তাদের সঙ্গেকার ভাইরাসগুলো চলে আসবে মানুষের মধ্যে। ফলে বিপদ বেড়ে যাবে কয়েকগুণ বেশি।
কয়েক বছর পর পর করোনাভাইরাসের মত প্রাণঘাতী ভাইরাসের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হোমো স্যাপিয়েন্সদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে, নতুবা মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা হয়ে উঠতে পারে বেশ কষ্টকর। পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী ও মহামারীতত্ত্ববিদেরা এমনই আশংকা করছেন। সেজন্য বলা হচ্ছে, মূল সমস্যা হচ্ছে আবহাওয়া পরিবর্তন, ভাইরাস নয়।
করোনা, মাঙ্কিপক্সের পর এবার বিশ্বে নতুন আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে ‘থ্রোট ডিপথেরিয়া’। অস্ট্রেলিয়ায় দুই শিশুর শরীরে এই রোগ শনাক্ত হয়েছে। এ শতাব্দীতে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার এটাই প্রথম ঘটনা।
গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, নিউ সাউথ ওয়েলসে রোববার (৩ জুলাই) দুই শিশুর শরীরে এই রোগ শনাক্ত হয়েছে। গুরুতর অসুস্থ এক শিশুকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে।
অপর শিশুটিও নিউ সাউথ ওয়েলসের হাসপাতালে ভর্তি আছে। ক্রিটিক্যাল কেয়ারে থাকা দুই বছরের আক্রান্ত শিশুকে ইতিমধ্যেই অ্যান্টিটক্সিন দেওয়া হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক এবং অক্সিজেনের সাপোর্টও দেওয়া হবে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, থ্রোট ডিপথেরিয়া ব্যাকটেরিয়াজনিত ইনফেকশন। গলায় টনসিলে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে এই ইনফেকশন। আক্রান্তদের গলায় রাতারাতি একটি ধূসর-সাদা পাতলা আস্তরণ তৈরি হয়। যার কারণে আক্রান্তদের খাদ্যবস্তু চিবিয়ে বা গিলে খেতে সমস্যা সৃষ্টি করে। কেবল খাবারে নয়, এই রোগে আক্রান্তদের নিঃশ্বাস নিতেও সমস্যা হয়।
অস্ট্রেলিয়ার নর্থ কোস্ট পাবলিক হেলথ ইউনিট দুই শিশু এই রোগে আক্রান্তের খবর নিশ্চিত করেছে। আক্রান্ত দুই শিশুর একজনের বয়স দুই এবং অপরজনের ছয়।
নিউ সাউথ ওয়েলসের জনস্বাস্থ্য বিভাগ জানাচ্ছে, এই দুই শিশুর গলা ইতোমধ্যেই অস্বাভাবিকভাবে ফুলে গেছে। হৃদযন্ত্র, মাংসপেশী এবং নার্ভেও প্রভাব ফেলেছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থ্রোট ডিপথেরিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে ১০ শতাংশ অতি সংকটজনক হতে পারে।
জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়ার ওই দুই শিশুকে ডিপথেরিয়ার ভ্যাকসিন দেওয়া হয়নি। সে কারণে তারা যেমন আক্রান্ত হয়েছে, তেমনি তাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও এই রোগ সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
নর্থ কোস্টের জনস্বাস্থ্য পরিচালক পল ডগলাস বলেন, আমাদের দেশে শিশুদের টিকা দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাই ডিপথেরিয়ার মতো রোগের সম্ভাবনা এখানে কম। কিন্তু, এই ঘটনা আমাদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। কোনো শিশু জন্মের ছয় সপ্তাহের মধ্যেই বিনামূল্যে ডিপথেরিয়ার ভ্যাকসিন পেয়ে থাকে।
উল্লেখ্য, ১৯৪০ সালে শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই ডিপথেরিয়া। মূলত হাঁচি-কাশি থেকেই এই রোগ একজন থেকে অপরজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে এবার বিজ্ঞানীর। আশঙ্কা করছে হয়তো শীঘ্রই এমন কিছু মাইক্রোবসের সম্মুখীন আমাদের হতে হবে, হাজার হাজার বছর আগে যাদের অস্তিত্ব এই বিশ্ব থেকে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলেই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণঘাতী অতীতের অনেক মাইক্রোবস ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। ২০১৬ সালে সাইবেরিয়ায় ১২ বছরের এক শিশুর অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়। গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছিলেন, বহু বছর আগে ওই এলাকায় অ্যান্থ্রাক্সের কবলে প্রচুর রেনডিয়ারের মৃত্যু হয়েছিল। সেই দেহগুলো বরফের নীচে চাপা পড়েছিল।
বিশ্ব উষ্ণায়নে বরফ গলার সঙ্গে সঙ্গেই মৃতদেহে চাপা পড়ে থাকা জীবাণু বাইরে বেরিয়ে ফের সক্রিয় হয়ে ওঠে। কোনোভাবে পানি এবং খাবারের সঙ্গে মিশে গিয়েই ওই শিশুর সংক্রমণ ঘটায়।
শুধু এই একটা ঘটনাই নয়, গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা বরফের নীচে চাপা পড়ে থাকা একাধিক প্রাণঘাতী জীবাণুর খোঁজ পেয়েছেন। যেমন ২০০৫ সালে নাসার বিজ্ঞানীরা আলাস্কার একটি বরফ হ্রদ থেকে ৩২ হাজার বছরের পুরনো এক ব্যাক্টেরিয়ার খোঁজ পেয়েছেন। এর দু’বছর পর ২০০৭ সালে আন্টার্কটিকার বরফে চাপা পড়ে থাকা ৮০ লক্ষ বছর পুরনো এক ব্যাক্টেরিয়ার সন্ধানও পেয়েছেন।
১৯১৮ সালে সারা বিশ্বের ত্রাস হয়ে উঠেছিল স্প্যানিস ফ্লু। প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এই সংক্রমণের জেরে। আলাস্কার তুন্দ্রায় বরফের তলার গণ কবর দেওয়া হয়েছিল মানুষদের। সেই জায়গা থেকেই স্প্যানিস ফ্লু ভাইরাসের জেনেটিক অংশ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
এমনকী একইভাবে সাইবেরিয়ায় বরফের তলা থেকে গুটি বসন্ত এবং বিউবোনিক প্লেগ-এর ভাইরাসও মিলেছে। ১৮৯০ সালে সাইবেরিয়াতে মহামারি আকার নিয়েছিল গুটি বসন্ত। ৪০ শতাংশ জনবসতি সাফ হয়ে গিয়েছিল এই রোগে।
ফ্রান্সের এইক্স-মারসেলি ইউনিভার্সিটি বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোবসের জন্য খুব ভাল সংরক্ষকের কাজ করে বরফের স্তূপ। কারণ অত্যন্ত ঠান্ডা, কোনও অক্সিজেন নেই এবং সূর্যের আলোও পৌঁছয় না। ফলে যুগ যুগ ধরে বরফের তলায় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে এরা।
পৃথিবীর দুই প্রান্তে বছরের পর বছর ধরে যে বরফের আস্তরণ জমা হয়ে রয়েছে, তাপমাত্রা বাড়ার কারণে তা প্রতিদিনই গলতে শুরু করেছে। ফলে বরফ স্তূপের গভীরে চাপা পড়ে থাকা এই সমস্ত প্রাণঘাতী ভাইরাস-ব্যাক্টিরিয়াও ফের সক্রিয় হয়ে ওঠার আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৫০
আপনার মতামত জানানঃ