বাংলাদেশে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমছে। গত কয়েক বছরে শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাই, ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবছর পুলিশের বিরুদ্ধে গড়ে ১৮ থেকে ২৫ হাজার অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে তদন্ত শেষে ১০ থেকে ১৩ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শাস্তি হয় দুইভাবে; লঘুদণ্ড ও গুরুদণ্ড। প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই লঘুদণ্ড হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বিভাগীয় মামলায় ৬৭ হাজার ৩৯ জন পুলিশ সদস্যকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৬২ হাজার ৮৯৯ জনকে লঘুদণ্ড এবং ৩ হাজার ৬২৩ জনকে গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গুরুদণ্ডের মধ্যে রয়েছে চাকরিচ্যুত করা। ওই পাঁচ বছরে ৫১৭ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এর পর ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে গুরুদণ্ডের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায়িছে ৫ হাজার ৩৯৬ জনে; যা আগের পাঁচ বছরের তুলনায় প্রায় দেড় গুণ বেশি।
সম্প্রতি ঘটা পরিমণী-সাকলায়েন ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এক ব্যবসায়ীর স্বর্ণ আত্মসাৎ করে গ্রেপ্তার হন ফেনী জেলা ডিবি পুলিশের ওসি সাইফুল ইসলামসহ ৬ পুলিশ সদস্য। তারা দীর্ঘদিন ধরেই মানুষকে জিম্মি করে আর্থিক ফায়দা নিয়ে আসছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ৯ এপ্রিল এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ নেওয়ার অভিযোগে রাজাধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে র্যাবের চার সদস্যকে আটক করে হাতিরঝিল থানাপুলিশ। পরে তাদের র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আটককৃতদের মধ্যে তিনজন সেনাবাহিনীর ও একজন বিমানবাহিনীর সদস্য ছিলেন। নিজ নিজ বাহিনীর আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি হবে বলে র্যাব জানিয়েছে।
গত ২৫ আগস্ট দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে এক নারী ও তার ছেলেকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবির অভিযোগে রংপুর সিআইডির এএসপিসহ তিন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন- রংপুর সিআইডির এএসপি সারোয়ার কবির, এএসআই হাসিনুর রহমান ও কনস্টেবল আহসানুল হক।
জাতিসংঘ শান্তি মিশনে থাকাকালীন এক নারী পুলিশ ইন্সপেক্টরকে ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) বাগেরহাটের পুলিশ সুপার মোক্তার হোসেনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি মামলা হয়েছে। ঘটনাটি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে হলেও একজন পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আরেক নারী পুলিশ ইন্সপেক্টরকে ধর্ষণের অভিযোগটি নিয়েও দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ ঘটনাও পুলিশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।
স্বর্ণ, নগদ অর্থ, মুঠোফোন ও মালামাল লুট করার অভিযোগে কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া থানার সাত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে গত ৯ আগস্ট মামলা হয়েছে। গত ১৭ আগস্ট রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় ই-অরেঞ্জের প্রতারণার শিকার মো. তাহেরুল ইসলাম নামের এক গ্রাহক একটি মামলা করেন। তদন্তে বেরিয়ে আসে, ই-অরেঞ্জের অন্যতম ‘হোতা’ ছিলেন বনানী থানার ওসি (বরখাস্তকৃত) সোহেল রানা। পালিয়ে ভারতে গেলে বিএসএফের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি।
রাজধানীর মোহাম্মাদপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও চিকিৎসক এসএম সিদ্দিকুর রহমানের বাড়িসহ সাড়ে তিন কাঠা জমি দখল করে নেন ট্রাফিক পরিদর্শক ওয়াবদুল হক। সেখানে সিদ্দিকুর রহমানের মায়ের নামে বানানো দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র ভেঙে পুলিশ কর্মকর্তা ওবায়দুল হক নির্মাণ করেছেন বিলাসবহুল ১০তলা ভবন। ভবনের নাম ‘আন্দালুসিয়া টাওয়ার’। এর পর মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকুর রহমান রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশ সদর দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন। পুলিশের তদন্তেও উঠে আসে ওবায়দুল হকের দখলবাণিজ্য। তবে এখনো তার কোনো শাস্তি হয়নি। এ বিষয়ে আদালতে মামলা করেছেন সিদ্দিকুর রহমান।
