বন্যা, তীব্র তাপপ্রবাহসহ চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার ঘটনাগুলোই এখন ‘নতুন স্বাভাবিক’ বলে জানিয়েছে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও)। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৬) সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডব্লিউএমও আগাম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বৈশ্বিক উষ্ণতা, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, সমুদ্রের পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে। খবর বিবিসি
বিশ্বে দাবদাহ, দাবানল ও বন্যার মতো জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া তীব্রতর হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) বলেছে, তীব্র তাপপ্রবাহ, বিধ্বংসী বন্যাসহ চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার ঘটনাগুলোই এখন নতুন স্বাভাবিক বা ‘নিউনরমাল’।
২০২১ সালের জলবায়ু প্রতিবেদনে এমন একটি বিশ্বকেই তুলে ধরেছে ডব্লিউএমও যেখানে চরমভাবাপন্ন ঘটনাগুলোই নতুন স্বাভাবিক বা নিউ নরমাল।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, আমাদের চোখের সামনে পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। ২০০২ সাল থেকে ২০ বছরের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে প্রথমবারের মতো প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে চলেছে। ২০২১ সালে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিও নতুন রেকর্ড গড়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের ঘনত্ব রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছানোয় চলতি বছরসহ গত সাত বছর ছিল উষ্ণতম।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা।
৯০ এর দশকের শুরু থেকে স্যাটেলাইট ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সূক্ষ্মভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা পরিমাপের পর ১৯৯৩ থেকে ২০০২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে প্রতিবছর সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ২.১ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে, ২০১৩ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে হিমবাহ গলতে থাকায় উচ্চতা প্রায় দ্বিগুণহারে ৪.৪ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
ব্রিস্টল গ্লাসিওলজি সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক জোনাথন বোম্বার বলেন, গত দুই সহস্রাব্দের মধ্যে সর্বোচ্চ গতিতে বাড়ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা।
তিনি বলেন,সবকিছু একইভাবে চলতে থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২মিটার পর্যন্ত বাড়বে। ফলে, বিশ্বের প্রায় ৬৩০ মিলিয়ন মানুষকে স্থানান্তরের প্রয়োজন হবে।
প্রতিবেদন অনুসারে, তাপমাত্রার হিসাবে ২০২১ সাল রেকর্ড উষ্ণতার ষষ্ঠ বা সপ্তম অবস্থানে থাকবে। চলতি বছরের প্রথম কয়েক মাসে লা নিনার প্রভাবে আবহাওয়া শীতল থাকায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা কিছুটা কম ছিল।
পৃথিবীর বাতাসে যত কার্বন ডাই অক্সাইড মিশছে, তার অধিকাংশই আসছে মাত্র চারটি দেশ থেকে—চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও রাশিয়া। সঙ্গে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। প্যারিসে ২০১৫ সালের সম্মেলনে এরা সবাই একমত হয়েছিল— বিশ্বের তাপমাত্রার বিপজ্জনক বৃদ্ধি ঠেকাতে তারা কার্বন নির্গমন কমাবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কী পদক্ষেপ নিয়েছে তারা?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু মুখেই বড় বড় কথা। কাজের বেলায় ঠনঠন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাস্তবতা এখন এমনই। কার্বন বা গ্রিসহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে একের পর এক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো কাজই তারা করেনি। উলটো এই দেশগুলোতেই দ্রুতগতিতে বেড়েছে কার্বন নিঃসরণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, পৃথিবীর আবহাওয়া পাল্টে যাবার কথা অনেকদিন থেকেই আলোচনায়। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছিলেন। ওজোনস্তর ফুটো হয়ে যাবার কথাও অনেক পুরোনো। কিন্তু সেই পুরোনো কথার গুরুত্ব কেউ দেয়নি। আর দিলেও তা যে যথাযথভাবে দেওয়া হয়েছে, এমন বলার সুযোগ নেই।
পৃথিবীর বাতাসে যত কার্বন ডাই অক্সাইড মিশছে, তার অধিকাংশই আসছে মাত্র চারটি দেশ থেকে—চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও রাশিয়া। সঙ্গে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। প্যারিসে ২০১৫ সালের সম্মেলনে এরা সবাই একমত হয়েছিল— বিশ্বের তাপমাত্রার বিপজ্জনক বৃদ্ধি ঠেকাতে তারা কার্বন নির্গমন কমাবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কী পদক্ষেপ নিয়েছে তারা?
বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা মানুষ শুনেছে। রাষ্ট্রপ্রধানরা তহবিল সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন ফোরামের নানা আয়োজনে উত্তেজক কথাবার্তা বলে হাততালি নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন। একে অন্যকে দোষারোপের সংস্কৃতিও রয়েছে। আর ধনী রাষ্ট্রগুলো যেভাবে কার্বন নিঃসরণ করছে, তার বিপরীতে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো রীতিমতো অসহায়। ফলে একদিকে দোষারোপের সংস্কৃতি, দরিদ্র দেশগুলোর আহাজারি, পৃথিবীব্যাপী সচেতন মানুষদের আর্তনাদ অন্যদিকে বায়ুমণ্ডলে অবিচ্ছিন্নভাবে কার্বন নিঃসরণ চলতে থাকে। ফলে বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তাও ফলতে শুরু করেছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, হিমালয়ের বরফ গলছে। সেই পানি ধেয়ে আসছে সমুদ্রে। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। আর ওজোনস্তরের ফুটো বাড়তে থাকারও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
বিশ্বের তাপমাত্রার যে পরিবর্তন তাও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। পেছনের একশ বছরের তাপমাত্রা মিলিয়ে দেখে, বায়ুমণ্ডল এবং পৃথিবীপৃষ্ঠ উষ্ণ হয়ে ওঠার প্রমাণও হাতেনাতে ফলতে শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দুর্ভাগ্য, পৃথিবীর তাপমাত্রা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করার কাজটি নিয়ে যত সময়ক্ষেপণ হবে, মতানৈক্য থাকবে, তত বেশি মোকাবেলা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি এড়ানোর পথ একটাই, সেটা হল শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোকে এক টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা।
এদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার বিষয়ে একমত হয়েছেন বিশ্বের শতাধিক দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা। জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক চলমান কপ-২৬ সম্মেলনের প্রথম বৃহৎ কোনো চুক্তি হিসেবে বন উজাড় বন্ধের বিষয়ে একমত হন তারা।
দক্ষিণ আমেরিকার বিশাল এলাকাজুড়ে আমাজন বনাঞ্চল বিস্তৃত। এই বনভূমির বিশাল অংশ ব্রাজিলের মধ্যে পড়েছে এবং সেখানে বনের গাছ কেটে উজাড় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার বিষয়ে মঙ্গলবার যে চুক্তি হতে যাচ্ছে, তাতে ব্রাজিলও স্বাক্ষর করবে।
বিবিসি জানিয়েছে, বন উজাড় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে এবং চুক্তি মোতাবেক বনাঞ্চলের স্বাভাবিক পরিস্থিতি বজায় রাখতে প্রায় ১ হাজার ৯২০ কোটি মার্কিন ডলারের তহবিল গঠন করা হবে। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বিপুল অংকের এই তহবিল গঠন করা হবে।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, দাবানল নিয়ন্ত্রণ, ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি সংস্কার ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর যথাযথ নিরাপত্তায় ব্যয় করার জন্য এই তহবিলের অর্থ উন্নয়নশীল দেশগুলোও পাবে।
এদিকে বন উজাড় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ব্যাপারে সর্বশেষ এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু তারা সতর্ক করছেন যে, বনভূমি উজাড়ে ধীরগতি আনার বিষয়ে ২০১৪ সালের একটি চুক্তি কার্যত ব্যর্থ হয়েছে এবং এই কারণে অঙ্গীকার পূরণে বিশ্বনেতাদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিবিসি জানিয়েছে, এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং থাকছেন। এছাড়া ব্রাজিল, কানাডা, রাশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াও এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে। পৃথিবীর মোট বনভূমির প্রায় ৮৫ শতাংশই এই চার দেশে রয়েছে।
উল্লেখ্য, বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এখন স্পষ্ট। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে নিয়মিত ভাবে দাবদাহ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। একইসঙ্গে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও।
এছাড়া বনের গাছ কেটে ফেললে সেটিও জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। কারণ গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং বিপুল পরিমাণে বন উজাড় হলে বায়ুতে ক্ষতিকর এই গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যায়।
এই পরিস্থিতিতে ২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার বিষয়ে একটি বৈশ্বিক চুক্তি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের জলবায়ু ও বনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ সিমন লিউস বলেন, বিভিন্ন দেশে বন উজাড় বন্ধে রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়টি সুসংবাদ। বন উজাড় বন্ধে যথেষ্ট তহবিলও বরাদ্দ হয়েছে বলে জানান তিনি।
তবে সিমন লিউস বিবিসিকে আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোতে মাংসের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। নতুন এই সমঝোতা অনুসারে সেই চাহিদার বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে তা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
চাথাম হাউস সাসটেনেবিলিটি অ্যাক্সিলেটরের নির্বাহী পরিচালক অ্যানা ইয়াং বলেন, এই সমঝোতায় প্রচুর অর্থের জোগান রয়েছে। তবে চুক্তির কার্যকারিতা দেখার জন্য আরও সময় প্রয়োজন। এ ধরনের সমঝোতাকে কপ–২৬ সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫০
আপনার মতামত জানানঃ