স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে সরকারি জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেছিলেন রাজশাহী নগরীর এক গৃহবধূ। কিন্তু বিচারপ্রার্থী গৃহবধূকে উল্টো যৌন নির্যাতন করেছেন পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা। কিছুদিন আগে নগরীর বোসপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত এএসআই মো. শামীমকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
প্রতিবছর পুলিশের বিরুদ্ধে গড়ে ১৮ থেকে ২৫ হাজার অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে তদন্ত শেষে ১০ থেকে ১৩ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শাস্তি হয় দুইভাবে; লঘুদণ্ড ও গুরুদণ্ড। প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই লঘুদণ্ড হয়।
বরিশালের উজিরপুর থানায় গত মাসে রিমান্ডে থাকা এক নারী আসামিকে যৌন হয়রানি ও শারীরিক নির্যাতন করেন ওসি জিয়াউল হাসান ও মাইনুল। ওই দুই কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারের পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ফৌজদারি অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে মামলা হয়েছে এবং বিচার চলছে। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় পুলিশের অপরাধ কাজে অধিক হারে জড়িয়ে পড়ার জন্য দীর্ঘদিনের ঘুণে ধরা সিস্টেমকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, ঔপনিবেশিক আমলের কাঠামো থেকে পুলিশ বাহিনী এখনো বের হতে পারেনি। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি করা যায়নি তাদের কাঠামো। ১৮৬১ সালের আইন দিয়ে পুলিশ পরিচালিত হচ্ছে। এত দিনেও কাঠামোগত সংস্কার করা যায়নি। বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে মূল সমস্যা খতিয়ে দেখতে হবে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে আমাদের। ব্যক্তিবিশেষকে দোষারোপ করে লাভ নেই। পুরো সিস্টেমটা নিয়ে ভাবতে হবে। বিশেষ করে বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন ঘাট, প্রসিকিউসন, তদন্ত ব্যবস্থা আছে।
তারা বলেন, বিসিএস দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ভালো অফিসার ও কাজ দেখালে হবে না, জবাববদিহিতা স্বচ্ছতা জরুরি। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কর্ম পরিবেশ নিয়েও ভাবতে হবে। স্থানীয় এমপি, অর্থশালীদের সঙ্গে ওসিদের একটা আঁতাতের সম্পর্ক থাকে। তারা একজন আরেকজনকে প্রটেকশন দেয়। আর সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হয়। ওসি, এসআই লেভেলে সংস্কার জরুরি বলে মনে করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসা অব্যাহত রয়েছে। কোথাও কোথাও মাদকের সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকার অভিযোগ আসে পুলিশের বিরুদ্ধে, কোথাওবা অস্ত্র বিক্রয়কারী হিসাবে, কোথাওবা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ, অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ, পুলিশের নেতৃত্বে মাদক পাচার চক্র গড়ে ওঠার অভিযোগ, চুরি ডাকাতি ইত্যাদি হেন কোনো অপরাধ নেই যা পুলিশ শব্দটির সাথে জুড়ে বসে নাই। প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে এমনসব অভিযোগ আসে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার হার আশংকাজনক। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে বিভিন্ন অপকর্মের। এবিষয়ে পুলিশের কর্তৃপক্ষসহ দেশের সরকাকেও নজর বাড়াতে হবে। কেননা, আইন রক্ষাকারী কর্তৃক একেরপর এক আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডে দেশের আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা জন্মাবে। ফলশ্রুতিতে দেশে দেখা দিবে বিশৃঙ্খলা।
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনের খড়্গ চালানোর আগে পুলিশের ওপর চালানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, আগে পুলিশকে অপরাধমুক্তের চরিত্র অর্জন করতে হবে। নইলে সন্ত্রাসীদের নিকট পুলিশের যে ভাবমূর্তি সৃষ্টি হচ্ছে, এতে পুলিশ আর সন্তাসীদের মধ্যকার তফাৎ ঘুচে যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩১
আপনার মতামত জানানঃ